প্রতিরোধের মার্চ
মিওয়ানওয়ালি বন্দিশিবির থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান
বাঙালি জাতিসত্তার অভ্যুদয়ের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ ছিল বিশ্বের বিস্ময়! পৃথিবীর সামরিক যুদ্ধের ইতিহাসের এক বিরল ঘটনা! আর এই বিস্ময়কর, বিরল ঘটনার মহান স্থপতি ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন ঘুমন্ত, নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে তারা বন্দী করে ফেলে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, আর ৩ এপ্রিল মোহাম্মদপুরের একটি বাসা থেকে তারা বন্দী করে তাঁর অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহচর ড. কামাল হোসেনকে। তাঁদের বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে। প্রথমেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আক্রমণ চালায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আর পিলখানার ইপিআর সদর দপ্তরে। ঘুমন্ত, নিরস্ত্র, অসহায় মানুষ কিংকর্তব্যবিমূঢ় ও হতবাক হয়ে পড়ে। আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে গোপনে নিয়ে আসা সমরাস্ত্রের আঘাতে ধ্বংস হয়ে পড়ে বাঙালির প্রাথমিক প্রতিরক্ষা বুহ্য। শুরু হয় প্রতিরোধের মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালির স্বাধীনতাযুদ্ধ। বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। আশ্রয়, খাদ্য আর অস্ত্র নিয়ে অসহায় মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায়। পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম গণহত্যার শিকারে পরিণত মানুষকে রক্ষায় জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতা। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল গঠিত হয় প্রবাসী মুজিবনগর সরকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও গণপরিষদের অন্যতম সদস্য বঙ্গবীর জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীকে পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদায় মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক করে গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার। বিশ্ববাসী জানতে পারে, বাঙালিরা একটি স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্র গঠনের জন্য অস্ত্র হাতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বিশ্বের শান্তিপ্রিয়-মুক্তিকামী মানুষ বাংলার অসহায় মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায়। শুরু হয় গৌরবের মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ জীবন দেয়, দুই লাখ মা-বোন তাদের ইজ্জত দেয়। এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে বাঙালি জাতি-গোষ্ঠীর স্বাধীন-সার্বভৌম একটি দেশ—বাংলাদেশ!
সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ড. কামাল হোসেন বাংলাদেশের অভ্যুদয়সহ ২৫ মার্চের কালরাত থেকে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছেন। তাঁর লেখা থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তিনি, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম ও মরহুম তাজউদ্দীন আহমদ ২৫ মার্চ রাতে পুরান ঢাকায় আত্মগোপনে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। রাত ৮টার দিকে তিনি তাঁর প্রতিবেশী এম আমীর-উল ইসলামকে নিয়ে যখন সাতমসজিদ রোডের দিকে যাচ্ছিলেন, তখনই তাঁরা খবর পান যে রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড বসানো হয়েছে। শেষবারের মতো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে তাঁরা যখন বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাসায় যান, বঙ্গবন্ধু তখন তাঁদের ভেতরে খাবারঘরে নিয়ে কথা বলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এটাই ২৫ মার্চের কালরাতে তাঁদের শেষ দেখা। রাতেই নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার জন্য তাজউদ্দীন আহমদের বাসায় গিয়ে তাঁরা দেখতে পান, সেখানে বেশ লোক জড়ো হয়েছে। এ সময় মোজাফফর নামের কুমিল্লার এক সংসদ সদস্য তাঁদের জানান, নিউমার্কেটের সামনে ইপিআর (বর্তমানে বিজিবি) অবস্থান নিয়েছে। ফলে পুরান ঢাকায় না গিয়ে আপাতত ধানমন্ডির আশপাশে তাঁরা আত্মগোপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ড. কামাল তাঁর এক আত্মীয়ের বাসায় যাওয়ার পর রাতেই প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়। সান্ধ্য আইন জারি করে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ভারী অস্ত্র নিয়ে বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে ড. কামাল, তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম পরস্পর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ৩ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল লালমাটিয়ার কাছে তাঁর অবস্থান ঘিরে ফেলে তাঁকে বন্দী করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায় এবং সেখানেই তিনি প্রথম জানতে পারেন যে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পরদিন সকালে ড. কামাল হোসেনকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গিয়ে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের হাজরা জেলার হরিপুর কারগারের একটি সেলে বন্দী করে রাখা হয়। দীর্ঘ নয় মাস নির্জন সেলে বন্দী করে রেখে তাঁর কাছ থেকে পাকিস্তানিরা বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চালায়। বিশেষ করে তাজউদ্দীন সাহেবের অবস্থান এবং ভারত, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয় জানতে চেয়ে বারবার তাঁকে চাপ দেয়। এমনকি তাদের সহযোগিতা না করলে খারাপ পরিণতির হুমকিও দেওয়া হয়। তারা তাঁকে এও জানায় যে, বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকেও একই রকম তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা তারা করছে। অবশেষে তাঁদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা এবং রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে তাঁদের বিরুদ্ধে বিচার শুরু করে।
পাকিস্তানের বিশেষ সামরিক আদালতে বিচারের নোটিশ ড. কামাল হোসেনের কাছে পৌঁছে ৫ সেপ্টেম্বর। লে. কর্নেল ওয়াজির খান মালিক স্বাক্ষরিত নোটিশে একটি বিশেষ আদালতে অক্টোবর মাসের শেষ দিকে বিচারকাজ শুরুর ঘোষণা দেওয়া হয়। এদিকে হঠাৎ করেই অক্টোবরের শেষ দিকে সর্বত্র একটি অস্থিরতা পরিলক্ষিত হতে থাকে। বিচারকাজ পিছিয়ে যায়। জেলের রং পরিবর্তনসহ বেশ কিছু তৎপরতা বেড়ে যায়। ঘনঘন সামরিক বিমানবহরের উড়ে চলা, সাইরেনের শব্দ, জেলসহ সর্বত্র ব্ল্যাক আউটের যুদ্ধের মহড়া ইত্যাদি বেড়ে যায়। ১৬ ডিসেম্বরের পর হঠাৎ পটপরিবর্তন হতে শুরু করে। ২৮ ডিসেম্বর হঠাৎ করে জেল সুপার তাঁকে সবকিছু গোছগাছ করে তৈরি হতে বললে তিনি বিস্মিত হন। ডক্টর কামালের কাপড়চোপড়, এমনকি বই-পুস্তক, যা এতদিন জেল কর্তৃপক্ষের হেফাজতে ছিল, সব তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় এবং গেটের বাইরে এনে গাড়িতে তুলে রাওয়ালপিন্ডিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আনার পর সিহালার নির্মাণাধীন পুলিশ দপ্তরের একটি বাংলোয় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ঢুকে অবাক বিস্ময়ে তিনি দেখতে পান, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ২৫ মার্চের কালরাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে শেষ সাক্ষাতের দীর্ঘ নয় মাস পর ২৮ ডিসেম্বর রাওয়ালপিন্ডির সিহালার এক বাংলোতে বঙ্গবন্ধুকে পেয়ে ড. কামাল আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। পরস্পরকে তাঁরা আবেগে জড়িয়ে ধরেন। তিনি জানতে পারেন, রাওয়ালপিন্ডির মিওয়ানওয়ালি কারাগারে বঙ্গবন্ধুকে এই দীর্ঘ নয় মাস বন্দী করে রাখা হয়েছিল।
মুক্ত মহানায়কের এবার দেশে ফেরার পালা। জুলফিকার আলী ভুট্টো দেখা করে শিগগিরই তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থার কথা জানায়। তবে নানা অজুহাতেই তারা অহেতুক যাত্রা বিলম্বিত করতে থাকে। বিশেষ করে ইরানের বাদশাহ রেজা শাহ পহলেভির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাতের প্রস্তাব দিলে বঙ্গবন্ধু তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি যেকোনো তৃতীয় দেশের মাধ্যমে যথাশিগগির দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য ভুট্টোকে চাপ দিতে থাকেন। অবশেষে ৭ জানুয়ারি রাতে ভুট্টো করাচি বিমানবন্দর পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আসে এবং একটি পাকিস্তানি বিমানে করে পরদিন সকাল ৭টার দিকে বঙ্গবন্ধু লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে নামেন। পাকিস্তান থেকে লন্ডন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর যাত্রা গোপন রাখা হয়। লন্ডন থেকে মাত্র এক ঘণ্টা দূরত্বের অবস্থান থেকে জানানো হয় যে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, বাঙালি জাতি-রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক ঘণ্টার মধ্যে হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করবেন। অতি অল্প সময়ের নোটিশে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রনায়কের মর্যাদায় অভ্যর্থনা জানাতে বিমানবন্দরে ছুটে আসেন স্যার ইয়ান সাউদারল্যান্ড। লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর আগমন সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার প্রবাসী বাঙালির সঙ্গে ছুটে আসেন ব্রিটেনের বিরোধীদলীয় নেতা হ্যারোল্ড উইলসন, সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট, কূটনীতিবিদ রেজাউল করিম, এ কে খান, বেগম আবু সাঈদ চৌধুরী প্রমুখ দেশি-বিদেশি কূটনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদ। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ তাঁর নিজ এলাকা থেকে দ্রুত লন্ডন ফিরে এসে বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান। এরপর ব্যক্তিগত বিমানে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করেন। এরই মধ্যে ঢাকায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে কথা বলে বঙ্গবন্ধুর যাত্রার সময় ইত্যাদি ঠিক করে ফেলা হয়। অবশেষে ৯ জানুয়ারি সকাল ৭ ঘটিকায় লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দর থেকে যাত্রা করে সাইপ্রাস-শারজাহ ও দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি বিকেল ৩ ঘটিকায় প্রিয় স্বদেশ, বাংলাদেশের মাটিতে অবতরণ করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচর ড. কামাল হোসেন। পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি কারাগার থেকে ফিরে আসা বঙ্গবন্ধুকে বিমানবন্দর থেকে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান তথা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, যে উদ্যানে দাঁড়িয়ে ৭ মার্চ তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন।
শেখ আখতার উল ইসলাম : আইনজীবী ও লেখক।
(তথ্যসূত্র : ড. কামাল হোসেন, বাংলাদেশ কোয়েস্ট ফর ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে মুদ্রিত।)