ক্রিকেট

জাতীয়তাবাদ, অনলাইন টিআরপি ও প্রপাগান্ডার রাজনীতি

Looks like you've blocked notifications!

বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদ একটা অমীমাংসিত ব্যাপার এখনো। রাজনৈতিক এই টার্মটা দুটি বলয়ে বিভক্ত হয়ে গেছে। বাঙালি (ঐতিহ্যিক) ও বাংলাদেশি (ভৌগোলিক) জাতীয়তাবাদ। রাজনৈতিক সরকার বদলের হাত ধরে রাষ্ট্রে জাতীয়তাবাদের রূপ বদলে যায়; কখনো সংবিধান কাটাছেঁড়া হয়। যে দল ক্ষমতায় যায়, সে তার পলিটিক্যাল ইডিওলজি অনুযায়ী জাতীয়তাবাদের রূপরেখা প্রণয়ন করে। 

আদতে, সংবিধানের চারটি মূল স্তম্ভ- বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা- গভীরভাবে দেখলে একটা জায়গায় গিয়ে একে অপরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এসব সংঘর্ষ নিয়েই আমরা চলছি। তবে, এগুলোর মধ্যে জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা বড় সাংঘর্ষিক অবস্থান তৈরি করে বসে আছে! 

ধর্ম নিজেও জাতীয়তাবাদ প্রকাশের একটা মাধ্যম। কিংবা জাতীয়তাবাদের অংশ। বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় জাতীয়তবাদকে প্রকাশের ক্ষেত্রে এটাই মূল ভিত্তি বা অংশ। বাংলাদেশেও ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় গেলে সেই চিত্রটা দেখা যাবে না কিংবা তারা ক্ষমতায় না এসেও তাদের উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না- সেটা জোর গলায় বলা যাচ্ছে না।  

আমাদের লক্ষ্য সেদিকগুলো বিশ্লেষণ নয় বলে এটুকু বলেই ক্ষান্ত দিতে হচ্ছে। আমরা শুধু বলতে পারি, স্বাধীন হওয়ার ৪৫ বছর পেরুলেও বাংলাদেশ দলবাজির ঊর্ধ্বে উঠে একটা মীমাংসিত ও স্থির জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি। 

ঠিক এ কারণেই, এই ভগ্ন-ভঙ্গুর জাতীয়তাবাদের কারণেই, আমার মতে, বাংলাদেশের মানুষের জাতীয়তাবাদ প্রকাশের আচরণগুলো অত্যন্ত অসুস্থ ও রুগ্ন। অপরিপক্ব। অস্থিতিস্থাপক। অসহিষ্ণু। সর্বোপরি, অবশ্যই উগ্র। সেটা এমনই যে, এই ভুখণ্ডের মধ্যেই, নিজেরাই নিজেদের ওপর সেসব ফলাতে আমরা নোংরামির পরিচয় দিই। আর বাইরের দেশ বা জাতি বা মানুষের ক্ষেত্রে সেটা হলে তো কথাই নেই!  

২.
আজকাল উগ্র জাতীয়তাবাদী চেহারা প্রদর্শনে আমাদের প্রধান বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে ক্রিকেট। 

আচ্ছা ঠিক আছে, বুঝে নিলাম যে ক্রিকেটে আমরা ঘুমাই, ক্রিকেটে খাই, ক্রিকেটে শুই। ক্রিকেট আমাদের রক্তে মিশে গেছে। ক্রিকেটে এখন চাকচিক্য আছে। মাঠেও আছে, গ্যালারিতেও আছে। সুতরাং, ক্রিকেট নিয়ে দু-চার কথা বলাটা একটা ফ্যাশনও হয়ে গেছে। তাই বলে এভাবে! 

ক্রিকেটের ভাব-ভাষা প্রকাশে আমরা খুব সচেতন বলে আমার মনে হয় না। ক্রিকেট নিয়ে আমরা এতটাই উন্মাতাল যে, নিজের দল একটা ম্যাচ জিতলে মনে হয় বিশ্বজয় করেছি। অথচ, খারাপ খেললে, হেরে গেলে খেলোয়াড়রা সমর্থকদের বাজে আচরণ, অকথ্য ভাষায় গালাগালির শিকার হন।

আর একটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে গেছে, কোনো একটা ম্যাচের বিশেষ একটা অংশ থেকে ক্ষুত বা ত্রুটি বের করে সেটাকে ইস্যু বানিয়ে অনলাইন গরম করে ফেলা। 
বাংলাদেশ পুরুষ দল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ব্যস্ত থাকলে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তথা অনলাইনে অনলাইনবাসীও ব্যাপক ব্যস্ত থাকে। প্রশংসায়, শুভকামনায়, প্রোপাগান্ডায় সময় কাটে অনলাইন বাসিন্দাদের। প্রশংসা-শুভ কখনো কখনো অযৌক্তিকভাবে অতিরঞ্জিত হয়। সেটা উত্তেজনার বশে হতে পারে বলে ভুলে থাকা যায়। কিন্তু আপত্তিকর-বিব্রতকর হয়ে ওঠে অন্য দলগুলো ও তাদের খেলোয়াড়কে হেয় করা, অসম্মান করা, তাদের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা তৈরি করা, এগুলো। 

বাংলাদেশ নিয়মিত ভালো খেলছে, এর ইতিহাস কিন্তু খুব বেশি দিন আগের নয়। অথচ আমাদের আচরণ দেখলে, প্রপাগান্ডার বহর দেখলে মনে হবে, আমরা বুঝি সত্যই বিশ্বসেরা দল হয়ে গেছি! এই সমর্থকরা, যারা কিছু না বুঝেই গ্যালারিতে বসেন শুধু চেহারা দেখানোর জন্য, তারা কি জানেন বাংলাদেশের ক্রিকেটে রুটের অবস্থা কী? প্রথম শ্রেণির অবস্থা কী? বোর্ডে পেশাদারিত্বের অবস্থা কী? টেস্টের দল হিসেবে বাংলাদেশের ক্রিকেটীয় মানের অবস্থা কী?  

জানেন কি না জানি না। মাশরাফি বিন মুর্তজা স্বয়ং হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, যে কয়েকজন জাতীয় দলে খেলছেন, তাঁদের বাইরে বাংলাদেশ ক্রিকেটে খুব বেশি খেলোয়াড় পাইপলাইনে নেই। একদম হাতে ধরে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন পরিস্থিতি কত ভয়াবহ। অন্দরের এই খবর, গ্ল্যামারের পেছনে ছুটে চলা এই আমরা কজনই বা রাখি বা ভেবে দেখি? আমরা আবেগ দিয়ে চলি, যুক্তি মানি না। যুক্তি না মানলে পরিপক্বতা আসে না। এর জন্য একদিন পস্তাতে হবে।  

৩.
বাংলাদেশের সমর্থকরা কতটা অপরিপক্ব সেটার দুটো উদাহরণ আমি এখানে দিতে চাই। 

ক. সারা বিশ্বে একটা দল কতটা ভালো, তার মানদণ্ড মাপা হয় টেস্ট ক্রিকেট দিয়ে। আমরাই বোধহয় একমাত্র টেস্ট খেলুড়ে দেশ, যারা ওয়ানডে কিংবা টি২০-র সাফল্য দিয়ে ক্রিকেটীয় অবস্থান ও মানদণ্ড মাপি! বোর্ডও মাপে, সমর্থকরাও মাপে! 

এর কারণ, গ্ল্যামার। রঙিন পোশাক, সাদা বলের যে গ্ল্যামার আছে সেটা আমাদের খুব ছুঁয়েছে। তাই আমরা খুব হৈচৈ করছি। বিশাল দল হয়ে গেছি বলে উচ্চবাচ্য করছি। আসলে আমরা আমাদের ক্রিকেটের ক্ষতি করছি। 

এর কারণটাও তো পরিষ্কার। আমাদের এখানে ক্রিকেট আজকাল আর শুধু বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে নেই। খেলাটা আজকে ব্যবসার বস্তু হয়ে গেছে। এই ব্যবসাটা সবচেয়ে বেশি জমে টি২০-তে, তারপর ওয়ানডেতে। এক টি২০-র বিপিএল করতে বিসিবি যতটা আগ্রহী, চারদিন দৈর্ঘ্যের বিসিএল বা জাতীয় লীগ নিয়মিত করতে তারা ঠিক ততটাই অনাগ্রহী কেন, সেটা খেয়াল করলেই তো বোঝা যায়, ব্যবসা কোথায়, কীভাবে আশ্রিত হয়েছে। 

সুতরাং, আপনার জন্য রঙিন পোশাকের গ্ল্যামার তারা একদম বেডরুম পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে। আপনার দেশপ্রেম তাদের কাছে জিম্মি। নইলে আপনি ঠিকই টেস্ট ক্রিকেট দেখতে গ্যালারি ভরিয়ে ফেলতেন, যেমনটা অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড ইত্যাদি দেশে করে। নইলে আপনি নারী দল যখন মাঠে নামে ঠিক সমান উত্তেজনায় খেলা দেখতে বসতেন। এসব করেন বলুন তো?

আপনার দেশপ্রেমের স্টিয়ারিংটা আর আপনার হাতে নেই। কারণ ওই যে, আপনি যুক্তির চেয়ে আবেগ দিয়ে বেশি চলেন। আর সেই আবেগ মাড়িয়ে কতশত ব্যবসা হচ্ছে আপনাকে নিয়ে তা আপনি টেরও পাচ্ছেন না! 

এবার আসি দ্বিতীয় উদাহরণে। আমার দ্বিতীয় উদাহরণটা আমরা যে ক্রিকেট খেলাটা লজ্জাজনকভাবে কত কম বুঝি সেটা জানতে সাহায্য করবে। 

খ. গত কয়েকদিনে বাংলাদেশের কিছু অনলাইন ওয়েব পোর্টালে ও ফেসবুকে একটা স্কোরকার্ড ঘুরে বেড়াচ্ছে। স্কোরকার্ডটা বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচের। যে ম্যাচে বাংলাদেশ ১ রানে হেরে গিয়েছিল। সেদিন ভারত করেছিল ১৪৬ রান। আর বাংলাদেশ ১৪৫ রান। 

তো সেই স্কোর বোর্ডের একটা ভুল বাংলাদেশের কতিপয় ক্রিকেটবিজ্ঞ বের করেছেন। যেখানে তারা দেখাচ্ছেন যে, সেই ম্যাচে বাংলাদেশও ১৪৬ রান করেছে! 

বাংলাদেশকে একটা রান কম দেওয়া হয়েছে বলেই তাঁদের ব্যাখ্যা। তো সেই ব্যাখ্যা তাঁরা অনলাইনে ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং সেটা বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছে ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। 

শিরোনামটাও আকর্ষণীয় : ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ম্যাচ হারের আসল রহস্য ফাঁস : নিষিদ্ধ হতে পারেন ৩ জন 

এমন শিরোনাম দেখে আমিও আকর্ষণবোধ করলাম। লিংকে ক্লিক করার আগে একটা প্রি-কনসেপ্টও নিয়ে ফেললাম। ভাবলাম, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ ও শুভাগত হোম বা মুস্তাফিজুর রহমানই বোধহয় সেই তিনজন, যাঁরা নিষিদ্ধ হতে পারেন! কারণ, শেষ তিন বলে বাংলাদেশ যে মাত্র ২ রান করতে পারল না, সেটা তো এঁদেরই যৌথ ব্যর্থতায়! 

মজার বিষয় হলো, অনলাইন থেকে অনলাইনে লেখাটা আপলোড করা হয়েছে। কিন্তু, হুবুহু একই শিরোনামে। শিরোনামটা আকর্ষণীয় বটে! 

লেখাটা পড়তে গিয়ে আমি খুবই বিস্মিত হলাম। আমার ধারণা, যাঁরা খেলাটা বোঝেন, তাঁরাও বিস্মিত হয়েছেন। নিষিদ্ধ হতে পারেন নাকি ওই ম্যাচের তিন আম্পায়ার! 

কেন? তাঁদের কারণেই বাংলাদেশের একটি রান কম হয়ে গেছে! 

কীভাবে? ওই লেখার ভাষ্য অনুযায়ী, যুক্তি অনুযায়ী, সুরেশ রায়নার যে ওয়াইড বলটাতে সাব্বির রহমান স্ট্যাম্পড হয়েছিলেন, সেই ওয়াইডটা অতিরিক্তের খাতায় হিসাব করা হলেও মোট রানের খাতায় যুক্ত করা হয়নি। তাই, বাংলাদেশের রান একটা কম হয়েছে এবং এ জন্য নাকি আম্পায়ারদের শাস্তি দিতে যাচ্ছে আইসিসি! 

আর এই কথা প্রতিষ্ঠা করতে ওই কুচক্রী মহল ব্যবহার করল অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি অধিনায়ক ইয়ান চ্যাপেলের না-বলা কথা। চ্যাপেল যদি বাংলা কথা বুঝতেন, আমি নিশ্চিত, তিনি যে রাগি মানুষ, তাতে মানহানির মামলা করে দিতেন!

আমি ভাবলাম, ঘটনা তো ভয়াবহ। আইসিসির যে কোনো প্রেস রিলিজের মেইল তো আমিও পাই। এ ব্যাপারে পেলাম না কেন? 

এবার আমি ওই লেখার সঙ্গে যুক্ত সেদিনের স্কোরকার্ডটাতে চোখ দিলাম। তারপর যা দেখলাম, এর চেয়ে বাজে নোংরা কুৎসিত শুভঙ্করের ফাঁকি আমি কোনোদিনও দেখিনি। 

নিচের এই অংশটুকু মনোযোগ দিয়ে পড়ার অনুরোধ রইল আপনার কাছে। 

ওই স্কোরবোর্ডে রানের হিসাবটা করা হয়েছে এভাবে :

ভারতীয় বোলাররা ওয়াইড-নোসহ মোট রান দিয়েছেন ১৪১। বাই-লেগবাই দিয়েছেন চারটি। তা মানে মোট রান ১৪৫ ঠিকই আছে।

বলে রাখা ভালো, সেদিন ভারত কোনো নো-বল ও লেগবাই রান দেয়নি। একটাই ওয়াইড বল দিয়েছে, যেটাতে সাব্বির স্ট্যাম্পড হয়েছিলেন। আর বাকি চারটি অতিরিক্ত রানই এসেছে বাই থেকে। 

আরেকটু বলে রাখা ভালো, যারা ক্রিকেটের কঠিন হিসাবটা জানেন না বোঝেন না তাঁদের জন্য, অতিরিক্ত রানের মধ্যে শুধু ওয়াইড আর নো-বলই বোলারের দেওয়া রানের সঙ্গে যুক্ত হয়। বাই আর লেগবাই যুক্ত হয় না, শুধুই অতিরিক্ত হিসেবে আলাদাভাবে যুক্ত হয়। 

তো আমাদের সেই মূর্খ-ক্রিকেটপণ্ডিতরা করেছেন কি, প্রথমে ভারতীয় বোলারদের রানটা যোগ করেছেন। তাতে ১৪১ রান হয়েছে। তারপর, অতিরিক্ত রান যোগ করেছেন পাঁচটি (একটি ওয়াইড ও চারটি বাই)। 

ওপরে আপনি যদি মনোযোগ দিয়ে পড়ে থাকেন, তাহলে আপনার বুঝে ফেলার কথা যে, ওই ওয়াইড বলটা দুবার হিসাব করা হয়েছে। একবার বোলারের খাতা থেকে। আরেকবার অতিরিক্তের খাতা থেকে! 

আসলে, এটা একটা অদ্ভুত হিসাব হয়েছে। রান সাধারণত এভাবে হিসাব করে না। রান হিসাব করা হয় ব্যাটসম্যানদের মোট উত্তোলিত রান ও বোলারদের দেওয়া রানের যোগফল করে। ওই হিসাবে দেখবেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা রান তুলেছেন ১৪০। আর ভারতীয় বোলারদের দেওয়া অতিরিক্ত পাঁচটি রান যোগ করে হয়েছে ১৪৫। 

তারা এই সহজ উপায়ে, নিয়ম মেনে হিসাবটা করেননি। ইচ্ছাকৃতভাবেই উল্টোভাবে পেঁচিয়ে হিসাবটা করেছেন যেন প্রপাগান্ডাটা বাজারে খাওয়ানো যায়! লোকে খেয়েছেও! ফেসবুকের ওয়ালে শেয়ারের বন্যা বইয়ে দিয়েছে অনলাইনবাসী! 

মজার বিষয় হলো, তাদের দেওয়া স্কোরকার্ডটাও কিন্তু খণ্ডিত। সেখানে শুধুই বাংলাদেশের ইনিংসের অংশটা আছে। তাও আবার ওপরের কয়েকজন ব্যাটসম্যানের নাম নেই। পুরো স্কোরকার্ডটা থাকলে হয়তো যুক্তি দিয়ে কাউকে আপনি বলতে পারতেন, ব্যাটসম্যানদের রান যোগ করে তার পর অতিরিক্ত রান যোগ করে দেখুন। দেখবেন ঠিকই আছে। 

আসলে আপনার কম বোঝার সুযোগ তারা নিতে চেয়েছে নানাভাবে এবং আপনি তাদের ফাঁদে পড়েছেন! নিজেকে হাসির পাত্র বানিয়েছেন! 

আসলে, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের জন্য, যুক্তি উপস্থাপনের জন্য প্রয়োজন ছিল পুরো ম্যাচের স্কোরকার্ডটাই প্রদান করা। যেটা তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই করেনি। করলে তাদের সূত্র অনুযায়ী, ভারতীয় ব্যাটিং ইনিংসেও একটা রান কম হয়েছে। কীভাবে? 

দেখুন তাহলে : ভারতের ১৪৬ রানের ইনিংসে সেদিন বাংলাদেশের বোলাররা তিনটি অতিরিক্ত রান দিয়েছিলেন। যার মধ্যে দুটি লেগবাই ও একটি ওয়াইড। ওয়াইড বলটা দিয়েছিলেন অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। 

তো বাংলাদেশের বোলাররা সেদিন রান দিয়েছিলেন ১৪৪টি, সঙ্গে এই তিনটি অতিরিক্ত রান যোগ করলে ভারতের রান হওয়ার কথা ১৪৭। তাই না? 

ওপরে আমরা রান গণনার যে সহজ পন্থাটা দেখালাম, সেটা অনুযায়ী এটা একটা ভুল হিসাব। আসলে ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা রান করেছিলেন ১৪৩টি, বাংলাদেশের বোলাররা অতিরিক্ত রান দিয়েছিলেন তিনটি। মোট ১৪৬ রান। 

আমার ধারণা, ছবিতে দেখলেই ব্যাপারটা অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যাবে আপনার, প্রিয় পাঠক। তখন, আপনার মনে হতেই পারে, হায় রে, কত বড় প্রপাগান্ডার ফাঁদেই না পা দিয়ে ফেলেছিলাম! 

৪.
অনলাইনের দুনিয়ায় মানুষকে বোকা বানানোটা সবচেয়ে বড় ব্যবসা। প্রতিটি অনলাইনই চায়, তার টিআরপি (টার্গেট রেটিং পয়েন্ট) বাড়ুক। সুতরাং, এই খায়েসে অধিকাংশ অনলাইন পোর্টালই এমন সব অযৌক্তিক খবর প্রকাশ করে, যার উৎস হয়তো তারা নিজেরাও জানে না। এটা হিট বাড়ানোর কৌশল! 

ক্রিকেট সংক্রান্ত বিষয়গুলো আজকাল সেই জায়গাতেই পৌঁছে গেছে। ওপরের যে উদাহরণটা আমরা দেখলাম, তাতে সস্তা জাতীয়তাবাদ প্রকাশের ভণ্ডামি আছে, একই সঙ্গে অনলাইনের হিট বাড়ানোর মসলাও আছে। তার মানে ব্যবসার উপকরণ হিসেবে ক্রিকেটের সঙ্গে উগ্র জাতীয়তাবাদী মসলা মিশিয়ে দিলে যে প্রচুর জনপ্রিয়তা পাওয়া যায়, নিজেদের অনলাইনের নাম সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া যায় এটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এসবের অধিকাংশই আসলে বাস্তব নয়, প্রপাগান্ডা। মানুষ আজকাল সত্যের চেয়ে প্রপাগান্ডায় বেশি বিশ্বাস করে। আর এই প্রপাগান্ডা ছড়ানোকেও আমার সব সময় একটা রাজনৈতিক কৌশলই মনে করি আমি। এতে করে কেন্দ্র থেকে মানুষজনের মনোযোগ ঘুরিয়ে ফেলা যায় সহজেই। 

এটাও আমাদের অপরিপক্বতা, যাচাই-বাছাই করার দুর্বলতা, ছোট হয়ে থাকার হীনমন্যতা ইত্যাদি থেকে তৈরি হয়। বাংলাদেশে মানসম্পন্ন অনলাইন ওয়েব পোর্টাল হাতে গোনা কয়েকটা, যেগুলোর ওপর আস্থা রাখা যায়। বাকিগুলো সব বিষাক্ত ভাইরাস বা গার্বেজ! 

বাংলাদেশের মানুষ ক্রিকেটে এই ভারতের মোড়লিপনার বিরোধিতা করে আসছে। রাস্তায় নামছে। আন্দোলনও করছে। রাজনীতির ক্ষেত্রে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যে লড়াই, ক্রিকেট প্রশাসনের প্রেক্ষিতে সেটা ভারতের বিরুদ্ধে হচ্ছে। বিষয়টা চমকপ্রদ। ব্যক্তিগতভাবে আমিও চমকপ্রদ এই লড়াইয়ের একজন সাথী। 

বিড়ম্বনার যেটা সেটা হলো, এই বিরোধিতাগুলো মাঝেমাঝেই ভদ্রতাকে ছাড়িয়ে যায়। গালাগালি থেকে শুরু করে কী চলে না? যার কাছে যুক্তি ও যুক্তির শক্তি কম থাকে, সে গালিগালাজ করে জিততে চায়। এটা শোভনপন্থা নয়। 

তা দল ভালো না খেললেও কি আপনি প্রপাগান্ডা ছড়াবেন? এবার যে আমরা ১ রানে হারলাম, তার কী ব্যাখ্যা? ব্যাখ্যা না পেয়ে আপনি একটা অবান্তর প্রপাগান্ডা ছড়ালেন। আমাদের ১ রান কম দেওয়া হয়েছে, ইয়ান চ্যাপেল বলেছেন আম্পায়ারদের শাস্তি দিতে হবে ইত্যাদি হাস্যকর সব প্রপাগান্ডা! 

এতে কী দাঁড়াল? ও দেশেও তো বাংলা বুঝদার, ক্রিকেট বুঝদার লোকজন আছে। তারা আমাদের এই ফালতু আবেগকে মূর্খামি মনে করল। তাতে কি আমাদের দেশের মর্যাদা বাড়ল? সবার আগে দেশের মর্যাদা। দেশকে যদি মর্যাদাবান আমরা করতে নাও পারি, যেন অন্তত নিচে না নামাই। রুগন-ভগ্ন ও উগ্র জাতীয়তাবাদ দেখাতে গিয়ে আমরা সেটাই কি করছি না?  

যতদিন এই অবস্থা চলবে এবং যতদিন আমরা এভাবে যুক্তির অভাবে প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে যাব, ততদিন আমরা আমাদের দলটার ক্ষতিই করব আসলে। 

৫.
লেখাটা শেষ করি অন্যভাবে। আমি জানি, আমি আপনার ক্রিকেট-অনুভূতিতে, উগ্র জাতীয়তাবাদী অনুভূতিতে, প্রপাগান্ডায় বিশ্বাসী মনকে আঘাত দিয়েছি। হয়তো তাই এ লেখার যুক্তি আপনার কাছে যুক্তি মনে হবে না। স্ক্রিনের সামনে বসে আপনি তাই আমাকেও গালাগালি করবেন। তাহলে জানবেন, লেখার কথাগুলো সত্য হয়ে গেছে! হয়তো সে কারণেই প্রপাগান্ডা ছড়ানোর জন্য তৈরি একটি লেখা যেভাবে যতজনের কাছে যতদ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে, ফেসবুকে-টুইটারে-অনলাইনে শেয়ার হয়েছে, এই লেখা ততটা হবে না। এটা আক্ষেপ নয়; বাস্তবতা। 

বাস্তবতা মানি বলেই আমি মনে করি, এই উগ্র জাতীয়তাবাদী চেহারা একদিন শুধু ক্রিকেটীয় সার্কিটে নয়, আমাদের রাজনৈতিকভাবেও ক্ষতি করবে। এরই মধ্যে করা শুরু করে দিয়েছে। কারণ একটাই, আমরা ঘটনার কেন্দ্রে যেতে পারি না; শুধু পরিধিতে বসে হাতি-ঘোড়া মারি। আসলে মারি না, হুংকার করি মাত্র! 

বিশ শতকের বিখ্যাত আফ্রো-ক্যারাবিয়ান চিন্তক সিএলআর জেমস তাঁর ‘বিয়ন্ড এ্যা বাউন্ডারি’ নামক ক্রিকেট-রাজনীতি-সংস্কৃতি সংক্রান্ত ভাবনা-গ্রন্থে লিখেছিলেন, তারা ক্রিকেটের কী বোঝে যারা শুধুই ক্রিকেট বোঝে ।

সেরিল লিওনেল রবার্ট জেমস ১৯৮৯ সালে ইহলোক ত্যাগ না করলে তাঁকে একটা খোলা চিঠি লিখতাম। কী লিখতাম? নিচে পড়ুন :

আপনার এই অসাধারণ কথাটার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমি বাংলাদেশ থেকে বলছি। আমরা একটা ক্রিকেটপাগল দেশ। এ দেশের শতকরা ১০ ভাগ লোকও ক্রিকেট খেলাটা সম্ভবত ভালো মতো বোঝে না। তারপরও যারা বোঝে, তারা শুধু ক্রিকেটই বোঝে। অন্য কিছু বোঝে না। না বোঝে রাজনীতি, না বোঝে সংস্কৃতি, না বোঝে সমাজ! আপনি কি বাংলাদেশ নামক এই দেশটার কথা মাথায় রেখেই বাক্যটা লিখেছিলেন? যারা আপনার মৃত্যুরও অনেক বছর পরে ক্রিকেটের আকাশে নতুন তারা হিসেবে মিটমিট করে জ্বলবে ঠিকই, কিন্তু জ্বলতে না জ্বলতেই তার অবুঝ-বেবুঝ মানুষরা তাকে চন্দ্রসম বানিয়ে ফেলবে! 

আপনি কি জানেন, এই বাংলাদেশ অনেক লাঞ্ছনা-বঞ্চনা-গঞ্জনার জবাব দিতে পারবে একদিন? সেই সামর্থ্য আমাদের আছে। আপনার ওয়েস্ট ইন্ডিজ পরবর্তী জীবনে আপনার নিবাসস্থল ইংল্যান্ডকে যেভাবে এই বিশ্বকাপের ফাইনালে জবাব দিল, ঠিক সেরকম জবাব আমরাও একদিন দিতে পারব। এখন নয়, সময় লাগবে। সময় যে লাগবে সেটাই আমাদের আবেগাক্রান্ত মানুষগুলো বোঝে না।

রাজনৈতিকভাবে আমরা তো অনেক নিপীড়িত একটা ভূখণ্ড। ক্যারিবিয়ানের কালো মানুষরাও একদিন তাই ছিল। আমার কাছে ওয়েস্টইন্ডিজের এই জয় তথকথিত ‘সভ্য’র বিপক্ষে তথাকথিত ‘অসভ্য’র জয়। সাদারা একদিন সারা পৃথিবীকে অসভ্য বলেই তো উপনিবেশের পর উপনিবেশ বানিয়েছে, অত্যাচার-নিপীড়ন করেছে। কিন্তু আপনিও যদি সত্য সত্যই অসভ্য হয়ে যান, তাহলে আর আসল জায়গায় গিয়ে আসল কাজটা করতে পারবেন না। লাঞ্ছিত-বঞ্চিতের প্রতিশোধটা মঞ্চের কেন্দ্রে গিয়েই নিতে হয়। পরিধিতে থেকে নয়, আসল কেন্দ্রে গিয়েই জবাবটা দিতে পারতে হয়। বাংলাদেশও একদিন পারবে। সময় লাগবে। 

মিস্টার জেমস শুধু ওই অসামান্য বাক্যটার জন্যই তো আপনার অসীম কৃতজ্ঞতা পাওয়া উচিত! 

লেখক : গবেষক ও সংবাদকর্মী।