ক্রীড়া রাজনীতি : কোন পথে যাবে বাংলাদেশের ক্রিকেট?

Looks like you've blocked notifications!

ক্রিকেট নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের উত্তেজনার অন্ত নেই, এ তো জানা কথা। কিন্তু ব্যাট-বলের এই খেলাটা যে অনেক ক্ষমতাধরও, সেটা সম্প্রতি জানা গেল। এসএসসি পরীক্ষা, ইজতেমা, সাধারণ মানুষের নাজেহাল দশা; কোনোকিছুই টলাতে পারেনি আমাদের আপসহীন নেত্রীকে। হরতাল-অবরোধ অব্যাহত ছিল। কিন্তু হাজার হাজার মাইল দূরে মাশরাফি-সাকিবরা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একটা ম্যাচ জিতে সত্যিই স্বস্তি দিয়েছেন বাংলাদেশের মানুষকে। বাংলাদেশের কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত হওয়ার আনন্দে একদিনের জন্য হলেও হরতাল শিথিল করার ডাক এসেছে আন্দোলনরত ২০ দলের পক্ষ থেকে। ১৪ দলের সরকারি পক্ষ থেকেও এসেছে অনেক অনেক শুভেচ্ছাবার্তা, আর্থিক পুরস্কারের ঘোষণা।

তার মানে দেশের মানুষের শিক্ষাদীক্ষা, প্রথাগত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন, মানুষের রোজকার বাঁচা-মরার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের ক্রিকেট। এ কিন্তু অনেক বড় ব্যাপার একটা দেশের ক্রীড়াঙ্গনের জন্য। প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের ক্রিকেটারদের কাছে এটার গুরুত্ব কতটুকু? ক্রিকেটারদের সঙ্গে সমাজ-রাষ্ট্রের সম্পর্কই বা কী? আদৌ আছে কিনা?

ইতিহাস বলে সম্পর্ক আছে। ১৯৮০ সালের দিকে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলার মাধ্যম হিসেবে ফুটবল মাঠকেই বেছে নিয়েছিলেন ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবলার সক্রেটিস। করিন্থিয়ান ক্লাবের মাধ্যমে সংগঠিত করেছিলেন স্বৈরতন্ত্রবিরোধী পাটাতন। মানুষকে ভাবাতে শুরু করিয়েছিলেন যে তাদেরও বলার অনেক কিছু আছে। স্পেনে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে জোর আওয়াজ উঠত বার্সেলোনার ন্যু ক্যাম্প বা অ্যাথলেটিক বিলবাওয়ের সান মেমে স্টেডিয়ামে। নিজেদের স্বকীয়তা-স্বাধীনতার কথা জানান দেওয়ার জন্য ফুটবল ম্যাচগুলোই ছিল কাতালান-বাস্ক জাতিগোষ্ঠীর প্রধান মাধ্যম। খুব সাম্প্রতিককালেও আইভরি কোস্টের স্ট্রাইকার দিদিয়ের দ্রগবা অনেক লড়েছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য।

কোনো স্পোর্টিং ইভেন্ট যে সত্যিই একটা জাতীয় পরিস্থিতিতে প্রভাব ফেলতে পারে, তার বড় প্রমাণ ১৯৮৩ সালে ভারতের ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়। অনেকের মতেই, সেটা ছিল ভারতের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া একটা মুহূর্ত। ১৯৫৩ ও ৫৪ সালে দুটি ফুটবল ম্যাচের কারণে চূর্ণ হয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অহংকার আর নিপীড়িত মানুষের মনে জাগিয়েছিল স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন। হাঙ্গেরি ৬-৩ ও ৭-১ গোলের ব্যবধানে হারিয়েছিল ইংল্যান্ডকে। ১৯৫৬ সালের হাঙ্গেরিয়ান বিপ্লবের সঙ্গে এই ম্যাচ দুটির প্রত্যক্ষ যোগসূত্র ছিল বলেই দাবি করেছিলেন দেশটির প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক পিটার টিমার। ১৯৯৯ সালে তাঁর পরিচালিত ‘৩-৬’ সিনেমাটিতে দেখানো হয়েছিল, রেফারির শেষ বাঁশি বাজার পর রাজনৈতিক বন্দীদের সঙ্গে কোলাকুলি করে বিজয় উদযাপন করেছিলেন কারাগারের রক্ষীরা। দুই বছর পরে অনেকেই একজোট হয়ে লড়েছিলেন সোভিয়েত ট্যাংকের বিরুদ্ধে। খুঁজলে হয়তো এমন আরো অনেক কিছু পাওয়া যাবে।

আবার ঠিক উল্টোভাবে খেলাধুলা শাসকদের লাঠি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে যুগ যুগ ধরে। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়কে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার সুযোগ হিসেবে দেখেছিলেন দুই দেশের সামরিক জান্তারা। হিটলার জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য খেলাধুলাকে বেছে নিয়েছিলেন। স্পেনের জেনারেল ফ্রাঙ্কোও ফুটবলকে অনেকভাবে ব্যবহার করেছেন নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য। হাঙ্গেরি ও সোভিয়েত সরকারের কাছে খেলাধুলা, বিশেষত ফুটবলটা ছিল কমিউনিজমের আদর্শ প্রতিষ্ঠার লড়াই। হাঙ্গেরির জাতীয় দল ছিল পুরোপুরি সরকারের কর্তৃত্বাধীন। সে সময়ের কোচ গুসতাভ সেবেস বলেছিলেন, ‘পুঁজিবাদ ও কমিউনিজমের লড়াইটা শুধু আমাদের সমাজেই না, চালাতে হবে ফুটবল মাঠেও।’

তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এসে বিশাল মাপের বাণিজ্যক্ষেত্রেও পরিণত হয়েছে খেলাধুলা। বৈশ্বিক বাণিজ্যের কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। বাংলাদেশেও ক্রিকেটকে খুব সুচতুরভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে নিজেদের পণ্য বিকোনোর জন্য। ক্রিকেট দলকে অভিনন্দন জানানোর নাম করে অমুক বিজ্ঞাপন, তমুক বিজ্ঞাপন... এমনকি ৬৪ জেলায় কনসার্ট পর্যন্ত আয়োজন করা হয়। যেটা স্রেফ ব্যবসা ছাড়া আর কিছুই না। মূলধারার গণমাধ্যমের ভাষায়, ‘ক্রিকেটটা মানুষ খায়’, তাই ক্রিকেটের মোড়ক দিয়ে সাজিয়ে নানাবিধ পণ্য পাবলিককে খাওয়ানো যায় খুব সহজে। আবেগে গদগদ হয়ে আমরা খেতেও থাকি ভোগবাদের ‘সুগার কোটেড’ ট্যাবলেট।

সবকিছু শেষে প্রশ্ন হচ্ছে একটাই : আমরা কোনদিকে এগুবো??? বাংলাদেশের ক্রিকেট কি শাসকদের স্বৈরতন্ত্র জারি রাখার লাঠি হিসেবে ব্যবহার হবে? বেনিয়াদের ব্যবসাপাতির সামগ্রী হবে? নাকি সত্যিই মুক্তির স্বপ্ন দেখাবে মানুষকে?