২৫ মার্চের কালরাত্রি ও আজকের আমরা

Looks like you've blocked notifications!

আজ ভয়াল ২৫ মার্চ। ১৯৭১ সালের এ দিনে আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ দিনে বাঙালি জাতির জীবনে এক ভয়াবহ রাত নেমে আসে। মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন বলেন এ রাতে প্রায় সাত হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়।

গ্রেপ্তার করা হয় আরো তিন হাজার লোককে। মানুষের ঘরবাড়ি নির্বিচারে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। রাস্তায় রাস্তায় মানুষের মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত করা হয়েছিল সেদিন। সারা দেশ হয়ে উঠেছিলোএক শকুনতাড়িত শশ্মানভূমি। সেনা অভিযানের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেপ্তারের আগে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যেকোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আমরা ফিরে পাই স্বাধীন বাংলাদেশ।

তবে আজ ৪৫ বছর পরও মনে হয় কালো রাত্রির অমানিশা এখনো কাটেনি। অসহ্য কালো রাত বারবার ফিরে আসে। অমানিশার করাল গ্রাসে আচ্ছাদিত আমার বাংলা। স্বাধীন বাংলার পরাধীন একপাল ডানাকাটা রক্তাক্ত পায়রা আমরা।

নব্য সাম্রাজ্যবাদের করাল থাবা আমার দেশের সংস্কৃতি থেকে শুরু করে খেলার মাঠ সব জায়গায় বিস্তার ঘটাচ্ছে। আমার দেশের ছেলেমেয়ে ছোটবেলায় বাংলা না শিখে হিন্দি বা ইংরেজি বলতে শিখছে। আমার দেশের ক্রিকেট দলকে চক্রান্তের ফাঁদে পড়ে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও হারতে হয়। তবু বাংলার দামাল  ছেলেমেয়েরা দেশের জন্য লড়ছে।

কিন্তু কতিপয় মানুষের দুমড়ে পড়া জাতিসত্তা, ক্ষয়িষ্ণু নৈতিকতা, কলুষিত মূল্যবোধের ভার বইছি আমরা। একটার পর একটা দুর্ঘটনা চাপা দিয়ে দিচ্ছে আরেকটা দুর্ঘটনাকে। ভাবছি, কষ্ট পাচ্ছি, লিখছি আবার পরমুহূর্তে ভুলে যাচ্ছি।

প্রতিটি রাত্রিই যেন হয়ে উঠছে নতুন কোনো ঘটনার কালো রাত্রি। আজ সন্তান মাকে মেরে ফেলছে, মা সন্তানকে মেরে ফেলছে, সত্য গুমরে কাঁদছে দৃশ্যমান ঘটনার অন্তরালে। মুক্তবুদ্ধিচর্চায় নিয়োজিত মানুষগুলোকে একের পর এক মেরে ফেলা হচ্ছে ধর্মের দোহাই দিয়ে।

দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছে, বিচার পাচ্ছে না কেউ। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে আছে বিচারব্যবস্থা। বিচারের বাইরে থেকে যাচ্ছে ক্ষমতাশীল অপরাধী চক্র যারা হাসছে জয়ের হাসি। আমাদের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা চার দেয়ালের চৌকাঠে বন্দি।

আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা চুরি হয়ে যাচ্ছে, আমাদের বোন তনুকে পৈশাচিকভাবে নির্যাতিত হতে হয়েছে, আর ধর্ষিত হওয়ার পরেও আমার দেশের পুরুষতান্ত্রিক কাঠগড়ায় মৃত্যুর পরেও তাকে শালীনতার পরীক্ষা দিতে হচ্ছে! সে হিজাবি না আধুনিক? সে শালীন না অশালীন? সেই মানদণ্ডে তাকে ধর্ষণের যৌক্তিকতা দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি আমরা। ‘ধিক তাদের শতধিক নির্লজ্জ যে জন’ - কারা আমরা? মুক্তিযোদ্ধারা কি এই বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করেছিল? কারা এরা? কাদের অদৃশ্য হাত তনুকে এরকম বীভৎস মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়? হ্যাঁ আমরা জানি, বুঝি, তবুও চুপ করে থাকি।

আমাদের নিশ্চুপ অবস্থান ধর্ষকদের সাহস জোগায়, উৎসাহ দেয়, কোমর বেঁধে আবারও আরেক গোষ্ঠী নেমে পড়ে ধর্ষণের পৈশাচিক আনন্দে। কারণ অপরাধীরা ক্ষমতাশালী, আনন্দ খুঁজে পায় পৈশাচিকতায়, ফাঁক খোঁজে বিচারব্যবস্থায়, আর পার পেয়ে যায় বারবার, হাসে নৃশংস হাসি।

এ হাসির সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজে পাই ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের পাক বাহিনীর হাসির। সর্বত্র পাচ্ছি অপরাধীদের পায়ের আওয়াজ। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধের ফসল এ বাংলাদেশ, আমার সোনার বাংলা। আর এ বাংলায় এ রকম একের পর এক ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ড বারবার মনে করিয়ে দেয় ২৫ মার্চের কালরাতের কথা।

অথচ এই নারীরাই যদি বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায় বা উপযুক্ত পদক্ষেপ যদি এদের জন্য নেওয়া যায় তবে এরাই হয়ে উঠতে পারে মাবিয়া আক্তার সীমান্ত। যার দেশপ্রেমে জাতীয় সংগীতের তালে তালে অঝোর ধারায় আনন্দ অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ে। আবেগি হয়ে পড়ি আমরাও।

প্রতিদিন সংবাদের পাতায় বাঙালির নতুন করে আবিষ্কারের ঘটনা আনন্দ দেয় সবাইকেই। অদম্য সাহসী নারী ওয়াসফিয়া নাজরীন সাত মহাদেশের সাতটি সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ জয় করেছেন। তাঁকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত হই আমরা।

নারী ক্রিকেট দলের খেলা দেখছিলাম গতকাল। দলের ক্যাপ্টেন জাহানারা তাঁর দৃঢ়প্রত্যয়ী মনোভাবে যখন প্রতি বলের সদুত্তর দিয়ে দেন, গর্বে বুক ভরে যায়। স্বাধীনতার এ ৪৫ বছরে অর্জন আমাদের কম নয়। তবে এ অর্জনের ভিড়ে তনুর মতো আরো অনেকের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অন্যায় আমাদের গুটিয়ে দেয়, চিন্তার জগৎকে দুঃখের কালো ছায়া আচ্ছাদিত করে, ম্লান করে দেয় অসংখ্য পাওয়াকে নিমিষেই।

তাই আজ বাংলাদেশে একটাই চাওয়া, ২৫ মার্চের এই কালরাত্রিতে আলোর দীপশিখায় মুছে যাক সকল অস্পৃশ্য কালো ছায়া, সকল অপরাধীর শাস্তি হোক, শুভ চিন্তার উদয় হোক সকলের মনে, ন্যায়পরায়ণতার পক্ষে সকলে গ্রহণ করি সৌহার্দ্যবোধের অঙ্গীকার। 

সবাই মিলে একসঙ্গে গাই, ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও, আপনাকে এই লুকিয়ে-রাখা ঢুলার ধাকা ঢুইয়ে দাও’।

লেখক: শিক্ষক, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।