প্রতিক্রিয়া

পিতৃতুল্য শিক্ষক হত্যার বিচার চাই

Looks like you've blocked notifications!
অধ্যাপক ড. এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথিতযশা শিক্ষক অধ্যাপক ড. এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী। প্রতিদিন বাসা থেকে বের হয়ে শালবাগান মোড়ে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়িতে উঠতেন। গন্তব্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। আজও তার ব্যতিক্রম করবেন না বলেই সময়মতো বেরিয়ে পড়েছিলেন সকাল ৭টা নাগাদ। কিন্তু শেষ যাত্রাটা হলো বেদনাবিধূর। আজ তিনি নির্ধারিত বাসে করে ক্যাম্পাসে না পৌছে রক্তাক্ত শরীরে পড়ে থাকলেন রাস্তায়! বাসা থেকে বের হয়ে বাস ধরার এ যাত্রাটাই তাঁর শেষ যাত্রা হয়ে রইল। বাসা থেকে মাত্র ১০০ গজ দূরে শালবাগান মোড়ের গলির মধ্যে দুর্বৃত্তরা তাঁকে পেছন থেকে কুপিয়ে হত্যা করে মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়। মৃত্যু নিশ্চিত করতে তাঁর ঘাড়ের বাম পাশে ধারালো অস্ত্রের আঘাত করা হয়। কী নিমর্ম! যে বাসার সামনে তাঁকে হত্যা করা হয়, তারা পুলিশকে খবর দেয়। এরপর পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়।

পরিবারের ভাষ্যমতে, অধ্যাপক রেজাউল করিম কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। কারো সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত শক্রতাও ছিল না। তাহলে কেন এ হত্যাকাণ্ড? বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। এ রকম হত্যাকাণ্ড আজ নিয়মিত। ঠিক এই একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে গত বছরের ১৫ নভেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন চৌদ্দপাই এলাকায় দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত অবস্থায় পাওয়া যায়। তিনি সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম শফিউল ইসলাম লিলন। পরে বিকেল ৪টার দিকে রামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক হত্যাকাণ্ড দুটি আমাদের অসভ্যতার প্রমাণ দেয়। আমরা আজ কত নিষ্ঠুর যে পিতৃতুল্য শিক্ষককে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করতেও কুণ্ঠাবোধ করি না। এ রকম হত্যাকাণ্ড ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকলে আমরা সেই বিচারহীনতার সংস্কৃতিই দেখতে পাই। যার ফলে ঘটনাগুলো বারবার ঘটতে থাকে। আর আমরা অসহায় হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখি। কিছুদিন প্রতিবাদ-প্রতিরোধের আগুন জ্বললেও অন্য একটি ইস্যু সামনে চলে আসে। সেটা নিয়ে আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ি। আর যৌক্তিক বিষয়গুলো ভুলতে বসি!

এটা চিন্তা করতে বেশ অবাক লাগে যে এ দেশে একজন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপককে দিনে-দুপুরে নির্মম হত্যার শিকার হতে হয়! মাঝে মাঝে বেশ অসহায় মনে হয়। আর প্রশ্ন জাগে জননিরাপত্তা তুমি কার? সমাজের প্রথম শ্রেণির ব্যক্তিদের যেখানে নিরাপত্তা নেই, সেখানে সাধারণ আমজনতা কোথায় যাবে?

এরই মধ্যে দেশব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী সবাই আন্দোলন করছেন। রাবির সিনেট ভবনের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। শিক্ষকরা ক্লাস বর্জনের কর্মসূচি দিয়েছেন। শিক্ষার্থীরা তাঁদের অবস্থান জানান দিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আলোচনা-সমালোচনা আর প্রতিবাদে মুখর। সবার একটাই দাবি-এ হত্যার বিচার চাই। পুলিশ প্রশাসন এ হত্যাকাণ্ডকে ব্লগার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মিল রয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে। সময় গড়ালে বোঝা যাবে আসল ঘটনা কী? যদি বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়, তাহলে বিচার পেতে সময় লাগবে না। অন্যথায় প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ চলতে থাকবে। শিক্ষক হত্যার বিচার চান ছাত্র-শিক্ষক সবাই।

যদি তিনি বাসে উঠে যেতেন, তাহলে বোধ হয় বেঁচে যেতেন। আহা! বাসে উঠতে পারলেন না, তার আগেই শেষ। ‘ওর এই সংবাদে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি! এত বড় দায়িত্ব আমাকে দিল? ছেলেমেয়ে একটাকেও বিয়ে দিতে পারলাম না। সন্তানদের লেখাপড়া শেষ হলো না,’ একজন সদ্য প্রয়াত বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকের স্ত্রীর এ ধরনের আহাজারি আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়ে যায়। নিহত অধ্যাপক রেজাউল করিমের দুই সন্তান। ছেলে রিয়াসাত ইমতিয়াজ সৌরভ রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। মেয়ে রেজোয়ানা হাসিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী। প্রয়াত অধ্যাপক রেজাউল করিম ছিলেন উদার সংস্কৃতিমনা। লেখালেখিও করতেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর বাগমারা এলাকায়। সেখানে উনি একটা  মিউজিক (সংগীত) স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন ছেলেমেয়েদের গান শেখানোর জন্য।

একজন শিক্ষাবিদ, উদার চিন্তার মানুষকে এভাবে হত্যার দায়ভার কে নেবে? কোনো সভ্য সমাজে এমনটা ঘটতে পারে, সেটা ধারণার বাইরে। কোনো যুক্তি দিয়েই এসব হত্যাকাণ্ডের দায় মেটানো সম্ভব নয়। কিছুটা বেদনা কমানো সম্ভব যদি বিচারটা পাওয়া যায়। সামাজিক অবক্ষয়ের এই ধারাবাহিকতা তাহলে বোধহয় একটু পরাজিত হবে। জয় হবে প্রতিবাদের। প্রতিবাদ আর প্রতিরোধে রাজপথের মানববন্ধন আর কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা সার্থক হবে। অন্তত আর কিছু না হোক অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষ আরো সোচ্চার হতে শিখবে। এসব ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক একটা বিচারই আমাদের বিবেককে জাগিয়ে তুলতে পারবে বলে বিশ্বাস। সুতরাং চাওয়া একটাই- পিতৃতুল্য শিক্ষক হত্যার দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।

 

লেখক : ডেইলি দ্য সান পত্রিকার শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি।