উচ্চশিক্ষায় বাংলা ভাষার প্রয়োগ

Looks like you've blocked notifications!

বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রচলিত প্রায় সাড়ে তিন হাজার ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষা অন্যতম স্থান অধিকার করে আছে। বাংলা ভাষা বাঙালি জাতির কাছে শুধু একটি ভাষাই নয়, এর সাথে মিশে আছে বাঙালি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সবকিছু। কেননা, এই বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বাঙালি জাতি। কালের পরিক্রমায় বাংলা ভাষার উদ্ভব। অধিকাংশ ভাষাতাত্ত্বিকের মতে গৌড়ী প্রাকৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে। কিন্তু ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে গৌড়ী প্রাকৃতের পরবর্তী স্তর গৌড় অপভ্রংশ থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি। ইতিহাস থেকে জানা যায় বাংলা ভাষা প্রায় ১৫০০ বছর পথ অতিক্রম করে আজকের এই আধুনিক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। প্রাচীন কালের বাংলা সাহিত্যেও নিদর্শনস্বরূপ চর্যাপদ, মধ্যযুগে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গলসহ নানা সাহিত্যকর্ম দেখতে পাই।

পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, উইলিয়াম কেরী, প্রমথ চৌধুরীসহ খ্যাতনামা সাহিত্যিক, লেখক ও কবির কৃতিত্ব, প্রচেষ্টা ও অসামান্য অবদান বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। বিশ্ব সাহিত্যর ভাণ্ডারে বাংলা ভাষা এবং বাঙালি জাতি এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। কেননা সারা পৃথিবীতে বাঙালি একমাত্র জাতি যাঁরা বাংলা ভাষার জন্য জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পশ্চিম পাকিস্থান পূর্বপাকিস্তানের ওপর যে অত্যাচারের খড়গ চালায় তার প্রথম আঘাত আসে বাংলা ভাষার ওপর। তৎকালীন পাকিস্তানের গভর্ণর ঘোষণা করেন উর্দূ-উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-শিক্ষক, জনতা সম্মিলিতভাবে এই অন্যায় দাবির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিলে অংশগ্রহণ করে ভাষার জন্য জীবন বিসর্জন দেয়। এরই স্বীকৃতিসরূপ ১৯৯৯ সালে ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুরারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ফলশ্রুতিতে ২০০০ সাল থেকে পৃথিবীর প্রায় সব স্বাধীন দেশ ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপন করে আসছে।

পরিতাপের বিষয়, যে ভাষার জন্য বাঙালি জাতি আজ গোটা বিশ্বে এক বিশেষ মর্যাদায় আসীন, উচ্চ শিক্ষার সব ক্ষেত্রে সে বাংলা ভাষার প্রয়োগ নেই। বর্তমানে বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ভাষার ব্যাপক ব্যবহার দেখতে পাই।

শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি হওয়ার ফলে শির্ক্ষার্থীদের মাঝে না বুঝেই মুখস্থ করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এর ফলে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্যে ব্যহত হচ্ছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজির ব্যবহার আরো বেশি হয়ে থাকে। যদিও এসব বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ইংরেজির মান নিয়ে যথেষ্ঠ বিতর্ক রয়েছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত বেশির ভাগ শিক্ষার্থী বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করে আসার পর হঠাৎ করেই উচ্চ শিক্ষায় ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করতে বাধ্য হলেও তাদের আত্মস্থ করা, চিন্তা করা ও  মনে রাখার প্রক্রিয়াটি বাংলাতেই হয়ে থাকে। এতে শিক্ষার্থীরা না শিখছে বাংলা  না ইংরেজি। স্বাধীনতার পর দেশে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম বাংলা করা হয়। কিন্তু নিদেনপক্ষে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ আমরা কমই দেখতে পাই। অথচ প্রচলিত শিক্ষানীতিতে উচ্চ শিক্ষায় আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে সব ডিগ্রি কোর্স পর্যায়ে ১০০ নম্বরের ইংরেজি বিষয় সব শিক্ষার্থীর জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু উচ্চ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়নি। অনেকে এই সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে বলেন উচ্চশিক্ষায় বাংলায় ভালো কোনো বইপত্র পাওয়া যায় না। কিছু বইপত্র পাওয়া গেলেও তা দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য সহায়ক নয়। এ ছাড়া অনেকে বলেন বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার অপ্রতূল্ যার জন্য বাংলা মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা লাভ করা সম্ভব নয়।

ইতিহাস থেকে জানা যায় মাতৃভাষার  গুরুত্ব যাদের কাছে যত বেশি সে জাতি উন্নয়নের ধারায় তত বেশি অগ্রশীল। বর্তমানে চীন, জাপান, রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তারা নিজেদের জ্ঞান চর্চার মাধ্যমেই উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করেছে। বাস্তবিক পক্ষে বাংলা ভাষার যেভাবে মূল্যায়ন দরকার বাংলাদেশ সেক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। ফলে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক উন্নয়ন সেভাবে পরিলক্ষিত হয়নি। এর পাশাপাশি বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে অন্যদের সাথে টিকে থাকতে হলে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার অব্যশই মাথায় রাখতে হবে। যেহেতু সারা বিশ্বে ইংরেজি ভাষার প্রচলনই সব থেকে বেশি এবং তাদের অর্থনৈতিক অবস্থানের কারণে তারা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে সেহেতু একটি ভালো চাকরি, কর্মসংস্থান যাই বলি না কেন তা অনেকাংশে নির্ভর করে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার ওপর। কিন্তু আমাদের এ কথা ভূলে গেলে চলবে না সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কারণে যখন কোনো জাতি তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি বিসর্জন দেয় তখন তারা তাদের নিজস্ব জাতিসত্তা হারিয়ে ফেলে। উদাহরণস্বরূপ প্রাচীন মিসর থেকে শুরু করে হালের জিম্বাবুয়ে।

উচ্চশিক্ষায় বাংলা ভাষার প্রয়োগ সম্পর্কে বলতে গিয়ে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দ্বীপা, মুক্তা ও খুশি বলেন বাংলা যেহেতু আমাদের মায়ের ভাষা তাই উচ্চ শিক্ষায় এ ভাষার ব্যবহার থাকলে আমরা আরো ভালোভাবে তা অনুধাবন করতে পারব।

বাংলাদেশের সংবিধানে ৩নং অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলার কথা বলা থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ না আছে উচ্চ শিক্ষায় না উচ্চ আদালতে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন এখনকার প্রজন্ম, মুখস্থবিদ্যার ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। বাংলাকে অগ্রাহ্য করার প্রবণতার ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার পিছিয়ে গেছে।

উচ্চ শিক্ষায় বাংলা ভাষার প্রয়োগ বাড়ানোর জন্য নিম্নরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে : এক. জাতীয় শিক্ষানীতিতে বাংলাকে উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারে বাধ্যতামূলককরণ, দুই. বাংলা শব্দভাণ্ডার উন্নত করা, তিন. উচ্চ শিক্ষায় প্রয়োজনীয় গ্রন্থগুলোর বাংলায় অনুবাদের ব্যবস্থা গ্রহণ, চার. বাংলা ভাষার জন্য গবেষণাকেন্দ্রের সক্রিয় ভূমিকা ও কার্যক্রম, পাঁচ. বাংলা ভাষার শৈল্পিক, ব্যাকরণিক এবং লিখিত রূপের সহজবোধ্যতা আনয়ন, ছয়. বাংলা ভাষার ঐতিহাসিক গুরুত্ব জাতিসংঘ কর্তৃক অন্যতম ভাষার স্বীকৃতির জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা প্রয়োজন, সাত. সর্বস্তরে নির্ভুল ও গ্রহণযোগ্য বাংলা ভাষার প্রচলন, আট. বাংলা ভাষার গুরুত্ব বোঝাতে সবার মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধিকরণ, নয়. বাংলা সংস্করণে বেশি বেশি কম্পিউটার সফটওয়্যার তৈরি করা। 

দুর্ভাগ্যের বিষয় বাংলা ভাষা আন্দোলনের ৬৪ বছর এবং স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর এসেও এখনো আমাদের সর্বক্ষেত্রে মাতৃভাষার সম্মানজনক আসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। বাংলা ভাষাকে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে প্রচলনের মধ্যেই নিহিত রয়েছে আমাদের অহংকার ও ঐতিহ্য। যে ভাষার জন্য এত আত্মত্যাগ সে ভাষাকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করতে নব্য-সাম্রাজ্যবাদের এ যুগে উচ্চশিক্ষায় বাংলা প্রয়োগের চ্যালেঞ্জ পারবে কি বাঙালি জাতি মোকাবিলা করতে?

লেখক : মো. মোরশেদ আলী ও মো. মাহাবুব চৌধুরী, শিক্ষার্থী, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।