পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় : স্বতন্ত্র পে-স্কেলের দাবি ও ফরাসউদ্দীনের প্রস্তাব

Looks like you've blocked notifications!

পে কমিশনের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দীন সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদোন্নতি ও অন্যান্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বেশ কিছু বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন। তাঁর কিছু মন্তব্য নেহাতই হাস্যকর এবং বাস্তবতার আলোকে পুরোপুরিই অসংলগ্ন। অনেকগুলোর মধ্যে দুটি মন্তব্য যথার্থই অসত্য। এক, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রভাষকের চেয়ে অধ্যাপকের ব্যাপকতা বেশি এবং দুই, পিএচডি নিয়ে যে প্রভাষক পদে চাকরি করতে হয় তা তাঁর জানা নেই।  

আসলে বেশিরভাগ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগেই অধ্যাপক মাত্র হাতেগোনা কয়েকজন; এমনকি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু বিভাগে মাত্র এক বা দুজন। আর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকই আছেন যাঁদের অনেককে নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করার পরও দীর্ঘদিন প্রভাষক হিসেবে চাকরি করতে হচ্ছে। ফরাসউদ্দীনের মতো আমরাও আর্শ্চয এবং লজ্জিত যদিও তা মেনে নিতে হচ্ছে। 

শুধু তা মেনে নিতেই নয় আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি সেদিন বেশি দূরে নয় যখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকতার জন্য, এমনকি প্রভাষক পদে শিক্ষকতার জন্য, পিএইচডি ডিগ্রি বাধ্যতামূলক হবে এবং তা হওয়াও উচিত। বিভাগগুলো থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়ার পরও যদি নিজেকে উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তির যোগ্য প্রমাণ না করা যায়, তাহলে বুঝতে হবে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়ার পেছনে অন্যকিছু লুকানো আছে। সে ক্ষেত্রে সেই ধরনের প্রার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ না পাওয়াটাই দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক। 

তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাঙ্কিং নির্ণয়ের ক্ষেত্রে কতভাগ শিক্ষক পিএইচডি ডিগ্রিধারী তা একটি অনেক বড় নির্ণায়ক। বিশ্বের প্রায় সব নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক পদে নিয়োগ পাওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা পিএইচডি; সুতরাং নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় আসতে হলে তা মেনে না নিয়ে অন্য কিছু প্র্যাকটিস করার সুযোগ খুবই সীমিত। 

ফরাসউদ্দীনের প্রভাষক অধ্যাপক অনুপাত নিয়ে শঙ্কার বিপরীতে যৌক্তিকতা আছে। প্রতিটি উন্নত দেশেই কিছু প্রথমসারির বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেখানে প্রভাষকের তুলনায় অধ্যাপক নেহাত কম নয়। আমাদের ক্ষেত্রেও তা খুব একটা ব্যতিক্রম নয়। মাত্র হাতেগোনা কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের ব্যাপকতা লক্ষণীয়। আমাদের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেই অধ্যাপকের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। যাহোক আমরা সরকার ও ফরাসউদ্দীনের চিন্তার আসল বিষয়বস্তু বুঝতে পারছি। 

গত কয়েক বছরে যেভাবে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে তাতে যদি অধ্যাপকের ব্যাপকতা প্রভাষকের ব্যাপকতাকে ছাড়িয়ে যায় এবং সরকারকে যদি মধ্যম আয়ের দেশের মতো স্বতন্ত্র স্কেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন দিতে হয় তাহলে সরকারের জন্য এটি একটি অনেক বড় ব্যয়সাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। তখন যদি অধ্যাপকরা মধ্যম আয়ের দেশের মতো বা নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের মতো গবেষণালব্ধ জ্ঞান সঞ্চালন করতে না পারেন তাহলে তা এক ধরনের বিলাসিতা হয়ে দাঁড়াবে। চিন্তাটি নিতান্তই যুক্তিহীন নয় তবে পুরোপুরি সত্যও নয়। সরকার ও ফরাসউদ্দীন বুঝতেই পারছেন যে বিশ্বে কোনো মধ্যম আয়ের দেশ নেই যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন সম্মানজনক নয়; সুতরাং বাস্তবিক অর্থেই মধ্যম আয়ের দেশ হতে হলে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর সূচনা করতে হবে; কিন্তু সরকার চাচ্ছে না  তা সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করেই চালু হোক। ফরাসউদ্দীনের মন্তব্য তাই স্পষ্ট করে দেয়। এ ব্যাপারটিই ফরাসউদ্দীন একটু ভিন্নভাবে ব্যক্ত করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুয়েটকে স্পেশাল স্ট্যাটাস দেওয়ার প্রস্তাবনার মধ্য দিয়ে। ধারণাটির মধ্যে কিছুটা যৌক্তিকতা আছে তবে তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুয়েটকে স্পেশাল স্ট্যাটাস দেওয়ার যে প্রস্তাবনা তিনি করেছেন ঠিক সেভাবে নয়। 

ফরাসউদ্দীনের প্রস্তাবনার সম্প্রসারিত রূপ হতে পারে এই যে, ঠিক আছে সরকার প্রথমবারের মতো ১০টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বতন্ত্র স্কেলের আওতায় এনে মধ্যম আয়ের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো সমপরিমাণ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করবে তবে তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুয়েট বলে কথা নয় বরং দেশের সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যে ১০টি নির্ণায়িত হবে কেবল সে ১০টির জন্যই তা প্রযোজ্য হবে; এবং তা প্রতি ৩-৪ বছর পরপর পুনর্নির্ণয় করা হবে। এতে সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতার সূচনা হবে এবং কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজেদের বি-ক্যাটাগরির ভাবার কোনো সুযোগ থাকবে না।

সুস্থ প্রতিযোগিতা ছাড়া বিশ্বে সুন্দর উদ্ভাবন কখনোই সম্ভব হয় না। উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালেও দেখা যাবে যে এ ধরনের প্রতিযোগিতার প্রচলন তাদের মধ্যে অনেকদিন আগে থেকেই চালু রয়েছে। বস্তুত অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজের জন্য সরকারি সহযোগিতা আর অন্যান্য বহু ছোটখাটো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সরকারি সহযোগিতার মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। তবে এ ফারাকের মূলে রয়েছে প্রতিযোগিতামূলক cutting-edge রিসার্চ। আমরা হয়তো  সহসাই cutting-edge পর্যায়ে পৌঁছাতে পারব না তবে সেরা ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় নির্ণয়ে সবচেয়ে বেশি weight দিতে হবে সেই আন্তর্জাতিক outlet গুলোতে প্রকাশনা( Springer, Elsevier, World Scientific, Taylor & Francis, John Wiley) যেখানার সাইটেশন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক রেটিং নির্ণয়ে প্রায় ২৫% weight বহন করে। প্রতি ৩-৪ বছর পরপর রিভিউ করে দেখা যেতে পারে যে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কোন ১০টি সেই আন্তর্জাতিক outlet গুলোতে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছে এবং সেই হিসাবে প্রথম সারির ১০টির নতুন তালিকা তৈরি করা যেতে পারে। দেশ যখন অর্থনৈতিকভাবে আরো উন্নতি সাধন করবে তখন ১০টি পরিবর্তে ১৫টিকে সে ধরনের ‘সহযোগিতা স্কিম’-এর আওতায় নিয়ে আসা যেতে পারে। এতে যে গুণগত পরিবর্তন সাধিত হবে তা হবে চমৎকার। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অধ্যাপক হয়ে যাওয়ার পর গবেষণা থেকে দূরে সরে যাওয়ার যে প্রবণতা তাতে ভাটা পড়বে। বরং ১০টির তালিকাতে থাকার জন্য অধ্যাপকরাই হবেন আন্তর্জাতিক মানের গবষেণার কাণ্ডারি। অন্য যে বিষয়টিও স্বাভাবিকভাবে নিশ্চিত হবে তা হলো সর্বোচ্চ যোগ্যতা সম্পন্নের নিয়োগ পাওয়ার পথ ত্বরান্নিত হওয়া। 

গত কয়েক দশকের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অবসান না হলেও তা  ক্রমহ্রাসমান পর্যায়ে নেমে আসবে; কারণ তখন বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারের মধ্যে যতটুকু স্বার্থসংশ্লিষ্টতা থাকবে তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রথম সারির ১০টিতে নিজের জায়গা করে নেওয়া। যেহেতু সব বিশ্ববিদ্যালয়ই দেখতে চাইবে যে কোন বিশ্ববিদ্যালয় কয়টি আন্তর্জাতিক outlet-এ প্রকাশনার জন্য প্রথম ১০টিতে স্থান পেল সুতরাং সরকারের পক্ষেও কোনো নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া সম্ভব হবে না। নিজের অবস্থান টিকিয়ে রাখার নিমিত্তেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপার্চায, প্রো-উপাচার্যরা সত্যিকারের academic শিক্ষকদের মূল্যায়ন করতে বাধ্য হবেন এবং ক্রমেই শিক্ষক রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা ও প্রভাববলয় সংকুচিত হয়ে আসবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সত্যিকারের বিশ্বমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার ব্যাপারেই সবচেয়ে বেশি মনোযোগী হবে। 

প্রধানমন্ত্রীর ৯১% বেতন বাড়ানোর পরও যখন তা দেশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সুযোগ সুবিধার আন্তর্জাতিক ক্রমে সর্বনিম্ন দেশগুলোর একটিতেই রেখে দেয় তখন বুঝতে হবে মধ্যম আয়ের দেশের বাস্তবতা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য এখনো সুদূর-প্রসারী। সে ক্ষেত্রে শিক্ষকদেরও বাস্তবভিত্তিক চিন্তা করার প্রয়োজন রয়েছে। সুতরাং হুবহু ফরাসউদ্দীন মডেল না হলেও এই সম্প্রসারিত ফরাসউদ্দীন মডেলটি হয়তো বরফ গলার তাপমাত্রা সঞ্চালন করতে পারবে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে জনাব ফরাসউদ্দীন তাঁর নিজের পেশার সহকর্মীদের আন্তর্জাতিকভাবে যোগ্য করার কী মডেল উপস্থাপন করেছেন?  সেখানে ব্যয়সংকোচনের কী ধারণা তাঁর মাথায় রয়েছে? উপসচিব, পদায়িত-সচিব ইত্যাদি পদের যে ব্যাপকতা তা কি তিনি স্বীকার করছেন না উপেক্ষা করে যাচ্ছেন? দলকানা থেকে অনেক ভালো কিছু প্রস্তাব করলেও তা উপেক্ষিত থেকেই যায়।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

sharif_math2000@yahoo.com