এনটিভি অনলাইনের বর্ষপূর্তি ও কাশ্মীর অভিজ্ঞতা

Looks like you've blocked notifications!

সিন্ধু নদের ইংরেজি নাম ইন্দাস। এই নদ উপমহাদেশের দুটি বৃহৎ নদী-বেসিনের একটি। এর উৎসস্থল তিব্বত। প্রবাহিত হয়েছে জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের লাদাখ অঞ্চল হয়ে পাকিস্তানের ওপর দিয়ে আরব সাগর পর্যন্ত। এই নদের তীরেই গড়ে উঠছে সুপ্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা। কাশ্মীরের বিখ্যাত ঝিলম নদ সিন্ধুর সঙ্গে মিশেই পৌঁছেছে সাগরে। হিমালয়ান ভ্যালিগুলোর অপূর্ব আর বৈচিত্র্যময় সব সৌন্দর্যের মূল রহস্য এই নদ আর তার বুকে বয়ে চলা বরফ গলা পানি।

ভৌগোলিক এই সংযোগের কারণেই, সিন্ধু দর্শন আর কাশ্মীর ভ্রমণের মধ্যে এক যোগসূত্র আছে। কালক্রমে, মোগল, পাঠান আর ইংরেজদের কল্যাণে কাশ্মীর পরিচিত হয়ে উঠছে ‘ভূ-স্বর্গ’ হিসেবে। তাই, বাংলাদেশের অসংখ্য ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে কাশ্মীর এক দারুণ গন্তব্য। মানুষ জানতে চায় কাশ্মীরকে, দেখতে চায় এর রূপ। যাদের সময় ও সামর্থ্যে কুলায় না, তারা পড়ে ও শুনে তৃষ্ণা মেটায়। অনেকে বেড়াতে যাওয়ার আগে জেনে নিতে চায় সেখানে কী আছে? তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে সেজন্য সবাই প্রথম খোঁজে গুগল। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এক বছর আগেও কাশ্মীর সম্পর্কে গুগল-সার্চ ইঞ্জিনে বাংলা ভাষায় তেমন কিছুই পাওয়া যেত না।

এখন এনটিভি অনলাইনের ভ্রমণ পাতায় কাশ্মীরের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবিই দেখা যায়। কাশ্মীরের প্রকৃতি, নদী আর পর্বত ছাড়িয়ে এনটিভি অনলাইন পৌঁছে গেছে কাশ্মীরের ঘর-গৃহস্থালিতে। এখানকার অসংখ্য বাঙালি পাঠক এখন এনটিভি অনলাইনে খবর ও ফিচার পড়ে। এই সাইট এরই মধ্যে প্রকাশ করেছে কাশ্মীরের মানুষ ও তাদের সংস্কৃতির কথাও। একের সংস্কৃতি, অনুষ্ঠানাদিকে অন্যের ভাষায় তুলে ধরার মাধ্যমে মূলত এক মেলবন্ধন সৃষ্টি করেছে এনটিভি।

কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার সুবাদে শ্রীনগরে অবস্থান করছি প্রায় দুই বছর। বাংলাদেশের শতাধিক পর্যটকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে। তাঁদের অনেকেই কাশ্মীর বেড়াতে আসার আগে বিস্তারিত জেনে এসেছেন এনটিভি অনলাইন পড়ে। বাংলাদেশি এক তরুণ সৈয়দ আরিফুল হকের গল্প তো একেবারেই আলাদা। তিনি এসেছিলেন একাকী। তাঁকে নিয়ে অতিথির মতো হাজির হয়েছিলাম বন্ধুদের বাড়িতে। এনটিভি অনলাইনের নিয়মিত আগ্রহ ও অনুরোধের কারণেই শত ব্যস্ততার মধ্যেও লিখতে হয়েছিল কাশ্মীরের কথা। এখানকার মানুষের কথাও। এগুলো নিঃসন্দেহে বাংলা ভাষার ভ্রমণ সাহিত্যের এক দারুণ সংযোজন।

এনটিভি অনলাইনের বছরপূর্তি হয়েছে এই ভাষার মাসেই। তাই, আজ কাশ্মীরি ভাষার কয়েকটি তথ্য দিয়েই কথা শেষ করা যাক। কাশ্মীরি একটি কথ্য ভাষা। এখানে কথা বলে আনুমানিক ৯.২ (৯২ লাখ) মিলিয়ন মানুষ যা বাংলা ভাষাভাষি মোট জনসংখ্যার এক শতাংশের সমান। এদের রয়েছে নিজস্ব গান, কবিতা, সাহিত্য সবকিছু। মূলত ফারসি বর্ণমালায় কাশ্মীরি লেখা হয়ে থাকে। তবে অনেকে হিন্দি বর্ণমালাও ব্যবহার করেন। প্রথমবারের মতো কোনো লোকের মুখে এই ভাষা শুনে কেউ চিন্তাই করতে পারবে না যে, এ ভাষার শব্দের সঙ্গে বাংলার কোনো মিল থাকতে পারে। প্রথম প্রথম আমাদের মনে হতো, ওরা হৈচৈ করছে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, আমার স্পষ্ট উচ্চারণের বাংলা শুনেও ওদের কাছে এটা চিৎকার-চেঁচামেচি মনে হতো। কিন্তু গত দুই বছরের নিরবচ্ছিন্ন পর্যালোচনায় দারুণ কিছু মিল আবিষ্কার করেছি।

এ বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে নিবন্ধও উপস্থাপন করেছিলাম। দুটি তথ্য এখানে তুলে ধরছি। কাশ্মীরি সমাজে ‘হাজাম’ নামে একটা বংশ আছে। এক বন্ধুর কাছ থেকে জানা গেল হাজাম হলো ‘নাপিত’। যারা বংশগতভাবে ‘ছুরি বা কাঁচি’ দিয়ে মানুষের মাথা কামায়। মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের খুলনার শিরোমনি গ্রামে ‘হাজাম’পাড়া বলে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া এক গোষ্ঠী লোক আছে। ওই হাজামরা বংশগতভাবে কাঁচি বা ছুরি দিয়ে ছেলেদের ‘খাতনা’ করায়। এই দুই হাজাম শব্দের মধ্যে কোনো মিল আছে কি না তা স্পষ্ট নয়। তবে, নিঃসন্দেহে এটা দারুণ সংযোগ। আরবি ভাষায় ‘হাজামাত’ বলে একটি শব্দ আছে। যার মানে হলো, ছুরি দিয়ে কিছু করা। শব্দটি পশতু বা পাঠান ভাষায়ও ব্যবহৃত হয়। কাশ্মীরি ভাষায়, এগারো সংখ্যাকে বলে ‘কাহ’। বাংলায় সুপারি ব্যাপারিরা একটা শব্দ বলেন ‘গাহ’। এগারোটা সুপারিকে এক ‘গাহ’ বলা হয়। তুমি কেমন আছ? কাশ্মীরি ভাষায় এমন প্রশ্নের জন্য বলে, ‘ঠিক পইঠ ছু?’ উত্তর হলো, ‘আসল পইঠ’। এসব অন্তমিলের কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, এখনকার সময়ে কাশ্মীরি ভাষার শব্দভাণ্ডারের মধ্যে ৩০% ফারসি, ২৫% আরবি ও ৪৫% সংস্কৃত ও অন্যান্য ভাষার শব্দ থেকে এসেছে। স্পষ্টতই আমরা জানি, বাংলা ভাষায়ও সংস্কৃত, আরবি ও ফারসির অনেক শব্দ আছে। সারকথা হলো, বাংলা ভাষার সঙ্গে কাশ্মীরি ভাষার কিছুটা আত্মীয়তা আছে। ভাষার মাসে বাংলা ভাষার এমন সব আত্মীয়কে এনটিভি অনলাইনের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা।