ক্রিকেটারের বিদায়

শেষ ইনিংসে অপরাজিত ছিলেন মার্টিন ক্রো

Looks like you've blocked notifications!

জীবনের বাইশ গজে লড়াইটা চলছিল তাঁর ক্যানসারের সঙ্গে। এবং লম্বা একটা সময় ধরে। একপর্যায়ে নিজেও জেনে গিয়েছিলেন, যেকোনো সময় ফিরতে হবে জীবনের অন্য প্রান্তের প্যাভিলিয়নে। ব্যাট হাতে নিউজিল্যান্ডকে যিনি জিতিয়েছেন অনেক ম্যাচ। খেলেছেন অনেক লম্বা ইনিংস। অথচ হাফ সেঞ্চুরি পার করার অল্প কিছুদিন পরই থেমে গেল তাঁর জীবনের ইনিংস!

ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত হেরেই গেলেন মার্টিন 'গ্রেট' ক্রো! ঠিক এক বছর আগে অকল্যান্ডের ইডেন পার্কে এবং তাঁর বাড়িতে বসে মার্টিনের সঙ্গে কথা বলেছিলেন ক্রীড়া সাংবাদিক অঘোর মণ্ডল। মার্টিন ক্রোর জীবন, ক্রিকেট, অনেক কিছু নিয়ে কথা বলেছিলেন তিনি। লিখেছিলেন বেশ কিছু লেখা। নিউজিল্যান্ডের সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যানকে নিয়ে একটা লেখা ছাপা হয়েছে অঘোর মণ্ডলের সব শেষ বই 'এক্সট্রা কাভার'-এ। সদ্য প্রয়াত মার্টিন ক্রোর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক্সট্রা কাভার থেকে তুলে ধরা হলো তাঁকে নিয়ে লেখার অংশবিশেষ।

গোধূলি বেলায় মার্টিন ক্রো

ইডেন পার্কের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক চল্লিশ বছরের মতো। সেই ইডেন পার্কে এসেছিলেন তিনি আইসিসির ‘হল অব ফেম’-এর পুরস্কার নিতে। কিন্তু এই তিনি কি সেই মার্টিন ক্রো, একসময় যাঁকে সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে মেনে নিতে ক্রিকেটবিশ্বের দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি। ইমরান-কপিল-বোথাম থেকে ওয়াসিম আকরাম—এখনো যাঁরা ক্রিকেট আড্ডায় বলেন, মার্টিনকে বল করার কাজটা কখনোই সহজ ছিল না; সেটা নিউজিল্যান্ডের মাটিতে হোক কিংবা বাইরে কোথাও হোক। মার্টিন ক্রো উইকেটে থাকা মানে ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের আশা বেঁচে থাকা।

কিন্তু ক্রিকেটোত্তর জীবনে সেই লোকটার এখন বেঁচে থাকাটা প্রায় দুরাশা। যেকোনো সময় শোনা যেতে পারে জীবনের বাইশ গজে রানআউট হয়ে গেছেন মার্টিন ক্রো! নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট মহল বলুন, তাঁর পরিবার বলুন, সবাই যেন মানসিকভাবে প্রস্তুত ও রকম কিছু শোনার জন্য। কারণ, তাঁরা সবাই জানেন, ক্রোর জীবনে এখন একটাই সত্য—মৃত্যু! একসময় স্কাই স্পোর্টসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন মার্টিন ক্রো।

ইডেন পার্কের প্রেস বক্সে বসে সেই স্কাই স্পোর্টসের এক রিপোর্টারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, মার্টিন ক্রোর সঙ্গে কথা বলা যাবে কি না। ড্যানিয়েল রজার্সের প্রথম জিজ্ঞাসা, কী নিয়ে কথা বলবে? ক্রিকেট! না, তিনি খুব একটা কথা বলেন না। বাড়ি থেকেও বের হন না। হি ইজ নট ওয়েল! কেন তিনি ভালো নেই, সেটা আগেই জানা ছিল। ক্যানসার বাসা বেঁধেছে তাঁর শরীরে। সব চিকিৎসাই মোটামুটি ব্যর্থ বলা যায়। অ্যাডভান্স লিমফোমায় আক্রান্ত তিনি। মাত্র ৫৩ বছর বয়সেই ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছেন মৃত্যুর দিকে। সবকিছু জেনেশুনেও প্রেসবক্সের উল্টো দিকে আইসিসি বক্সে পৌঁছেছিলাম অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে। কিন্তু সেখানে যে ক্রোকে দেখলাম, তাতে বুঝতে অসুবিধা হলো না, এই লোকটার সঙ্গে কথা বলা মানে তাঁর শারীরিক আর মানসিক যন্ত্রণা বাড়িয়ে দেওয়া।

জীবনের কাছে ক্রিকেট খুব বড় কোনো বিষয় হতে পারে না। এই লোকটার জীবনের ইনিংস থেমে যাওয়ার পথে। এখানে রিভিউ সিস্টেম কাজ করছে না। থার্ড আম্পায়ার বলতে ‘ঈশ্বর’ যদি তাঁকে কিছুটা বেনিফিট অব ডাউট দেন, তাতেও তাঁর জীবনের ইনিংস খুব লম্বা হবে এমন আশা করা লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। এই লোকটার কাছে তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ার, বিশ্বকাপ এসব নিয়ে কথা বলা মানে সৌজন্যের সীমানা পেরিয়ে যাওয়া। কিন্তু সেটা কি সম্ভব! ‘হ্যালো’ বলে নিজের পরিচয় দিতে মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করলেন ক্রো অনেক কষ্টে! সেটাকে বলা যেতে পারে বিষণ্ণতা মেশানো হাসি! যা মিলিয়ে যেতেও খুব একটা সময় লাগেনি। স্মৃতির ইনবক্সে ক্লিক করতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল একসময় স্টার-ইএসপিএনে দেখানো একটা প্রোমো। ক্রিকেটের ফানি মোমেন্টসে হাস্যোজ্জ্বল এক মার্টিন ক্রো। মুক্তাঝরা হাসি ছড়ানো এক মুখ। কোনোভাবেই মেলানো যাচ্ছিল না সেই মুখের সঙ্গে বিষণ্ণতায় ভরা এই মুখটাকে!

কিন্তু তাঁকে আরো বেশি বিষণ্ণ লাগল যখন, ইডেন পার্কের বাউন্ডারি লাইনের কাছে দাঁড়িয়ে আইসিসির ‘হল অব ফেম’-এর অ্যাওয়ার্ড হিসেবে ক্যাপটা নিলেন! কেমো নিতে নিতে মাথায় একটা চুলও নেই। শরীরও বেশ খানিকটা ভেঙে গেছে। কথা বলতে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, তা-ও মনে হলো না। তবু কিছু বলতেই হলো। চল্লিশ হাজার দর্শকের সামনে দাঁড়িয়ে কেন, মার্টিন ক্রো নব্বই হাজার দর্শকের সামনে দাঁড়িয়েও কথা বলেছেন। কিন্তু এবার তিনি নার্ভাস। ভীষণ নার্ভাস। ক্লান্তি ভর করেছে তাঁর শরীরে। কথা বলা তাই কঠিন। তবু থেমে থেমে কয়েকটা বাক্য বললেন। হয়তো কষ্ট করেই বললেন। ‘তৃতীয় নিউজিল্যান্ডার হিসেবে আইসিসির হল অব ফেমে জায়গা পেয়ে আমি গর্বিত। আমি গর্বিত আমার বন্ধু রিচার্ড হ্যাডলির পাশে নিজের নাম দেখে। তবে আরেকটু বেশি গর্বিত নিউজিল্যান্ডের প্রথম নর্দার্ন আইল্যান্ডার হিসেবে এই পুরস্কার পেয়ে।’ পরিতৃপ্তি মেশানো বাক্য। কিন্তু বলার সময় মুখের অভিব্যক্তিতে যে বিষণ্ণতা! হ্যাডলি, ক্রো ছাড়া নিউজিল্যান্ড নারী ক্রিকেট দলের সাবেক সদস্য ডেভিড হকলি পেয়েছেন এই পুরস্কার।

মার্টিন ক্রো যখন পুরস্কারটা নিচ্ছিলেন, তখন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দুর্দান্ত পারফর্ম করছিলেন নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটাররা। সেটা দেখে অবশ্যই উচ্ছ্বসিত ছিলেন মার্টিন ক্রো। কিন্তু সেই উচ্ছ্বাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো তাঁর জন্য কঠিন ছিল। তবু বললেন, ‘আমি নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটকে ভালোবাসি। আজ হচ্ছে সেই দিন, যাকে বলব, ডে টু বিলিভ।’ নিউজিল্যান্ডের হয়ে খেলতে পারা তাঁর জীবনের বড় এক সফলতা। তাই ধন্যবাদ জানালেন নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটকে। কৃতজ্ঞতা জানালেন মা-বাবার প্রতি। কৃতজ্ঞতা জানালেন নিউজিল্যান্ডের মানুষের প্রতি। যাঁদের ভালোবাসায় ধন্য হয়েছেন তিনি। মার্টিন ক্রো নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের সেই প্রজন্মের ক্রিকেটার, যে সময়টা নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।

মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত মার্টিন ক্রোর ক্রিকেট ক্যারিয়ার ছিল বর্ণিল। বিশ্বকাপ এলে ক্রোর কথা মনে করতেই হবে। রঙিন পোশাক আর সাদা বলের প্রথম বিশ্বকাপ হয়েছিল ’৯২-এ অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে। সে সময় নিউজিল্যান্ড দলের অধিনায়ক ছিলেন মার্টিন ক্রো। ওয়ানডে ক্রিকেটে একটা বিপ্লবও ছিল তাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত, মার্ক গ্রেট ব্যাচকে দিয়ে ইনিংস ওপেন করানো। ‘পিঞ্চ হিটিং’ শব্দটাকেও ক্রিকেটবিশ্বে পরিচিত করা। এর পাশাপাশি দীপক প্যাটেল নামে এক অফস্পিনারের হাতে নতুন বল তুলে দেওয়া। সবই ছিল মার্টিন ক্রোর ক্রিকেটীয় চিন্তার ফসল। সে সঙ্গে তিনি নিজেও ছিলেন দুর্দান্ত ফর্মে। একাই টেনে নিয়েছিলেন নিউজিল্যান্ডকে সেমিফাইনাল পর্যন্ত। এর পর এই ইডেন পার্কেই তাঁর স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছিল ইমরান খানের পাকিস্তানের সামনে পড়ে। আরো পরিষ্কার করে বললে, বলতে হবে ইনজামাম-উল-হক নামের এক তরুণের অবিশ্বাস্য ব্যাটিংয়ের কারণে। নিজের সেই স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু অন্যান্য নিউজিল্যান্ডবাসীর মতো তিনিও বিশ্বাস করেছিলেন, নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপ জিততে পারবে। যদিও ক্রিকেট-বিশ্লেষক হিসেবে তিনি কাপ জয়ের সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা দেখেছিলেন সাউথ আফ্রিকার। ক্রোর জীবনের পড়ন্ত বেলায়ও আবেগ আর যুক্তির কি অদ্ভুত লুকোচুরি!

মার্টিন ক্রো নিজেও জানেন, তিনি জীবনের গোধূলি বেলায় দাঁড়িয়ে! যেখানে রং নেই; নেই কোনো রংধনু। সবকিছুই যেন ধূসর। আর সেটা উপলব্ধি করেই কি ইডেন পার্কে এসেছিলেন মার্টিন ক্রো ধূসর রঙের স্যুট-টাই পরে! ধূসরই কি তাঁর কাছে এখন প্রিয় রং!

কিন্তু জীবনের ধূসর গোধূলি বেলায় দাঁড়িয়েও কিছুদিন আগে তিনি রাঙিয়ে দিতে চেয়েছিলেন ক্রিকেটকে! শরীরের এ অবস্থায়ও ব্যাট করতে নেমেছিলেন। তাঁর স্থানীয় ক্লাব কর্নওয়েলের হয়ে একটা টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ব্যাট করেছেন। ২০ বলে অপরাজিত ছিলেন ২৫ রানে। ওটাই তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংস। সেখানে অপরাজিত থাকলেন। কিন্তু জীবনের ইনিংসে তিনি এখন এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে, যেটা বুঝতে হলে থার্ড আম্পায়ারের মতো বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে দেখতে হবে একেকটা ফ্রেম, তা-ও স্লো মেশানো। তার পর সিদ্ধান্ত। জীবনের বাইশ গজে থাকবেন। নাকি অন্য প্রান্তের প্যাভিলিয়নের দিকে পা বাড়াবেন খুব দ্রুত। মার্টিন ক্রোর কথা দিয়েই শেষ করতে চাইছি লেখাটা—‘ডে টু বিলিভ’। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, মার্টিন আপনি যেখানেই থাকবেন ভালো থাকবেন।

লেখক : ক্রীড়া সম্পাদক, দীপ্ত টিভি।