আল-জাজিরাকে আলী রীয়াজ

গোটা সমাজে ভয়ের সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছে

Looks like you've blocked notifications!
আলী রীয়াজ

দুর্বৃত্তদের কোপে গত বুধবার নিহত হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমুদ্দিন সামাদ (২৬)। সেই হত্যাকাণ্ড নিয়ে কাতারভিত্তিক টেলিভিশন আল-জাজিরা কথা বলেছে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান আলী রীয়াজের সঙ্গে।

এনটিভি অনলাইনের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটির ভাষান্তর করা হলো :

প্রশ্ন : গত বছর পাঁচজন সেক্যুলার ব্লগার ও প্রকাশক খুন হওয়ার পর আরেকজন ব্লগার খুন হলেন। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

আলী রীয়াজ : এটাকে বৃহত্তর আঙ্গিক থেকে দেখতে হবে। খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে, আমাদের আরেকটি মৃত্যু দেখতে হয়েছে। এটা ছিল প্রতিশ্রুতিশীল এক যুবকের মৃত্যু। এটি সত্যিকার অর্থে আমাকে ব্যথিত করেছে। আপনার যা দেখা দরকার, সেটি হলো এটা কিছুদিন ধরে চলছে। এ ধরনের জঙ্গিবাদ দমনে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। একই সঙ্গে আমাদের এটাও দেখা দরকার যে, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিসর সীমিত হয়েছে। মত প্রকাশ, সেটা সরকারের সমালোচনা হোক কিংবা ধর্মীয় সমালোচনা -দুটোই বিপজ্জনক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনি যখন এমন একটি পরিবেশে আছেন, যেখানে নিজের মত প্রকাশ করা যায় না, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত, এটা প্রকৃতপক্ষে জঙ্গি সংগঠনগুলোকে সাহায্য করে। আপনি যদি দেখেন, কিছু হত্যাকাণ্ড হয়েছে যাতে জড়িতদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ আছে বলে দাবি করা হচ্ছে। বিদেশিদের হত্যা করা হয়েছে। এসব বিষয়কে একটি ছোট জায়গা থেকে না দেখে বড় পরিসর থেকে ভাবতে হবে।

প্রশ্ন : গত ১৮ মাসে সেক্যুলার ব্লগার, সংখ্যালঘু, শিয়া, খ্রিস্টান, বিদেশি হত্যায় সন্দেহভাজন ইসলামপন্থী উগ্র সংগঠনগুলোকে দমনে সরকার কী যথেষ্ট পদেক্ষেপ নিয়েছে?

আলী রীয়াজ : অতীতে এটা দেখা যায়নি। একটি মাত্র ঘটনায় দুজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং তাদের সাজা দেওয়া হয়েছে। তবে ঘটনা অনেক বেশি। আমি যদি ২০১৩ সালে একজন ব্লগার হত্যার কথা বলি, সেখান থেকে তিন বছর সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এসব বিষয়ে সরকার কী উদ্যোগ নিয়েছে? উদাহরণ হিসেবে আজকের ঘটনার কথা যদি বলি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলছেন, ব্লগাররা কী লিখছে, তা সরকার খতিয়ে দেখছে। সুনির্দিষ্টভাবে এই ব্লগার (সামাদ) কী লিখেছে, তা সরকার খতিয়ে দেখছে। এটা কোনো কাজে আসবে না। আপনি কী বলছেন, সেটা দেখার বিষয় নয়। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকা উচিত। আমি সরকারের কিংবা ধর্মের সমালোচনা-যাই করি না কেন, সেখানে কোনো বাধা থাকা উচিত নয়। যখন সরকার বলছে, তারা এ ধরনের বক্তব্যের (ব্লগারদের) অনুমোদন দেবে না কিংবা এ ধরনের বক্তব্য নিয়ন্ত্রণ করবে, এটা আসলে জঙ্গিবাদকে উসকে দেয়। এটা উগ্র মতাদর্শে দীক্ষিতদের উসকে দেয়। তাই এটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বড় বিষয়। এর বিরুদ্ধে লড়া উচিত এবং সবার উচিত এটাকে সামনে আনা।  আমি দেখছি ব্লগার কিংবা তাদের অবস্থাকে কোনো সাহায্য করছে না সরকার (বিশেষত তাদের যারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার একটি পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে)।

প্রশ্ন : এ ধরনের একপেশে পরিস্থিতির উন্নয়নে কী করা যায়?

আলী রীয়াজ : বর্তমান পরিস্থিতি খুবই একপেশে। এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে গণতন্ত্র। এমন একটি পরিবেশ দরকার, যেখানে আপনি বলতে পারছেন। এটা নিশ্চিত করা দরকার। কয়েক বছর ধরে আমি বলে আসছি, গণতান্ত্রিক পরিসর সীমিত হয়েছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। এটি (মতপ্রকাশের স্বাধীনতা) জঙ্গি সংগঠন কিংবা সরকারের দিক থেকে। এ ধরনের পরিবেশে আমরা ভয়ের সংস্কৃতি দেখি। গোটা সমাজে এ ভয়ের সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছে। একই সময়ে আমরা দেখছি, সরকারের বিরুদ্ধে কোনো অসন্তোষকে নির্বিচার ও নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হচ্ছে। এটা পরিস্থিতির উন্নয়নে কোনো সাহায্য করবে না। কারণ, আপনি কখনো এটা ভাবতে পারেন না যে, একটি বিষয় সঠিক আছে আর অন্যটি ভুলভাবে চলছে। এ অবস্থায় আমার মতামত হলো, সব বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করা দরকার, যেখানে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করা যায়, সেটি সরকারের সমালোচনা হোক কিংবা ধর্মের সমালোচনা। আমাদের দেখতে হবে যে, কারা এ ধরনের (ভয়ের) পরিস্থিতির সুবিধা নেয়। অগণতান্ত্রিক শক্তিগুলো এর সুবিধা নেয়। সেটা সরকারের ভেতরকার কিংবা বাইরের। তাই এ বিষয়টিকে সামনে আনা সরকারের দায়িত্ব। সামাজিক আন্দোলন আমরা যদি দেখি, লোকজন নিজেদের মত প্রকাশ করতে চাচ্ছে। এরপরও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার টুঁটি চেপে ধরার ফলে জঙ্গি সংগঠনগুলো সুযোগ পাচ্ছে।