ঢাকায় কেমন যাবে শ্রিংলার সময়কাল?

Looks like you've blocked notifications!

বাংলাদেশে নতুন ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা গত ১৪ জানুয়ারি ঢাকায় এসেছেন। তিনি পঙ্কজ শরণের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। পঙ্কজ শরণের পদায়ন ঘটেছে মস্কোয়। হাইকমিশনার বা রাষ্ট্রদূত এবং অন্য কূটনীতিকরা কয়েক বছর পর পর বদল হবেন, এটা সব রাষ্ট্রেরই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্বাভাবিক কাজ। বিশেষ কোনো কারণ না থাকলে স্বাভাবিক কাজকর্ম নিয়ে মন্তব্য করার প্রয়োজন পড়ে না। তবে বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনার পরিবর্তনের খবরটি স্বাভাবিক বিষয় হলেও গুরুত্বের দিক থেকে আলোচনার বিষয় বৈকি। তাই বাংলাদেশে ভারতের কোনো হাইকমিশনার এলো বা গেল, সেটা গণমাধ্যমগুলোর জন্যও এক ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ। এই গুরুত্বের গুরুগম্ভিরতা যত না ব্যক্তিকেন্দ্রিক, তার চেয়ে বেশি রাষ্ট্রকেন্দ্রিক। কেননা, ভারত বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী শুধু প্রতিবেশী রাষ্ট্রই নয়, আঞ্চলিক পরাশক্তিও বটে। বাংলাদেশের রাজনীতির গতিধারা যে অনেক ক্ষেত্রে ভারত প্রভাবিত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু ভারতের হাইকমিশনারদের প্রায় সবাই তাঁদের সময়ে বাংলাদেশে বেশ পরিচিত পেয়ে থাকেন, চলে যাওয়ার পরও অনেক দিনই তাঁদের নাম বা চেহারা আমরা মনে রাখি। পঙ্কজ শরণের আগের হাইকমিশনার বীণা সিক্রির নাম আজও সবার ভেতর অমলিন। বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোও ভারতীয় হাইকমিশনারের কভারেজ দিতে কৃপণতা করে না। শ্রিংলাকে আমরা এরই মধ্যে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে দেখেছি। গণমাধ্যমগুলো সে খবরও গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেছে। বাংলাদেশে অবস্থানকালে শ্রিংলার সময়কাল কেমন যাবে, তা আলোচনার আগে বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে শ্রিংলার ব্যক্তিগত প্রোফাইল তুলে ধরা প্রাসঙ্গিক বলে মনে করছি।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একজন চৌকস অফিসার হিসেবে শ্রিংলার খ্যাতি রয়েছে। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় শ্রিংলা ১৫তম স্থান অর্জন করে মেধার স্বাক্ষর রাখেন। শ্রিংলা বহুভাষী। তিনি নিজ দেশের হিন্দি, ইংরেজি ভাষা ছাড়াও ফ্রেঞ্চ ভালোভাবে শিখেছেন। পশ্চিমবঙ্গে দার্জিলিংয়ের অধিবাসী হওয়ায় বাংলা ভাষাও জানেন। ফ্রেঞ্চ জানার জন্য তিনি প্যারিসে দুই দফায় হাইকমিশন অফিসের দায়িত্ব পালন করেন। মাত্র ২৭ বছরেই ভারতের অন্যতম সর্বকনিষ্ঠ কনসাল জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পেয়ে আলোচনার পাত্র হয়েছিলেন। আশির দশকের শেষের ও নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন ও রূপান্তরের সময় শ্রিংলা হ্যানয় ও হো চি মিন সিটির উভয় স্থানেই দায়িত্ব পালন করেন। ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিশাল জনগোষ্ঠী দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাস করে। শ্রিংলা দক্ষিণ আফ্রিকায়ও দক্ষতার সঙ্গে কনসাল জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। সহস্রাব্দের সন্ধিক্ষণে ইসরায়েলে ভারতীয় মিশনের কাউন্সিলর ছিলেন তিনি। শ্রিংলার অন্যতম বিশেষ দিক হলো বহুপক্ষীয় কূটনীতি। চার বছরের বেশি সময় তিনি জাতিসংঘে ভারতীয় স্থায়ী মিশনে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে ভারতের সমালোচনা করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফর বক্তব্য দিয়েছিলেন। শ্রিংলা সে বক্তব্যের যথোপযুক্ত জবাব দিয়েছিলেন। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যপদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় ২০১০-১১ সালে তিনি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাতিসংঘ রাজনৈতিক বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর ফলেও এসেছিল বিরাট আকারে। ভারত সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল।

হর্ষবর্ধন শ্রিংলা ২০১১ থেকে ২০১৪ সালে প্রতিবেশী বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কবিষয়ক যুগ্ম সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ওই বছরগুলো এই চারটি দেশেই ছিল আলোড়নপূর্ণ সময়। মালদ্বীপবিষয়ক বিশেষ দূত হিসেবে তিনি মালেতে ভারতীয় হাইকমিশনে স্বেচ্ছায় আশ্রয় নেওয়া মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদকে পরবর্তী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাওয়ার আশ্বাসসহ মুক্ত করতে সফল হয়েছিলেন। নাশিদ পরবর্তী নির্বাচনে অংশও নিয়েছিলেন। বাংলাদেশ-ভারত সমুদ্রসীমা ও স্থলসীমা সমাধান, ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সঞ্চালন এবং ২০১০ সালে ১০০ কোটি ডলার ঋণ রেখার সফল বাস্তবায়নে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা ও যোগাযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন শ্রিংলা। থাইল্যান্ডে সামরিক অভ্যুত্থান সত্ত্বেও দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক নিশ্চিত রাখতে শ্রিংলা ভূমিকা রেখেছেন। ব্যক্তিগত সক্ষমতা দিয়েও তিনি ওই দেশটির সঙ্গে সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়েছেন।

সন্দেহ নেই, ঢাকায় অবস্থানকালে শ্রিংলাকে দায়িত্ব পালনে অনেক বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। স্বার্থগত দ্বন্দ্ব বা স্বার্থ উদ্ধারের জন্য বিশ্বরাজনীতিতে নিরন্তর অদল-বদল হচ্ছে। বারাক ওবামার ভারত সফরের পর পরই ঢাকায় নতুন নিয়োগ পাওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নয়া রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া বার্নিকাটের গরম সুর নরম হতে থাকে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের এই প্রচ্ছন্ন প্রভাব আরো বহুলাংশে বৃদ্ধির জন্য শ্রিংলা তাঁর কূটনীতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখবেন, সেটা বলা যায়। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদা অর্থনীতির ছাত্র শ্রিংলা ভারত-বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এবং পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞাত। তিনি এর আগে ১৫ বার বাংলাদেশ সফর করেছেন। এ অবস্থায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো থেকে শুরু করে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ কী চায়, তাও শ্রিংলাকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। দায়িত্ব পালনের শুরু থেকে শ্রিংলাকে তৎপর মনে হচ্ছে। তিনি বাংলাদেশে আসার আগে ব্যাংককে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাতে দুদেশের অঙ্গীকার বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় উন্নীত করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। শ্রিংলা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় ঘোষিত যৌথ বিবৃতি নতুন প্রজন্ম-নয়া দিশার আওতায় গৃহীত সিদ্ধান্ত ও চুক্তিগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেন।

ঢাকায় দায়িত্ব নেওয়ার পর তাঁর অগ্রাধিকারভিত্তিক কাজ বলতে বাংলাদেশের সহযোগীদের সঙ্গে একসঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের ভিত্তিতে দ্বিপক্ষীয় সহমতের ক্ষেত্রগুলো বাস্তবায়ন করা এবং এর মাধ্যমে দুদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে সর্বোচ্চ শিখরে উন্নীত করার কথা বলেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি আরো বলেছেন, প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর সম্পর্ক রচনায় ভারত-বাংলাদেশ এক আদর্শ উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে। তিনি সে চেষ্টাই করবেন।

সবশেষে বলা যায়, ঢাকায় শ্রিংলার অবস্থানকাল যদি একাদশ সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত গড়ায়, সে ক্ষেত্রে তাঁকে নির্বাচনকালীন সরকারের ধরন নিয়ে এক কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের অপরাপর দাতাদেশকেও দিল্লির মতামতের সঙ্গে সহমতে আনতে হবে। সন্দেহ নেই, কাজটি কঠিন। আর এটাই তো সত্য যে, কঠিন সময়েই কূটনৈতিক দক্ষতার আসল সময়।

লেখক : আহমেদ সুমন, গবেষক ও বিশ্লেষক।