একাত্তরের মার্চ

যেন এক অনন্ত যাত্রা (দ্বিতীয় কিস্তি)

Looks like you've blocked notifications!

(১৯৭১ সালের উত্তাল দিনগুলোর দীর্ঘ স্মৃতিচারণা করেছেন তৎকালে মুক্তিযুদ্ধকে কাছ থেকে দেখা ও সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া ব্যারিস্টার এম এম আমীর-উল ইসলাম। এনটিভি অনলাইনের জন্য লেখা সেই স্মৃতিচারণা ধারাবাহিকভাবে তিন কিস্তিতে ছাপা হচ্ছে। আজ ছাপা হচ্ছে এর দ্বিতীয় কিস্তি)

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা

স্বাধীনতার ঘোষণাটা ছিল সময়ের প্রশ্ন। কোন সময়টি উপযুক্ত সময় এটা ছিল বিবেচ্য বিষয়। ঘোষণার ব্যাপারটি ছিল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। কেননা স্বাধীনতার বীজ বপন হয়েছে অনেক আগেই। ছয় দফা থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধু, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, সেনাবাহিনী, পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা, কূটনীতিকসহ ২৬ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের, বন্দী শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁদের সহবন্দীদের মুক্তির দাবিতে সংঘটিত ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, বাঙালির প্রচণ্ড গণ-আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খানের পতন ইত্যাদি ছিল মৌলিক গণতন্ত্রের খোলসে পাকিস্তানি সেনাশাসনের এক একটি মৃত্যুঘণ্টা। কখন হবে আক্রমণ এবং কখন বাজবে পাকিস্তানের আখেরি মৃত্যুঘণ্টা, পুরো মার্চজুড়ে শুধু এই অপেক্ষার প্রহর গুনছিল সবাই। এসব কিছুর ইঙ্গিত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে ছিল। 

স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে যে বিতর্কটি সৃষ্টি হয়েছে, সেটা খুব অপ্রত্যাশিত। বিতর্কটির বিষয়বস্তু যেসব কথিত কথোপকথনের ওপর ভিত্তি করে বলা হচ্ছে, সেগুলোর ঐতিহাসিক সত্যতা খুবই দুর্বল। স্বাধীনতা ঘোষণার যে ভিত্তি তার একটা সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত বিদ্যমান, যে ইতিহাসের কথা আমরা সবাই জানি।

আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু কোন ধরনের কৌশল অবলম্বন করবেন এ বিষয়ে আমরা কেউই নিশ্চিতভাবে কিছুই জানতাম না। এখানে স্মৃতিচারণায় যেসব ঘটনার সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ সংযোগ ছিল, ধাপে ধাপে সেগুলোর বিবরণ দেব। মার্চ (১৯৭১) মাসেই কথা হলো বঙ্গবন্ধু তাঁর একটা বক্তৃতা রেকর্ড করবেন। স্বাধীনতা ঘোষণাসংবলিত সেই বক্তৃতাটি বাজানো হবে কোনো একটা গোপন জায়গা থেকে। সে জন্য আমরা ওয়্যারলেস ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করি। এ আলোচনাতেই ইস্টার্ন ওয়্যারলেস ডিভিশনের ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম নুরুল হক ভাইয়ের সন্ধান পাই আমরা। তিনি কুষ্টিয়ার লোক। আমাদের কাছে ‘খোকা ভাই’ নামে পরিচিত ছিলেন। আমাদের উদ্দেশ্য তাঁকে বুঝিয়ে বলার পর তিনি বললেন, ‘এ কাজে যদি আমার জীবনও চলে যায় তবু আমি এটা করব। খুলনায় একটা ট্রান্সমিটার আছে, আমি ওটা আনতে পাঠিয়েছি। ওটা এসে যাবে।’ ওই সময় খোকা ভাইয়ের অফিসের নাম ছিল ইস্টার্ন ওয়্যারলেস ডিভিশন অ্যান্ড ট্রান্সমিটিং স্টেশন।

সম্ভবত ১৮ বা ১৯ মার্চ, নূরুল হক আমাকে বললেন, বঙ্গবন্ধু তাঁকে একটা ট্রান্সমিটার জোগাড় করতে বলেছিলেন। তিনি খুলনা থেকে একটি ট্রান্সমিটার এনেছেন এবং এটাকে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করে দেখেছেন। আমি বিষয়টি জানার পর তাজউদ্দীন আহমদের সাথে আলোচনা করি। তাঁকে বললাম, এখন যে অসহযোগ আন্দোলন চলছে এর একটা ক্যাপাসিটি এবং লিমিটেশন আছে। একপর্যায়ে এই আন্দোলনের বিস্ফোরণ ঘটবে। আমি আরো বললাম, এটা একটা নার্ভ ওয়ার বা স্নায়ুযুদ্ধ। একপর্যায়ে ওরা আমাদের আক্রমণ করবে বা আমরা ওদের আক্রমণ করব। যেহেতু আমাদের আক্রমণ করার বাস্তব প্রস্তুতি বা সামর্থ্য এই মুহূর্তে নেই, সে ক্ষেত্রে ওরা যদি আগে আক্রমণ করে বসে, তখন আমাদের স্ট্র্যাটেজি কী হবে? আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বললাম সেজন্য একটা বিকল্প পরিকল্পনা বা কনটিনজেন্সি প্ল্যান থাকা দরকার। সন্দেহ নেই বঙ্গবন্ধুকেই এ যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে হবে। তাই আমি প্রস্তাব দিয়ে বললাম তাজউদ্দীন ভাই যেন বঙ্গবন্ধুকে এসব কথা বুঝিয়ে বলেন।

‘কনটিনজেন্সি’ বা আপৎকালীন পরিকল্পনা নিয়ে আমরা আলোচনা করতাম। বঙ্গবন্ধুর সাথে এ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলা জরুরি মনে করি। তাজউদ্দীন ভাই আমাকে বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে গেলেন ওপর তলায় তাঁর শোবার ঘরে। মূল কথা বলার দায়িত্ব আমার। আমি নেতাকে বললাম যে অসহযোগ আন্দোলনের যে উদ্দেশ্য তার চেয়ে অনেক বড় অর্জন আমরা করেছি। আপনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের একমাত্র বৈধ সরকার পরিচালিত হচ্ছে। সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, পুলিশ বাহিনী থেকে শুরু করে কোট-কাছারি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক, শিল্প-কল-কারখানা মালিক-শ্রমিক-কর্মচারী সবাই আপনার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। পৃথিবীর ইতিহাসে অসহযোগ আন্দোলনের এমন সফলতার আর কোনো দৃষ্টান্ত নেই। আপনার নেতৃত্বে একটি কার্যকর সরকার পরিচালিত হচ্ছে। সামরিক বাহিনীর বাজার-ঘাট, কাঁচাবাজার সব কিছু আপনার নির্দেশে পরিচালিত হচ্ছে। এমনকি ইয়াহিয়া খানের বাসভবনে বাবুর্চি রান্না করবে কি না তার অনুমতি আপনাকে দিতে হচ্ছে। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে মিস্টার ভুট্টো ও তাঁর সাথীদের সার্ভিস দেবে কি না তার অনুমতি তারা আমার কাছে চায়। আপনার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি তাদের অনুমতি দিচ্ছি।

তাজউদ্দীন আহমদ আমার সাথে একমত হলেন। তিনি একদিন আমাকে বঙ্গবন্ধুর কাছে তাঁর দোতলার শোবার ঘরে নিয়ে গেলেন। এ সাক্ষাতে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আমার পূর্বের আলোচনার নির্যাসটাই সংক্ষেপে বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করলাম। আমার মূল বক্তব্য ছিল যে, বাংলার জনগণ নির্বাচনেই শুধু আপনাকে রায় দিয়েছে তাই নয়, পহেলা মার্চ থেকে তিন সপ্তাহ আপনার আদেশ-নির্দেশে দেশ পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু ক্যান্টনমেন্টের অবস্থিত সামরিক শক্তি পরিচালনা করছে এয়াহিয়া খান ও তাঁর জেনারেলরা। তাঁদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে আমরা মোকাবিলা করতে পারব না। কিন্তু জনগণকে নিয়ে আমাদের পুলিশ, ইপিআরসহ সামরিক বাহিনীতে বাঙালি অফিসার সৈনিক যাঁরা আছেন, তাঁদের সংঘবদ্ধ করার একটি পরিকল্পনা প্রয়োজন। তিনি আমার কথার সাথে একমত প্রকাশ করলেন। আমি তাঁকে আরো বললাম, এমন একটি সন্ধিক্ষণে আপনাকে এই যুদ্ধেরও নেতৃত্ব দিতে হবে। তিনি বললেন, বাংলাদেশে আমাকে লুকোবার কোনো স্থান নেই। যেখানেই আমাকে নিয়ে যাবি সেই গ্রাম ও জনগণের ওপর আক্রমণ হবে, আমার সন্ধানে গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দেবে ওরা। তবে আমি তোদের জন্য সব কিছু প্রস্তুত করে রেখে যাব। বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। আমি যদি বেঁচে নাও থাকি, তোরা যদি আমাকে জীবিত নাও পাস, আমার মৃতদেহ পেলে দেখবি আমার মুখে হাসি আছে।

একদিন তাজউদ্দীন ভাইসহ বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলাম। বঙ্গবন্ধুকে বললাম, একপর্যায়ে এটা সশস্ত্র আন্দোলনে রূপ নেবে, আপনার নেতৃত্বেই এটা হবে এবং এ যুদ্ধ আপনাকে পরিচালনা করতে হবে। বঙ্গবন্ধু বললেন, আমাকে তোরা কোথায় নিয়ে যাবি? আমার কাজ আমি সম্পন্ন করে যাব, তোরা তোদের কাজ কর। দ্বিতীয়বার হুইপ আবদুল মান্নানকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলাম। তিনি একই কথার পুনরাবৃত্তি করলেন, ‘আমাকে তোরা কোথায় নিয়ে যাবি, বাংলাদেশে আমার লুকোবার জায়গা নেই। আমি যেখানে যাব সেখানেই বিমান হামলা হবে। গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দেবে। প্রতিটি শহরে আমাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজবে,  ঢাকা শহর পুড়িয়ে দেবে। তোরা দেখবি, আমার জীবন দিয়ে হলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। মৃত্যুর পর আমার মরা মুখ যদি তোরা দেখতে পাস, দেখবি আমার মুখে হাসি।’ 

আমি বঙ্গবন্ধুর এসব কথায় তাঁর মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছিলাম। আমি দেখছিলাম তিনি নিজের জীবন নিয়ে ঝুঁকি নিচ্ছেন। ঝুঁকি নিচ্ছেন এভাবে যে, তাঁকে যদি পাক আর্মি ধরে নিয়ে যায়, তাহলে এটা নিয়ে আন্দোলন হবে, সারা দেশে আগুন জ্বলে উঠবে, সারা বিশ্ব আলোড়িত হবে এবং তাতে স্বাধীনতার পথ সুগম হবে। বঙ্গবন্ধুকে যদি ওরা হত্যা করে তাতেও এমন আগুন জ্বলবে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আরো অপরিহার্য ও অব্যর্থ দাবিতে পরিণত হবে। আইদার ওয়ে দি অবজেক্ট উইল বি ফুলফিলড। নিজের জীবন নিয়ে বাজি ধরার এই অসম শক্তি তিনি পাকিস্তান আমলের দীর্ঘ দুই যুগের ক্লান্তিহীন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তিল তিল করে অন্তরে সঞ্চয় করেছিলেন।

এটা হয়তো বঙ্গবন্ধুর মনে ছিল যে, ‘অনিশ্চিত যেটা সেটা আমি কীভাবে করতে পারব জানি না। সশস্ত্র বিপ্লব করার আমার কোনো অভিজ্ঞতা নেই, কাজেই আমি আনসার্টেন অবজেক্টের মধ্যে নিজেকে কেন ফেলছি? আমি যদি আমার জীবনটাকে নিয়ে বাজি খেলি ,তাহলে তো স্বাধীনতা অটোমেটিক্যালি হবেই।’ তিনি হয়তো তাঁর জীবনটাকেই বাজি রেখেছিলেন। এর একটা লজিকও আছে। যুক্তিটা হচ্ছে এই যে, স্বাধীনতার এত বছর পর মনে হয়, যে কাজটা তাজউদ্দীন আহমদ এবং আমরা করলাম এ কাজটার ফলাফল কিন্তু অনিশ্চিত ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যে কাজটা করেছেন এর ফলাফল কিন্তু খুব নিশ্চিত। কারণ হচ্ছে তাঁকে জেলে বন্দী রেখে বা হত্যা করে পাকিস্তান এক থাকবে- এটা সম্ভব না। কিন্তু আমরা যে কাজটি করতে গিয়েছিলাম এতে অনিশ্চয়তা ছিল।

এখন মনে হয়, বঙ্গবন্ধুকে যদি মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে নিয়ে যেতাম, তাহলে বঙ্গবন্ধুর যে ভাবমূর্তি সেটা আর থাকত না। তাঁর জীবন বাঁচানোর জন্য বিশ্বব্যাপী যে প্রচেষ্টা, আন্তর্জাতিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল সেগুলোর কারণে মূলত আমাদের এ যুদ্ধই উপকৃত হয়েছে। জীবন বাজি রেখে, নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন, একাত্তরে সারা দেশের মানুষকে তা উৎসাহিত করেছে, সাহস জুগিয়েছে। জীবন নিয়ে যিনি বাজি রাখেন, তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও বঙ্গবন্ধু আমাদের সাথে না থাকায় অভাববোধটা আমি অনুভব করেছি। কিন্তু এখন যখন পেছনের দিকে ফিরে তাকাই, তখন আমার মনে হয়, বঙ্গবন্ধু সঠিক সিদ্ধান্তই সেদিন গ্রহণ করেছিলেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রপ্রধান, নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা, ব্রিটিশ হাউস অব কমন্স, আমেরিকার সিনেটে পর্যন্ত তাঁর বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তা সম্পর্কে রাশিয়ার পদগোর্নি থেকে শুরু করে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে পৃথিবীর বিভিন্ন রাজধানীতে যে দাবি ও চাপ সৃষ্টি হয়েছিল সে এক বিরল দৃষ্টান্ত। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের নির্বাচনের ফলাফল সারা পৃথিবীকে নাড়া দিয়েছিল, বঙ্গবন্ধুকে ২৫ মার্চের মধ্যরাতের পর বন্দী করার ফলে এ বিষয়ে বিশ্ববাসীর মনোযোগ আকৃষ্ট হয়। পূর্ব বাংলার নিরপরাধ ও নিরস্ত্র মানুষের ওপর সুপরিকল্পিত গণহত্যা চাপিয়ে দেওয়ার ফলে দেশে-বিদেশে দ্রুত এর প্রতিক্রিয়া হয়। গ্যারি জে ব্যাস লিখিত সম্প্রতি প্রকাশিত বিখ্যাত বই ব্লাড টেলিগ্রামে ((Blood Telegram) অনেক তথ্য পাওয়া যাবে। তৎকালীন নিক্সন ও কিসিঞ্জার প্রশাসনের বাইরে কংগ্রেস, সিনেট এবং আমেরিকার সাধারণ মানুষ সংবাদমাধ্যমে অকুণ্ঠভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন জানিয়েছেন। তাঁরা সবাই বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা ও মুক্তির দাবিতে সব সময় সোচ্চার ছিলেন। বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদপট জুড়ে বঙ্গবন্ধুর ছবি ছাপা হয়েছিল।

২৫ মার্চ দুপুর ২টার দিকে আমি দুপুরের খাবার খেতে বাসায় যাই। দেখলাম নুরুল হক সাহেব বাসায় ঢুকছেন। আমি গাড়ি থেকে নেমে তাঁকে রিসিভ করলাম। তিনি আমার বাসায় এলেন। আমার শ্বশুর (আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার সাথে তিনি গভীরভাবে জড়িত ছিলেন) খান সাহেব ওসমান আলী ১৯ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন। সে জন্য তিনি আমাকে সমবেদনা জানালেন। তিনি বললেন, ‘চেষ্টা করেছি কিন্তু আমি বঙ্গবন্ধুর সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না, আমার এখন করণীয় কী। ট্রান্সমিটারটা আমি খুলনা থেকে আনিয়েছি। এটা ছিল একটা পরিত্যক্ত ট্রান্সমিটার। অফিসে রেজিস্টার বইয়ে এটার কোনো হিসাব নেই। সবাই এটাকে বাতিল বলে মনে করত। ওটা আমি আনিয়ে মেরামত করে চালু করেছি। ওটা কাজ করছে। ওটা নিয়ে আমি এখন কী করব।’ তিনি আরো বললেন, ‘আজকের দিনটা খুবই ক্রুসিয়াল, মনে হচ্ছে একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে।’

আমি খোকা ভাইকে বললাম, ‘বঙ্গবন্ধু বলে দিয়েছেন তোমাদের যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করবে। আমার কাছে কলম আছে, সংগঠন আছে, আমি এটা দিয়ে মোকাবিলা করব।’ আপনার কাছে ট্রান্সমিটার আছে, ইঞ্জিনিয়ারিং বুদ্ধি আছে, আপনি ওটা দিয়েই মোকাবিলা করবেন। আমি কি আপনাকে লিখে দেব ট্রান্সমিটারে কী বলতে হবে? উনি বললেন তার প্রয়োজন হবে না। আমি জানি কী বলতে হবে। এক ধরনের আত্মবিশ্বাসের ভঙ্গিতে অথচ নির্লিপ্তভাবে তিনি যেন নিজেকে নিজে শুনিয়ে বললেন ‘I know, it may cost my life; but it may be worth doing and I will do it.’

২৫ মার্চ নুরুল হক মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধুর বাসায় ফোন করেন। হাজি গোলাম মোরশেদের সাথে তাঁর কথা হয়। হাজি গোলাম মোরশেদ বললেন, আপনি কে? উনি পরিচয় না দিয়ে বললেন যে, বঙ্গবন্ধুকে বলেন আমি বলধা গার্ডেন থেকে বলছি, মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছি, এখন মেশিন কী করব? তখন বঙ্গবন্ধু পাশে ছিলেন। তিনি হাজি গোলাম মোরশেদকে বললেন যে, ওই ব্যক্তিকে বলো কাজ শেষ করে মেশিন ভেঙে পালিয়ে যেতে। আমার ধারণা, ওই ব্যক্তি ছিলেন নুরুল হক। তিনি খুলনা থেকে আনা ট্রান্সমিটারে এই রাতে স্বাধীনতার বার্তা পাঠিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ওয়্যারলেসে ইংরেজিতে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয়। এ বিষয়ে লন্ডনের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাংবাদিক ও দক্ষিণ এশিয়া করেসপনডেন্ট ডেভিড লোশাক লিখেছেন যে, ঘোষণাকারীর গলার আওয়াজ খুব ক্ষীণ ছিল। খুব সম্ভবত ঘোষণাটি আগেই রেকর্ড করা ছিল। উল্লেখ্য যে, ডেভিড লোশাক সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন।

হাজি গোলাম মোরশেদের সাথে ৫৬ সিম্পসন রোডে যুক্তফ্রন্টের অফিসে আমার প্রথম পরিচয়। মোরশেদ ভাই এবং আমি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে নির্বাচনী প্রচারে যশোর, খুলনার বিভিন্ন জায়গায় সফরসঙ্গী ছিলাম। নির্বাচনে বিজয়ের পর যখন পাকিস্তান সরকার গণরায়কে বাতিল করে ৯২(ক) ধারা জারি করে পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে যুক্তফ্রন্টের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করছিল, তখন হাজি গোলাম মোরশেদ ও আমি একই সাথে রাজশাহী জেলে ছিলাম। যশোরের অধ্যাপক আবদুল হাই ও গোলাম মোরশেদের সাথে আমার তখনই পরিচয়। আমাকে উনি আপন ভাইয়ের মতো স্নেহ করেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ভেঙে দিয়ে গভর্নর শাসন জারি করা হলে বঙ্গবন্ধুসহ আমাদের বন্দী করে।

২৫ মার্চ রাতে নিজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মোরশেদ ভাই  ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে থেকে যান। অবশ্য বঙ্গবন্ধু তাঁকে রাতে থাকতে নিষেধ করেছিলেন। এ রাতে বঙ্গবন্ধুর সাথে তিনিও গ্রেপ্তার হন। তাঁকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁর ওপর চলে পাশবিক নির্যাতন। নির্যাতনের সময় তাঁকে মুজিব কা সেক্রেটারি, মুজিব কা ড্রাইভার বলে পেটানো হতো। দীর্ঘদিনের অমানবিক নির্যাতনের পর মুমূর্ষু বস্থায় তিনি ২৫ নভেম্বর মুক্তিলাভ করেন।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার মেসেজ সব জেলা ও মহকুমা প্রশাসকদের কাছে ২৭ মার্চ পৌঁছে যায়। লিফলেট আকারে এগুলো প্রচার করা হয়। আমি যখন তাজউদ্দীন ভাইকে নিয়ে চুয়াডাঙ্গা পৌঁছাই, তখন সেখানে দেখি হাজার হাজার মানুষ যোদ্ধায় পরিণত হয়েছে। জানলাম এখানেও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পৌঁছে গেছে।

তাজউদ্দীন আহমদসহ আমি যখন ভারতে প্রবেশ করি, তখন বিএসএফের কাছ থেকে আমরা জানতে পারি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার মেসেজটা তাদের ওয়্যারলেসেও ধরা পড়েছে। প্রত্যেক বর্ডারে এ মেসেজ পাঠানো হয়। আমার ধারণা, নুরুল হক সাহেব এ কাজটা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা ওয়্যারলেস ট্রান্সমিটার, টেলিগ্রাম, টেলিপ্রিন্টার ও টেলিগ্রাফের টরেটক্কা সংকেত হিসেবে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতা ঘোষণার ভিত্তিতেই পরবর্তী সময়ে প্রস্তুত করেছিলাম স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (Proclamation of Independence)। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন... অতএব ওই দিন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা কার্যকর হবে।

বাঙালি জাতির পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করার একমাত্র অধিকার ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। তিনিই ছিলেন বাঙালি জাতির একমাত্র ও অবিকল্প প্রতিনিধি। তাঁর পক্ষে জনগণের ম্যান্ডেট ছিল। ১ মার্চে পূর্বাণী হোটেলের অধিবেশনে বাংলাদেশের নির্বাচিত সব জনপ্রতিনিধির পক্ষ থেকে সর্বসম্মতিক্রমে বঙ্গবন্ধুকে বাঙালি জাতির স্বার্থে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়।  

নুরুল হক সাহেব ওয়্যারলেসে যেসব সংকেত সেটআপ করে রেখেছিলেন, তা পাকবাহিনী ইন্টারসেপট্ করে। ২৬ মার্চ থেকেই পাক আর্মি পাহারায় নুরুল হককে নিয়ে যেত আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসত। তাঁকে দিয়ে একদিন Wireless I Tele Communication যা কিছু ওলটপালট করা ছিল সেগুলো ঠিক করিয়ে নেয়। হঠাৎ একদিন পাক আর্মি ট্রান্সমিটার খুঁজতে নুরুল হকের ওয়্যারলেস কলোনির বাসা ঘেরাও করে। ২৯ মার্চ, ১৯৭১ সকালে নুরুল হককে পাক আর্মি তাঁর বাসা থেকে নিয়ে যায়। তিনি আর ফিরে আসেননি।

স্বাধীনতার এতগুলো বছর পর আজও যখন নুরুল হক ওরফে খোকা ভাইয়ের কথা মনে হয়। তাঁর সেই উক্তিটি আমার কানে এখনো খুবই জীবন্ত শব্দের মতো অনুরণিত হয় : At the cost of my life । এসব কথা মনে হলে আজও আমার শরীর শিউরে ওঠে। এত বড় আত্মদান। তাঁকে কোনো যোগ্য সম্মান বা স্বীকৃতি কী আমরা দিতে পেরেছি? তাঁর পরিবারের খোঁজখবর কজন নিয়েছে?

২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা বিভিন্ন বিদেশি পত্রিকায় ফলাও করে প্রচারিত হয়। গোটা বিশ্বে আলোড়িত হয়। ব্রিটেনে The Times I The Financial Times, আমেরিকায়  New York Times, ভারতের The Times of India ইত্যাদি পত্রিকার ২৭ মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। ১৯৭১ সালে মেজর সিদ্দিক সালিক ছিলেন ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা। পরবর্তী সময়ে তিনি ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ নামে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে একটি বই লিখেছেন। এ বইয়ে বঙ্গবন্ধুর ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন When the first shot had been fired, the voice of Sheikh Mujibur Rahman came faintly through on a wavelength close to that of the Pakistan Radio. In what must have been, and sounded like, a prerecorded message, the Sheikh proclaimed East Pakistan to be the People’s Republic of Bangladesh.

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় বেতারে বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে এক ঔদ্ধত্যপূর্ণ ভাষণ দিলেন। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে তিনি বললেন, His obstinacy, obduracy and absolute refusal to talk sense can lead to but one conclusion – the man and his party are enemies of Pakistan and they want East Pakistan to break away completely from the country. He has attacked the solidarity and integrity of this country – this crime will not go unpunished.

বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনকে বাজি রেখে সারা দেশের মানুষের মধ্যে শুধু নয়, গোটা পৃথিবীতে একটা অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করলেন। মুক্ত শেখ মুজিবের চেয়ে ইয়াহিয়ার কারাগারে বন্দী শেখ মুজিব আরো অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী থেকে শুরু করে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী পদগোর্নি বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দাবি জানালেন।

২৫ মার্চ কালরাত্রিতে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর বাসায় রেখে ছেড়ে যেতে আমাদের কষ্ট হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু জেলে থেকে এ যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁকে রাষ্ট্রপ্রধান করে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র রচিত হয় এবং তাঁরই নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত তাঁর নির্দেশে সরকার ও প্রশাসন পরিচালিত হয়েছে। তাঁর এসব নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালিত হতো। তিনি যাঁদের নিয়ে এ দায়িত্ব পালন করতেন, তাঁদের আমরা হাইকমান্ড বলতাম। আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তিনজন সহসভাপতি (সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও খন্দকার মোশতাক আহমদ), ঢাকায় অবস্থিত কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ এবং পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামানকে নিয়ে গঠিত ছিল হাইকমান্ড।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রতিটি ট্রেনিং ক্যাম্পে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তৃতা মুক্তিযোদ্ধাদের মোটিভেশনের জন্য একটা বড় অস্ত্র ছিল। শরণার্থী ক্যাম্পে, ইয়ুথ ক্যাম্পে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধে পাঠানোর সময় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ তাঁদের উজ্জীবিত করত।

 

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা এবং বিদেশি গণমাধ্যমের খবর

১৯৭১, ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা বিভিন্ন বিদেশি পত্রিকায় ফলাও করে প্রচারিত হয়। কয়েকটি নমুনা নিম্নরূপ : 

 

The Times, Saturday March 27, 1971  :

Civil war raged in the eastern region of Pakistan night after the provincial leader Shaikh Mujibur Rahman , had proclaimed the region an independent republic.

The Financial Times, Saturday March 27, 1971  :

Civil war broke out in East Pakistan yesterday after Sheikh Mujibur Rahman declared an `Independent People’s Republic of Bangladesh’.

New York Times, Saturday March 27, 1971  :

Sheikh Mujib arrested after a broadcast proclaiming Region’s Independence.

The Times of India, Saturday March 27, 1971  :

A `sovereign independent People’s Republic of Bangladesh’ was proclaimed by Sheikh Mujibur Rahman today even as President Yahya Khan ordered the army to fully restore the authority; of his Government in the turbulent eastern wing.

The Declaration broadcast over `voice of Independent Bangladesh, said: `The Sheikh has declared the 75 million people of East Pakistan citizens of Independent Bangladesh’.

২৭ মার্চ ভারতের লোকসভায় সদস্যদের অনেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়ে জোরাল বক্তৃতা দেন। লোকসভার অন্যতম সদস্য এ কে গোপালন ২৭ মার্চ, ১৯৭১ লোকসভায় বলেন,

What is happening in Bangladesh, East Pakistan, is not a civil war in the real sense of a civil war. It is a war between military dictatorship on the one side and the democrative wishes and aspirations of the people of Bangladesh on the other. 

... They have also said that Sheikh Mujibur Rahman has declared the independence of Bangladesh and called the people to fight the occupation forces from West Pakistan.

লোকসভার অন্যতম সদস্য শ্রী সমর গুহ লোকসভা অধিবেশনে ২৭ মার্চ ১৯৭১ বলেন, The declaration of independence by Bangladesh is the greatest event after Partition of the Indian sub-continent. ... It is an example of a total revolution by the total people of Bangladesh against the colonial rule of West Pakistan over 75 million of that country. Mujibur Rahman has shown of the wonderful revolutionary leaderships the world has ever witnessed. {সূত্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদিত), দ্বাদশ খণ্ড}

৭ থেকে ২৫ মার্চ সময়কালে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা বাড়িতে বাড়িতে উড়েছে। বিশেষ করে ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে সারা বাংলাদেশে (বঙ্গবন্ধুর বাড়িসহ) শহর গ্রাম সর্বত্র বীরদর্পে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হয়। ৭ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত পরিচালিত সরকারে পাকিস্তানের কোনো আদেশ কার্যকর ছিল না। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সবকিছু চলছিল। তৈরি হয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি হাইকমান্ড। এর পাশাপাশি জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য একটি টাস্কফোর্স তৈরি করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন এ টাস্কফোর্সের প্রধান। ড. কামাল হোসেন ও আমি এ টাস্কফোর্সের সদস্য ছিলাম। ৩ থেকে ২৫ মার্চ এ টাস্কফোর্স থেকেই সব নির্দেশনামা তৈরি হতো এবং ডি ফ্যাক্টো সরকার তখন থেকেই কাজ করেছে। আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের সদস্যরাই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্ব দেন।

তাজউদ্দীন সাহেব ও আমি ২৫ মার্চ লালমাটিয়া থেকে সাত মসজিদ রোড পার হয়ে রায়েরবাজার সংগ্রাম পরিষদ অফিসে যাই। সেখানে তখনো রাইফেল নিয়ে অফিস পাহারা দিচ্ছে আমাদের কর্মীরা। এদের সাহস ও সংকল্প দেখে নতুন করে প্রাণ পেলাম। স্কুলের ঘণ্টা বাঁধা অফিসের সামনে সংকেতের জন্য প্রস্তুত পাড়ার সব তরুণ, যুবক, দলের নেতা-কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। গত দুদিনের বর্বর হামলা এদের সংকল্প থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। কিছুক্ষণ পর সেখানে সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি, আওয়ামী লীগ নেতা জয়নুল হক শিকদার এসে যোগ দিলেন। এখান থেকে আমরা সারা শহরের খবর সংগ্রহ করলাম। এখানেই জানলাম যে, বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাড়ির অন্যান্য সদস্য অন্য স্থানে সরে গেছে। আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ও অন্যান্য ছাত্র-যুবনেতারা কেরানীগঞ্জের দিকে চলে গেছেন। ড. কামাল হোসেনের সাত মসজিদ রোডে মোহাম্মদ মূসা সাহেবের বাড়িতে চলে আসার কথা। খবর নিয়ে জানলাম তিনি আসেননি। আমাদের পরিবারের কাছে চিরকুট পাঠালাম। শুধু তাজউদ্দীন সাহেবের চিরকুটটা পৌঁছেছিল। আমার সার্কিট হাউসের বাড়ির মালিক কাউকে বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি।

সেখানে সভা হওয়ার পর স্থানীয় লোকজন আমাদের নৌকায় তুলে দিল। আমরা নদী পার হয়ে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় পৌঁছি। সেখান থেকে জিঞ্জিরা-মৈনট রোডের ওপর দিয়ে হেঁটে রুহিতপুর গ্রাম হয়ে সৈয়দপুর ঘাটে যাই। সেখান থেকে নৌকা দিয়ে সিরাজদীখান থানার মরিচা হয়ে খারসুড় গ্রামের ওপর দিয়ে নবাবগঞ্জের চরচরিয়া গ্রামে যাই। সেখান থেকে উত্তর চুরাইনে মোখলেছ ও মতিউর রহমানের বাড়িতে সন্ধ্যা ৬টার সময় পৌঁছি। চুরাইন স্কুলের শিক্ষক ও মুন্সীগঞ্জ সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি মিজানুর রহমান যে ঘরে থাকতেন, সেই ঘরে আমি ও তাজউদ্দীন সাহেবের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। আমরা একই খাটে রাত্রিযাপন করি। রাতে এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা ও বিপ্লবী দাউদ হোসেন, মিজানুর রহমান ও আজিজুর রহমান আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তাঁদের সঙ্গে রাত ২টা পর্যন্ত আলাপ-আলোচনা করি। পরের দিন ২৮ মার্চ ভোর ৫টায় এ বাড়িতে চা খেয়ে আজিজ মোড়লের মোটরসাইকেলে করে নবাবগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের নেতা এমপিএ সুবিদ আলী টিপুর বাড়ি টিকরপুর গ্রামে সকাল ৬টায় পৌঁছি। সেখানে নাশতা করি। এ সময় আজিজুর রহমান প্রখ্যাত কৃষক নেতা জিতেন ঘোষকে সঙ্গে নিয়ে আসেন দেখা করার জন্য। তাঁদের সবাইকে নিয়ে বৈঠক ও আলাপ-আলোচনা করি। বৈঠকে সুবিদ আলী টিপু, জিতেন ঘোষ, আজিজুর রহমান ফকুসহ সব নেতা-কর্মী একমত হন যে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সরকার গঠন করা দরকার এবং এ জন্য ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা প্রয়োজন। উল্লেখ্য, ঢাকা থেকে আসার পথে রায়েরবাজার সংগ্রাম পরিষদের অফিসে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলাম। সারা পথে তিন-চার জায়গায় এমন বেশ কয়েকটি বৈঠক হয়েছে। তাঁরা সবাই একই রকম মতামত দিয়েছেন। তাঁদের চিন্তা ও কর্তব্য করণীয় সম্পর্কে ধ্যান-ধারণা একই। ২৫ মার্চের রাতে ঢাকা শহরে যে এটম ও গণহত্যা শুরু হয়েছে, সেই বর্বর আক্রমণ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ অনুযায়ী ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করো। যদি এই দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা হয়, বাঙালিরা বুঝে শুনে কাজ করবেন।’ জনগণকে প্রতিটি গ্রাম, মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার যে আহ্বান জানিয়েছিলেন তা যেন অক্ষরে অক্ষরে পালিত হচ্ছে। ২৭ মার্চ থেকে পরবর্তী সময়ে আমাদের এই দীর্ঘ পথচলার প্রতিটি স্থানে আমরা তা লক্ষ করেছি সর্বত্র।

আজিজ মোড়ল ও টিপু সাহেবের মোটরসাইকেলে করে দোহার থানা আওয়ামী লীগ নেতা ও এমএনএ আশরাফ আলী সাহেবের বাড়ি পৌঁছি। সেখানে আমরা গোসল সেরে কাঠের দোতলা বাড়িতে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করি। দুপুরে খাওয়ার পর পদ্মা নদী পার হওয়ার জন্য ঔরঙ্গবাদ গ্রামে পৌঁছি। তখন প্রমত্তা পদ্মায় ঢেউয়ের পর ঢেউ এবং তুফান, এ জন্য মাঝিরা নদী পার হওয়ার জন্য নৌকা ছাড়তে রাজি হলো না। অপেক্ষা করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আমরা তখন পদ্মার তীরে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে আছি। পদ্মাতীরের পাশে ঔরঙ্গবাদ গ্রামে বহু সদস্যবিশিষ্ট এক যৌথ পরিবারের বাড়িতে রাত্রি যাপন করি। পরিবারের কর্তার নাম শুকুর মিয়া।

২৯ মার্চ সকালে নৌকায় করে পার হয়ে ফরিদপুরের নাড়ারট্যাক নামক জায়গায় পৌঁছি। নাড়ারট্যাক একটা বিশাল চর। সেখানে কোনো চাষাবাদ নেই। তখন বাড়িঘর, বসতও ছিল না। পুরো চর ঝোপঝাড়, বুনো ঘাস, কাশবন ও আগাছায় ভরা। সেখানে যাতায়াতের একমাত্র বাহন হলো ঘোড়া। স্থানীয় লোকজন আমাদের জন্য দুটি ঘোড়া সংগ্রহ করে এনে দিলেন। সে দুটি ঘোড়ায় চড়ে আমরা ফরিদপুর শহরের উপকণ্ঠে এসে পৌঁছালাম। সেখান থেকে একজন রিকশাওয়ালার সাহায্যে ফরিদপুরে আওয়ামী লীগ নেতা ইমাম উদ্দিনের বাড়িতে পৌঁছি। ওখান থেকে দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে কিছুটা রিকশায়, আর বেশির ভাগই হেঁটে কামারখালী পৌঁছি।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে যে নির্দেশ ছিল, তা ওই অঞ্চলের মানুষ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। এসবের সাক্ষ্য বহন করছে মূল সড়কের ভাঙা পুল-কালভার্টগুলো। ফলে আমরা প্রায় পুরো পথ হেঁটে কামারখালী থেকে মাগুরা শহরে পৌঁছি। সেখান থেকে আওয়ামী লীগ নেতা সোহরাব হোসেনের বাড়ি পৌঁছাতে আমাদের প্রায় ভোর হয়ে যায়। সেখানে সোহরাব হোসেনের স্ত্রী ভোরবেলায় গরম ভাত রান্না করে খাওয়ান। সেখানে একটু বিশ্রাম করার পর একটা পুরাতন জিপ নিয়ে জেলা বোর্ডের রাস্তা দিয়ে ঝিনাইদহ পৌঁছি। এখানে স্থানীয় এমপিএ আবদুল আজিজের বাসায় উঠি। সেখান থেকে এসডিপিও (সাবডিভিশনাল পুলিশ অফিসার) মাহবুব উদ্দিনের জিপে করে ৩০ মার্চ চুয়াডাঙ্গায় পৌঁছি। ওই দিনই কুষ্টিয়া শত্রুমুক্ত হয়। পুলিশ, ইপিআর ও লক্ষাধিক জনগণ সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ গড়ে তোলে সেই যুদ্ধে তৃতীয় বেলুচ রেজিমেন্ট সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়। ফলে তাদের সব অস্ত্র আমাদের হস্তগত হয়। সেখানে হাজার হাজার লোক মিছিল করে। তখন পুলিশ, ইপিআর ও সৈন্যবাহিনী নিয়ে যশোর ক্যান্টনমেন্ট দখল করার জন্য ঝিনাইদহ-যশোর সড়কে ট্রাক মিছিল চলছে। খবর পেলাম যশোর ক্যান্টনমেন্ট অবরুদ্ধ অবস্থায়। লাখ লাখ লোক চারদিকে ঘিরে রেখেছে।

(চলবে)

এম আমীর-উল ইসলাম : মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও আইন বিশেষজ্ঞ