ইতিহাসের পাতা থেকে

আসাদের রক্ত কথা বলেছিল

Looks like you've blocked notifications!

পাকিস্তানের রাজনীতির পালে দোলা দিচ্ছে তখন উত্তাল ঝড়ো হাওয়া। একদিকে শেখ মুজিবের ছয় দফা, অন্যদিকে ছাত্রসমাজের ১১ দফা। মিছিল, মিটিং, হরতাল, ধর্মঘটে পূর্ব পাকিস্তান অগ্নিগর্ভ।

বিপরীতে দ্বিগুণ-চতুর্গুণ হারে চলছিল স্বৈরাচার আইয়ুবশাহির অত্যাচার-নির্যাতনের স্টিম রোলার। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যাকে এককথায় বলে মরণকামড়। তবু ছাত্র-জনতা বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নয়।

৪ জানুয়ারি-১৯৬৯ সাল, ছাত্রদের ১১ দফা ও বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার সঙ্গে দ্বিধাহীনভাবে একাত্মতা পোষণ করেন ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দ। এতে আন্দোলন পায় নতুন গতি। ১৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ছাত্ররা দেশব্যাপী সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ডাক দেন। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে আইয়ুবের দাসানুদাস গভর্নর মোনায়েম খান চারজনের বেশি লোক একত্র হতে পারবে না ঘোষণা দিয়ে ১৪৪ ধারা জারি করে।

পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে 'পূর্ব পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি' আইয়ুব সরকার আরোপিত ১৪৪ ধারা ভেঙে প্রায় ১০ হাজার ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে মিছিল বের করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে পৌঁছলে পুলিশ ও ইপিআর বাহিনী মিছিলে হামলা চালায়।

আসাদ ছিলেন মিছিলের সম্মুখ সারিতে। আধা ছত্রভঙ্গ মিছিলটি আবার সংগঠিত করে এগোতে থাকেন আসাদ। সামনের দিকে এগোতে শুরু করলে পুলিশ প্রথমে আসাদের ওপর বেয়নেট চার্জ করে। এতে আহত হয়ে মাটিতে পড়ে গেলে জনৈক বাঙালি পুলিশ কর্মকর্তা রিভলভার দিয়ে পয়েন্ট ব্লাঙ্ক-রেঞ্জ থেকে আসাদের বুকে গুলি করেন। এভাবেই শহীদ হন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) নেতা আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান ওরফে আসাদ। থেমে যায় স্লোগানে রাজপথ কাঁপানো একটি কণ্ঠস্বর।

তারপর যা ঘটেছিল :

এ লাশ আমরা রাখব কোথায়?

                     তেমন যোগ্য সমাধি কই?

                     মৃত্তিকা বলো, পর্বত বলো
 অথবা সুনীল-সাগর-জল—

সবকিছু ছেঁদো, তুচ্ছ শুধুই!

তাই তো রাখি না এ লাশ আজ
 মাটিতে পাহাড়ে কিংবা সাগরে,
 হৃদয়ে হৃদয়ে দিয়েছি ঠাঁই—

কবিতার এই পঙ্‌ক্তিগুলোই সম্ভবত হবে সে সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো বলা।

সারা দেশে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল আসাদের মৃত্যুসংবাদ। সঙ্গে সঙ্গে অফিস-আদালত ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত পিয়ন, চাপরাশি, কেরানিসহ সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। আসাদের রক্তাক্ত শার্ট উঁচিয়ে মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে ঢাকার রাজপথ। চারদিকে বজ্রকণ্ঠে স্লোগান ওঠে, ‘আসাদের মন্ত্র, জনগণতন্ত্র’।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আসাদের মৃত্যুই ছিল আইয়ুবশাহির মসনদের কফিনে শেষ পেরেক। আসাদ-হত্যার প্রতিক্রিয়ার গণআন্দোলন পরবর্তীকালে রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। যার তোপে একসময় পদত্যাগে বাধ্য হন লৌহমানব আইয়ুব খান। 

২১ জানুয়ারি ‘কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি' ২২, ২৩ ও ২৪ জানুয়ারি শোক পালন ও হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করে। কর্মসূচির শেষ দিন ২৪ জানুয়ারি পুলিশ আবার বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর গুলি চালায়। এর পর পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আইয়ুব সরকার তার বাকি দুই মাস আয়ুষ্কালে ১৪৪ ধারা আর কার্যকর রাখতে পারেনি। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয় নতুন মাত্রা।

এরই মধ্যে ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সকালে ঢাকা সেনানিবাসে বন্দি অবস্থায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। এতে পরিস্থিতি হয়ে ওঠে আরো উত্তপ্ত। সেদিন বিকেলেই পল্টনে ন্যাপের বিশাল জনসভায় মওলানা ভাসানী জ্বালাময়ী বক্তৃতার মধ্য দিয়ে ‘অবিলম্বে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবকে মুক্তি না দিলে জনতাকে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে হামলা চালিয়ে প্রয়োজনে ফরাসি বিপ্লবের মতো জেল ভেঙে মুজিবরকে মুক্ত করে নিয়ে আসব’ ঘোষণা দিলে সভা শেষে মন্ত্রমুগ্ধ বিক্ষুব্ধ জনতা সরকারি স্থাপনায় ব্যাপক হামলা-ভাঙচুর চালায় এবং ইপিআরটিসির খাদ্যবাহী ট্রাক লুট করে।

১৫ ফেব্রুয়ারির ঘটনাবলির পর আবার সেনাবাহিনী তলব করে কারফিউ জারির মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার অন্তিম চেষ্টা চলায় আইয়ুব-মোনায়েম সরকার। কিন্তু ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর শিক্ষক শামসুজ্জোহা সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হলে সারা দেশ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। রাজনীতির সঙ্গে তেমন সংশ্রবহীন একজন নিরীহ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের নিহত হাওয়ার সংবাদ যেন বারুদের স্তূপে ক্ষুদ্র একটি স্ফুলিঙ্গের মতো কাজ করে।

কারফিউ ভেঙে জনতা সারা দেশের রাজপথ দখল করে নেয়। নিরুপায় আইয়ুব খান ২১ ফেব্রুয়ারি-১৯৬৯ শেখ মুজিবুর রহমানসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সব আসামিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন।

সেইসঙ্গে মণি সিং, নগেন সরকার, রবি নিয়োগীসহ আরো ৩৪ জন রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নেয়।

সর্বশেষ ২৪ মার্চ রাতে এক বেতার ঘোষণার মাধ্যমে জেনারেল ইয়াহিয়ার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করেন আইয়ুব খান।

এর পর ক্রমাগত যাত্রা ’৭০-এর নির্বাচনের দিকে, ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার পরোক্ষ ঘোষণাসংবলিত ভাষণের দিকে। এর পর এক নদী রক্ত পেরিয়ে আমাদের স্বাধীনতার লাল সূর্যের উদয়। স্বীকার না করে উপায় নেই, এ বিশাল অর্জনের পেছনে আসাদের রক্তের অবদান পরিমেয় নয় কোনোভাবেই।

সেদিন আসাদ দাঁড়িয়েছিল স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, দাঁড়িয়েছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য, দেশমাতৃকার টানে, বিবেকের তাড়নায়; ফলাফল কী হবে কিংবা এরই সূত্র ধরে দেশ যে অচিরেই স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাবে, সে কথা হয়তো কল্পনায়ও আসেনি তাঁর।

আসাদের শহীদ হয়ে যাওয়ার পর স্বাধীন বাংলাদেশ অতিক্রম করে ফেলেছে পূর্ণাঙ্গ যৌবন। কিন্তু শৈশবেই রয়ে গেছে তার গণতন্ত্র। স্বাধীনতার পর এ দেশের কায়েমি, স্বার্থবাদী, ক্ষমতালিপ্সু শাসকগোষ্ঠীর হাতে গণতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত হয়েছে বারবার। সেটা কখনো নগ্ন স্বৈরাচারী কাঠামোয়, কখনো খোদ গণতন্ত্রের খোলসে। অথচ স্বৈরাচার থেকে মুক্তি পেয়ে একটি আদর্শ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পাওয়াই ছিল স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য। সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি এতকাল পরও।

তাই আসাদের রক্ত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এ দেশের ছাত্র-যুবাদের এগিয়ে আসার জন্য আজো বিপ্লবী আহ্বান জানায়। ২০ জানুয়ারি আসে একটি আদর্শ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের লৌহকঠিন শপথ গ্রহণের দাবি নিয়ে। আসাদের রক্ত বৃথা যায়নি, আসাদের রক্ত আজও কথা বলে।
 
লেখক : পরিবর্তন ডটকমের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি।