১০৫তম জন্মবার্ষিকী

চেতনার আলোকবর্তিকা প্রীতিলতা

Looks like you've blocked notifications!

বিপ্লবী কন্য প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। একটি নাম। শতকোটি চেতনার গর্বিত শিহরণ। যিনি ছিলেন সদা অবিচল তাঁর কর্তব্যনিষ্ঠায়, দেশপ্রেম চেতনায়, মুক্তির আকাঙ্ক্ষায়। যাঁর কাছে তাঁর নিজের জীবনের চেয়েও বেশি মূল্যবান ছিল দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মুক্তি। 

স্বেচ্ছা-আত্মাহুতির আগে প্রীতিলতা তাঁর মায়ের কাছে লিখেছিলেন, 'মাগো, অমন করে কেঁদো না! আমি যে সত্যের জন্য, স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে এসেছি, তুমি কি তাতে আনন্দ পাও না? কী করব মা? দেশ যে পরাধীন! দেশবাসী বিদেশির অত্যাচারে জর্জরিত! দেশমাতৃকা যে শৃঙ্খলভাবে অবনতা, লাঞ্ছিতা, অবমানিতা! তুমি কি সবই নীরবে সহ্য করবে মা? একটি সন্তানকেও কি তুমি মুক্তির জন্য উৎসর্গ করতে পারবে না? তুমি কি কেবলই কাঁদবে?'

ভারত উপমহাদেশের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নারী মুক্তিযোদ্ধা ও আত্মোৎসর্গকারী প্রথম নারী বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের আজ ১০৫তম জন্মবার্ষিকী।

১৯১১ সালের ৫ মে মঙ্গলবার চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামে জন্ম প্রীতিলতার। তাঁর মা আদর করে তাঁকে ‘রানী’ বলে ডাকতেন। তাঁর ছদ্মনাম ছিল ফুলতার। বাবা জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার ছিলেন চট্টগ্রাম মিউনিসিপাল অফিসের প্রধান কেরানি। মা প্রতিভাদেবী ছিলেন গৃহিণী।

জগদ্বন্ধু ও প্রতিভা দম্পতির ছয় সন্তান ছিল—মধুসূদন, প্রীতিলতা, কনকলতা, শান্তিলতা, আশালতা ও সন্তোষ। জগদ্বন্ধু পরিবারের আদি পদবি ছিল দাশগুপ্ত। তাঁদের বংশের কোনো এক পূর্বপুরুষ নবাবি আমলে 'ওয়াহেদেদার' উপাধি পেয়েছিলেন। সেই সূত্রে ‘ওয়াহেদেদার’ থেকে ‘ওয়াদ্দেদার’ বা ‘ওয়াদ্দার’ হয়।

জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার তাঁর শৈশবে পিতার মৃত্যুর পর সপরিবারে পৈতৃক বাড়ি পটিয়ার ডেঙ্গাপাড়া ছেড়ে আসেন। আশ্রয় নেন ধলঘাট গ্রামের মামাবাড়িতে। প্রীতিলতার জন্মও হয় এই বাড়িতে। পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রাম শহরের আসকার খানের দীঘির দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ে টিনের ছাউনি দেওয়া মাটির দোতলা বাড়িতে স্থায়ীভাবে বাস করতেন তাঁরা। ছেলেবেলায় প্রীতিলতা অন্তর্মুখী, লাজুক এবং মুখচোরা স্বভাবের ছিলেন। মাকে ঘরের নানা কাজে সহযোগিতা করতেন।

প্রীতিলতার পড়াশোনার হাতেখড়ি তাঁর মা-বাবার কাছে। অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী প্রীতিলতার প্রাথমিকের অনেকটা ধাপ বাড়িতেই শেষ করেন। তাই ১৯১৮ সালে তাঁকে সরাসরি ডা. খাস্তগীর উচ্চ ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন তাঁর বাবা। প্রতিটি শ্রেণিতে তিনি প্রথম কিংবা দ্বিতীয় স্থান পেতেন। অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পান প্রীতিলতা।

১৯২৮ সালে কয়েকটি বিষয়ে লেটার মার্কস পেয়ে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক (এসএসসি) পাস করেন। এর পর ঢাকার ইডেন কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন। ১৯৩০ সালে আইএ (এইচএসসি) পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং সম্মিলিতভাবে পঞ্চম স্থান লাভ করেন। কলকাতার বেথুন কলেজে যান বি এ পড়তে। 

১৯৩২ সালে ডিসটিংশান নিয়ে বিএ পাস করেন। যোগ দেন চট্টগ্রামের নন্দকানন অপর্ণা চরণ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে। প্রীতিলতা ছিলেন মেধাবী ও সংস্কৃতিমনা। ভালো বাঁশি বাজাতে পারতেন। বেথুন কলেজে থাকা অবস্থায় বানারসি ঘোষ স্ট্রিটের হোস্টেলের ছাদে বসে বাঁশি বাজাতেন। আর তা উপভোগ করতেন কলেজের মেয়েরা। 

প্রীতিলতার মধ্যে বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ ঘটে স্কুলজীবনেই। দশম শ্রেণির ছাত্রী থাকাকালে তিনি ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত ‘দেশের কথা’, ‘বাঘা যতীন’, ‘ক্ষুদিরাম’, ‘কানাইলাল’ প্রভৃতি বই লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তেন। এভাবে তিনি বিপ্লবী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন। এ ছাড়া ইডেন কলেজে পড়ার সময়ে বিপ্লবী সংগঠন ‘দীপালী সংঘ’র সঙ্গে যুক্ত হন। এই কলেজের শিক্ষক ‘নীলিমাদি’র মাধ্যমে লীলা রায়ের সঙ্গে পরিচয় হয় প্রীতিলতার। এঁদের প্রেরণায় দীপালী সংঘে যোগ দিয়ে প্রীতিলতা লাঠিখেলা, ছোরাখেলা রপ্ত করেন। 

প্রীতিলতা তাঁর এই বিপ্লবী চেতনা সম্পর্কে লিখেছিলেন এভাবে, ‘আইএ পড়ার জন্য ঢাকায় দুই বছর থাকার সময় আমি নিজেকে মহান মাস্টারদার একজন উপযুক্ত কমরেড হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়েছি।’ 

বিএ পরীক্ষা শেষে মাস্টারদার নির্দেশে স্থায়ীভাবে চট্টগ্রাম চলে আসেন প্রীতিলতা। মাস্টারদা সূর্য সেন তাঁকে বিপ্লবী কাজে আরো বেশি সক্রিয় হওয়ার তাগিদ দেন।

১৯৩২ সালের মে মাসে প্রীতিলতার জন্মস্থান ধলঘাটে সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে মাস্টারদা তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে গোপনে বৈঠক করেন। বৈঠক চলার সময় ব্রিটিশ সৈন্যদের সঙ্গে তাঁদের বন্দুকযুদ্ধ শুরু হয়। এতে প্রাণ হারান নির্মল সেন ও অপূর্ব সেন। সূর্য সেন প্রীতিলতাকে নিয়ে বাড়ির পাশে ডোবার পানিতে ও গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকেন। সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর মাস্টারদা বলেন, ‘প্রীতি, তুমি বাড়ি ফিরে গিয়ে স্কুলের কাজে যোগ দেবে, তাহলে গত রাতের ঘটনায় কেউ তোমাকে সন্দেহ করবে না।' 

কিন্তু এ ঘটনার পর ব্রিটিশ সরকার ঠিকই প্রীতিলতাকে সন্দেহ করতে শুরু করে। তিনি তখন মাস্টারদার নির্দেশে আত্মগোপনে চলে যান। এ সময়ে বিপ্লবীদের অন্য একটি দল ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণে ব্যর্থ হয়। ফলে মাস্টারদা প্রীতিলতাকে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের দায়িত্ব নিতে বলেন। তিনি তখন চট্টগ্রামের কাট্টলী সমুদ্রসৈকতে বিপ্লবী দলকে সামরিক প্রশিক্ষণ দেন।

১৯৩২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর গোপন বৈঠকে মাস্টারদার নির্দেশে প্রীতিলতা ও কল্পনা দত্ত ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনা করার জন্য দক্ষিণ কাট্টলীর একটি গ্রামের উদ্দেশে পুরুষের বেশে রওনা দেন। কিন্তু পথে পাহাড়তলীতে কল্পনা দত্ত ধরা পড়েন। প্রীতিলতা নিরাপদে নির্দিষ্ট গ্রামে এসে পৌঁছান। এখানেই তাঁর নেতৃত্বে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনা হয়। কাট্টলীর সাগরতীরে প্রীতিলতা ও সঙ্গীদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু হয়।

প্রশিক্ষণ শেষে প্রীতিলতার নেতৃত্বে বিপ্লবীরা ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করেন। আক্রমণ শেষে ফিরে আসার সময়ে প্রীতিলতা গুলিবিদ্ধ হন। এ অবস্থায় ধরা পড়ার আগে সঙ্গে রাখা পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। কারণ, ধরা পড়লে বিপ্লবীদের অনেক গোপন তথ্য ব্রিটিশ পুলিশের কাছে ফাঁস হয়ে যেতে পারে।

প্রীতিলতা মাত্র ২৩ বছর বয়সে মৃত্যুকে বরণ করে নেন। তাঁর আত্মদান বাংলা ও ভারতের বিপ্লবীদের আরো উদ্দীপিত ও বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে ব্যাপকভাবে সক্রিয় করে তোলে। প্রীতিলতার মৃতদেহের পোশাকে নিজ হাতে লেখা ছিল, ‘আমরা দেশের মুক্তির জন্য এই সশস্ত্র যুদ্ধ করিতেছি। অদ্যকার পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি অংশ। ব্রিটিশরা জোরপূর্বক আমাদের স্বাধীনতা ছিনাইয়া লইয়াছে।’

প্রীতিলতা আজ নেই। কিন্তু তাঁর সেই বিপ্লবী চেতনার স্ফুলিঙ্গ এখনো আমাদের উজ্জীবিত করে দেশপ্রেম এবং স্বাধিকার আন্দোলনে। তিনি মুক্তির আলোকবর্তিকা হয়ে চিরজাগরূক হয়ে আছেন আমাদের হৃদয়তন্ত্রীতে।

লেখক : শিক্ষার্থী