স্মরণ

মাহফুজুল হক খান, আমার স্যার

Looks like you've blocked notifications!

শৈশবে প্রিয় নায়কদের মধ্যে ইত্তেফাক আর অবজারভার ছিল। বাসায় দুটোই রাখতেন বাবা। অন্য কিছুর জন্য পয়সা না থাকুক, পত্রিকা দুটো রাখা চাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা নিয়ে পড়তে এসে একপর্যায়ে এডিটিং কোর্সে পেলাম মাহফুজুল হক খান স্যারকে। জানতে পারলাম তিনি অবজারভারের বার্তা সম্পাদক ছিলেন। যাক, অফিসে-মাঠে সাংবাদিকরা কীভাবে কাজ করেন তা জানার একটা পথ হলো। তবে স্যারের সঙ্গে সখ্য ক্লাসের বাইরেই হয়েছে বেশি। জানতেন অনেক। জানাতেনও। কিন্তু বড় প্রচারবিমুখ।

গতকাল রাতেই শুনতে পেলাম দুঃসংবাদ। তখনো স্যার স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আজ মঙ্গলবার সকালে শুনলাম মাহফুজ স্যার নেই।

২০০৯-এর দিকের কথা। সবে অনার্স শেষ। প্রথম আলোতে কাজ করি রিপোর্টিংয়ে। তখন প্রথম আলো অনলাইন গোছানো হচ্ছে কেবল। শুনলাম মাহফুজ স্যার যোগ দিয়েছেন। দৌড়ে গেলাম চারতলা (তখন সিএ ভবনে)। স্যার ব্যস্ত হয়ে কাজ করছিলেন, তা আমলে না নিয়েই পায়ে ধরে সালাম। স্যার আমাকে চিনতে পেরেছেন? লাজুক ভঙ্গিতে বললেন, তোমার রিপোর্ট কিন্তু পড়ি। বললাম, স্যার এবার আরো সাবধান হলাম। কী না কী লিখে ফেলি। স্যার আবারও লাজুক ভঙ্গিতে বললেন, লেখার পাশাপাশি এডিটিংয়ের কৌশলটা মাথায় রাখবে। দিব্যি মনে আছে। মনে হয় সেদিনের কথা।   

হুট করে সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়ে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেই। বিভাগের জার্নালের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান। অনেককে আমন্ত্রণ করা হয়েছে। এসেছেনও অনেকে। মাহফুজ স্যারকে একাধিকবার ফোন দেই। স্যার এসেছিলেন অনুষ্ঠানের ঠিক আগে। শিক্ষকদের রুমে বসে চা, মিষ্টি খেলেন। আমাকে ডেকে ছোট একটা অনুরোধ করলেন, ‘আমিন, তোমরা ডাকাতে আমি এসেছি। আমাকে এখন অনুষ্ঠানে নিও না প্লিজ। তোমাদের সঙ্গেই দেখা করতে এসেছি।’ বুঝলাম অভিমান আছে তাঁর। কার ওপর, কেন তা জানার ইচ্ছে করল না।

হাঁপিয়ে উঠেছিলাম ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে। যে কজন নিয়মিত আমার মাথা ঠান্ডা রাখতেন, তার মধ্যে মাহফুজ স্যার একজন। ফেসবুকে নিয়মিত চ্যাট হতো। স্যার বলতেন, ‘আমিন তুমি হলে আগাগোড়া সাংবাদিকমনা। তোমাকে সাংবাদিকতাতেই মানাবে। চেষ্টা করো। সাংবাদিকতা সবাইকে দিয়ে হয় না। এটাও সাধনার ব্যাপার। তোমার মধ্যে এ চেষ্টাটা আছে। অসম্ভব অনুপ্রেরণা পেতাম। মাস্টারি ছেড়ে দিয়ে হাবিজাবি কাজ করি। স্যার বলেন, করো। কিন্তু আসল কাজটা ভুলো না।’

ফেসবুকের চ্যাট অপশনে গিয়ে যে কয়টা মানুষকে যন্ত্রণা দিতাম, তার মধ্যে স্যার একজন। এটা কি, ওটা কী? এসব। স্যার ধৈর্য ধরে শুনতেন। আর উত্তর দিতেন। নতুন কী করা যায় সে ভাবনা ভাবতে বলতেন।

স্যারকে আরো একটা বিষয়ে যন্ত্রণা দিতাম। স্যার লিখুন। যা জানাতে চান তাই লিখুন। সম্পাদনার কৌশল, সাংবাদিকতার ধরন নিয়ে, দেশ নিয়ে, সমকালীন সমাজ নিয়ে। স্যার বলতেন, দেখি। যদি পারি লিখব। আমি বলতাম স্যার, আপনি এ কথা অনেকদিন ধরেই বলছেন। কিন্তু লিখছেন না। এক কাজ করি। রেকর্ডার আর কাগজপত্র নিয়ে চলে আসি। চা খেতে খেতে আপনি যা বলবেন তাই রেকর্ড করব, খাতায় টুকে নেব। স্যারের এক কথা, ‘আচ্ছা এসো।’ যাব যাব করে যাওয়া হয়নি। যাওয়া আর হলোও না।

আড়ালে থাকতে চাইতেন, আড়ালেই থেকে গেলেন।

প্রতিবছর ফেসবুকের কল্যাণে কয়েকজন কাছের মানুষ আমার বিয়েবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা জানান। তাঁর মধ্যে মাহফুজ স্যার ছিলেন একজন। অসম্ভব ভালো লাগত স্যারের শুভেচ্ছা পেয়ে। স্যার বলতেন, ‘তোমার বিয়ের তারিখটা আমার দিব্যি মনে থাকে। ওই তারিখে আমিও যে বিয়ে করেছিলাম!’

লেখক : সাংবাদিক