প্রতিক্রিয়া

প্রাণের উৎসব বইমেলায় মেতে উঠতে চাই

Looks like you've blocked notifications!

যাঁরা বইপ্রেমী, ফেব্রুয়ারি মাস এলে তাঁদের মনে একটাই কথা আসে তা হলো, বইমেলায় বইপ্রেমীরা রাখেন বইয়ের জন্য নির্ধারিত বাজেট এবং বইমেলায় যাওয়ার জন্য বেশ কয়েকটা দিন তাঁরা ধার্য করেন। যেমন কোনো একদিন নিজে ঘুরে ঘুরে উল্লেখযোগ্য প্রায় সব স্টল থেকে প্রকাশিত বইয়ের ক্যাটালগ নেবেন, আরেকদিন তাঁরা অন্য কোনো বইপ্রেমিক বন্ধুকে নিয়ে বইমেলা ঘুরবেন, বই দেখবেন। হয়তো বই কিনবেন বা কিনবেন না। এর পর সপ্তাহের শুক্রবার দিনটা (এ দিন কিছু সময় শিশুদের জন্য নির্ধারিত থাকে) চেষ্টা করবেন সন্তানের সঙ্গে বইমেলায় আসতে। আর ছেলেমেয়ে যদি শিশু/কিশোর হয়ে থাকে, তবে তো কথাই নেই। ছেলেমেয়েদের ভালো সুপাঠ্য বইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মধ্যে মা-বাবার থাকে প্রচণ্ড ভালোলাগা। কারণ, আজ থেকে অনেক বছর পর ছেলেমেয়ের স্মৃতিতে ভাসবে তার বাবা বা মায়ের উপহার দেওয়া প্রথম বইটির কথা। যে বইটি তাকে তার জীবন, সুখ-দুঃখ অথবা জীবনের লড়াই বুঝতে শিখিয়েছে। অনেক সময় দিকনির্দেশনামূলক বই অনেক কিশোরকে নিজের ভালোর জন্য উজ্জীবিত করে, তেমনি দেশ ও মানুষের প্রতিও তাকে করে তোলে সহানুভূতিশীল।

বইপ্রেমিক একজন ব্যক্তি ও তাঁর পরিবারের কথা বললাম। সে ব্যক্তি ছাড়া আর কারা যাচ্ছে বইমেলায় দেখি? তরুণরা নিঃসন্দেহে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে এমন কোনো তরুণ/তরুণীকে কি পাওয়া যাবে, যে ক্লাস শেষ করে একবারও বইমেলায় ঢুঁ না দিয়ে থাকতে পারবে?

বইমেলা তো পুরো ফেব্রুয়ারি মাস। এ মাসে উল্লেখযোগ্য দিনের ছড়াছড়ি যেন। ভ্যালেন্টাইনস ডে, পয়লা ফাগুন, একুশে ফেব্রুয়ারি। এতগুলো উৎসব এক মাসে! কিন্তু এতগুলো উৎসব পালন করার জন্য আমরা যাঁরা মধ্যবিত্ত, প্রিয় মানুষকে নিয়ে আনন্দ করতে চাই, তাঁদের জন্য তেমন আকর্ষণীয়/যাওয়ার সাধ্যের মধ্যে স্থান বইমেলা ছাড়া অন্য কোথাও রয়েছে কি? না, নেই। তাই এ সময়ে যাওয়ার জায়গার নাম হলো বাংলা একাডেমির বইমেলা। সত্যিই, কী যে আনন্দ লাগে সবার সেখানে গেলে, তাই না! ভালোবাসা দিবসে প্রিয় মানুষের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে তাঁকে বই উপহার দেওয়ার সঙ্গে প্রিয় মানুষের বিশেষ আবদারে অনেক কষ্ট করে ভিড় ঠেলে লেখকেরও অটোগ্রাফটাও যদি বইয়ের পাতায় আনা যায়, তাহলে তো দুজনেরই আনন্দ আর কুলায় না। প্রিয় মানুষটি যদি বইয়ের খুব বেশি ভক্ত না হয়েও থাকে, তবে বইমেলা থেকে বন্ধুর কিনে দেওয়া বইটি কি সে ফেলে দিতে পারে কখনো? পারে না। বইটি দেখে সে অন্তত একজন লেখকের নামটা জানতে পারে, যে লেখক তখন বিখ্যাত না হলেও কোনো একসময় বিখ্যাত হতে পারে। অনেক সময় পরে সে লেখকের প্রসঙ্গ এলে তখন তাঁরা দুজন তাঁদের পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করে কী পরিমাণ যে আনন্দ পাবেন, তা বলা বাহুল্য। 

আর বিশেষ দিনগুলোতে বইমেলায় যেতে তরুণ-তরুণীরা বেছে নেন হালফ্যাশনের শাড়ি ও পাঞ্জাবি। কখনো মাথায় পরে ফুলের হ্যাট, আবার কখনো গালে লিখে একুশে ফেব্রুয়ারি।বইমেলাকে ঘিরে যেন নতুন এক ফ্যাশনের সৃষ্টি হয়। 

ভালোবাসা দিবসে দুজনে বইমেলায় হাত ধরে ঘুরতে যেমন আনন্দ, তেমনি ২১ ফেব্রুয়ারির দিন শহীদ মিনারে খালি পায়ে ফুল দিতে গিয়ে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটা শুনলে নিশ্চয় দুজনের চোখটা ঝাপসা হয়ে ওঠে, তাই না। তখন শহীদ মিনার পর্যন্ত গিয়ে কেউ কি বইমেলায় না গিয়ে ফিরে আসে? ২১ ফেব্রুয়ারিতে প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে বইমেলায় যাওয়া, প্রিয় লেখকদের বই কেনা, তাঁদের কাছ থেকে দেখা (সেদিন প্রায় সব বিখ্যাত লেখক আসেন) তাঁদের সঙ্গে সুযোগমতো সেলফি তোলাও ভীষণ আনন্দের ব্যাপার। 

অর্থাৎ, ঢাকা শহরে বইমেলা আজ শুধু মেলা নয়, একটা উৎসব যেন। যাঁরা বইয়ের পোকা, নতুন কোন বই মেলায় এলো, তা জানার জন্য উৎসুক, তাদের জন্য যেমন এটা চরম আগ্রহের স্থান তেমনি আনন্দের বিষয়। অনেক নাগরিকের জন্যই বইমেলা সময় কাটানোর উত্তম জায়গা। শুধু তা-ই নয়, সে সময় বইমেলা ঘিরে টিএসসি এলাকায় চলে নানা আয়োজন।

যাঁদের বই মেলার হট কেক, যাঁদের স্টলের সামনে উপচেপড়া পাঠকের (মাঝেমধ্যে পুলিশ ও লাগে ভক্ত সরাতে ) ভিড়, তাঁদের বই বিক্রি হওয়ায় যেমন সুখের শেষ নেই, তেমনি যে তরুণ লেখকের প্রথমবার বই বের হলো তাঁর অনুভূতিটাই বা কেমন? প্রথম বইয়ে অটোগ্রাফ দেওয়ার সময় তাঁর কলমটা একটু কাঁপে কি? 

এত কিছুর সমাহারে যে বইমেলা, তার দিকে কর্তৃপক্ষের (বাংলা একাডেমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পুলিশ প্রশাসন) কি একটু বিশেষ নজর দেওয়া উচিত না? এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন লেখকের রক্তেই তো বইমেলার রাস্তা ভিজেছে। সুতরাং বাংলা একাডেমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের যৌথ সহযোগিতায়, পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতায় বইমেলা প্রাঙ্গণে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করা উচিত। দেশের প্রতিটি নাগরিকের জীবনই মূল্যবান। আর লেখকদের প্রসঙ্গ এলে বলতে হয়, একজন মেধাবী লেখক পৃথিবী থেকে চলে গেলে সহসাই কি আরেকজন লেখক সৃষ্টি হওয়া সম্ভব?

বইমেলায় চাই সব পাঠকের জন্য মানসম্মত বই। বইমেলা শুরু হওয়ার পর অনেকের মুখেই বলতে শুনি, ‘বেশির ভাগ বই নাকি দু-এক পাতার বেশি পড়া যায় না।’ এ দায় তাহলে কার? পাঠক কি তবে নামচেনা লেখকদেরই বই পড়বে? লেখার হাত আছে এমন সবারই তো বই প্রকাশ করার অধিকার আছে। তবে তারই বা দোষ কি? লাইসেন্স নিয়ে নিশ্চয়ই লেখক হওয়া যায় না? তরুণ লেখকদের বিকাশ আর প্রসারের জন্য একাডেমি ও প্রকাশকদের এগিয়ে আসা উচিত। ভালো নতুন লেখক আর আসছে না—এসব কথা তরুণরা আর কত শুনবে? সে সঙ্গে লেখকের বই পাইরেসি হচ্ছে কি না, সে বিষয়টা প্রকাশকরা বিশেষ নজরদারিতে রাখতে পারেন।

আমাদের লেখক-পাঠক-প্রকাশকদের একটাই চাওয়া, ফেব্রুয়ারি মাসটা যেন পুরো বইমেলায় আমরা সবাই মুক্ত পাখির মতো ঘুরে বেড়াতে পারি। বিভিন্ন বইয়ের স্টল ঘুরে বেছে নিতে পারি বাংলাদেশের লেখকদের লেখা সেসব বই, যা আমাদের ভাবতে শেখাবে, আনন্দ দেবে আর মানুষ হতে শেখাবে। 

আমাদের মতো এত উদ্দীপনা নিয়ে কোনো দেশেই (কলকাতা, জার্মানি বা নিউইয়র্কে) বাংলা বইয়ের মেলা বসে না। সেসব জায়গায় মূলত বই বিকিকিনির বিষয়টাই প্রধান থাকে। কিন্তু আমাদের বইমেলার কনসেপ্ট যে অনেক বড়। বাংলা ভাষা ও ভালোবাসা দুটোয় এখানে মিশে আছে। এ বইমেলা যে অনেক লেখক-পাঠকেরই বুকের একটা বিশেষ স্থানে থাকে। এটাও অস্বীকার করা যায় না যে, আমাদের লেখকরা সারা বছরের চেয়ে বইমেলার সময়ই বই প্রকাশ করতে বেশি আগ্রহী। 

তাই প্রাণের বইমেলায় সবাইকে মেতে উঠতে হলে কর্তৃপক্ষের এখনই উচিত সামগ্রিক বিষয় সামনে নিয়ে অতীতের গাফিলতিগুলো শুধরে যথাযথ প্ল্যান করা। আমাদের বিশ্বাস (বিশ্বাসই জীবনের শক্তি, তাই না) সব অপশক্তিকে পরাজিত করে অবশ্যই প্রাণের বইমেলায় আমরা সবাই অংশগ্রহণ করতে পারব। কোনো বাধাই আমাদের উৎসবে অংশ নিতে পিছপা করতে পারবে না। ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা একাডেমির বইমেলা যে আমাদের অস্তিত্বের একটি অংশ হয়ে গেছে। অস্তিত্বের লড়াইয়ে সব বাধাকে সরিয়ে আমরা বাঙালিরা আগেও যেমন জিতেছি, এবারও জিতব এবং ভবিষ্যতেও...। 

জয় হোক বইমেলা-২০১৬।

লেখক : সহকারী পরিচালক, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন।