জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার

রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতা বয়ান

Looks like you've blocked notifications!

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মঞ্চে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সম্মানে সমবেত কয়েক হাজার দর্শক দাঁড়িয়ে গেলেন। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান উপলক্ষে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের সভাকক্ষে ঢুকেছি সেই ৩টায়। যে অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আসবেন, তাঁর আসার এক ঘণ্টা আগে ঢুকতে হয়। অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেলে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। এটাই নিয়ম।

অনুষ্ঠানস্থলে প্রধানমন্ত্রী ঢুকলেন ঠিক ৪টায়। কিংবা সোয়া ৪টায়। সময় মাপার তো কোনো যন্ত্র নেই। মোবাইল থাকলে সময় দেখে নেওয়া যেত। মোবাইলটি বাসায় রেখে গেছি। প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে মানিব্যাগ ছাড়া আর কিছু নিয়ে ঢোকা বারণ। নিরাপত্তার স্বার্থে। নিয়মটা একদিক থেকে ভালো। বাঙালির তো বিশ্বাস নেই। এই বাঙালিরাই তো তাদের জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। বঙ্গবন্ধু উদার ছিলেন। মানুষকে ভালোবাসতেন। নিরাপত্তার তেমন ধার ধারতেন না। ঘাতকরা সেই সুযোগটাই নিয়েছিল ১৫ আগস্ট। সুতরাং তাঁর কন্যার যথাযথ নিরাপত্তা বিধান যৌক্তিক।

আমি কেবিনে বসেছিলাম। শ্রদ্ধেয় কবি নির্মলেন্দু গুণ, কবি অসীম সাহা, শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পুরস্কার বিজয়ী পরিচালক মাসুদ পথিক, শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক সায়েম রানা, লেখক রেজা ঘটকসহ অন্যরা নিচতলায় বসেছেন। ঢোকার সময় লম্বা লাইনে আমি সবার পেছনে ছিলাম বলে তাঁরা আমার আগেই ঢুকে গেছেন। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বাহিনী পরে আমাকে আর নিচতলায় ঢুকতে দিল না। অনেক বলে-কয়েও কাজ হলো না। তাদের একটাই কথা―সরি, কিচ্ছু করার নেই, আপনি উপরে চলে যান। ব্যর্থ মনোরথে আমি উপরে চলে গেলাম। তা ছাড়া কী আর করব? বাড়াবাড়ি? প্রশ্নই আসে না। সোজা শ্রীঘরে নিয়ে যাবে। নিচে ঢুকতে না দেওয়াতে পরে বরং আমি খুশিই হয়েছি। কারণ নিচতলার চেয়ে কেবিনে বসে সব কিছু স্পষ্ট দেখা যায়।

যথারীতি অনুষ্ঠান শুরু হলো। একপর্যায়ে পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা হতে লাগল। প্রত্যেকে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন। ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। পরিচালকের নাম ঘোষণা করলেন উপস্থাপিকা, ‘শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পুরস্কারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার নেবেন মাসুদ পথিক মুরাদ পারভেজ।’ আমি তো অবাক! টান টান হয়ে বসলাম। ঘটনা কী? মাসুদ পথিকের নামের শেষে মুরাদ পারভেজ এলো কোত্থেকে? সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘গাছটা বলেছিল’ গল্প চুরি করে ‘বৃহন্নলা’ সিনেমা নির্মাণের অভিযোগে মুরাদ পারভেজকে তো পুরস্কারের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। পুরস্কার উপলক্ষে যত প্রকাশনা হয়েছে কোথাও তো তার নামটি নেই। তাহলে উপস্থাপিকা নামটি কোথায় পেলেন?

মনে পড়ে গেল ২০০৭ সালের একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা। বেসরকারি এক টেলিভিশনে আমার লেখা নাটক, "লেট নাইট শো" প্রচারিত হবে। পরিচালকের নামটা উহ্য থাকুক। পরে কোনো একসময় প্রকাশ করা যাবে। সম্ভবত ঈদের নাটক ছিল সেটি। নাটকটি প্রচারের এক সপ্তাহ আগ থেকে টিভিতে নাট্যকার হিসেবে আমার নাম ঘোষণা হচ্ছে, অথচ যেদিন নাটকটি প্রচারিত হবে সেদিন প্রচারের আগে ঘোষণা এল, ‘নাটকটি লিখেছেন ফেরদৌস।’ মানে জনপ্রিয় চিত্রনায়ক ফেরদৌস। আমি তো অবাক! নাটকটি নির্মাণে অর্থলগ্নি করেছিলেন ফেরদৌস, তাই বলে নাট্যকার হিসেবে তাঁর নাম প্রচার হবে কেন? ভারী তো অবাক কাণ্ড! ব্যথিত মনে আমি সেদিনই সিদ্ধান্ত নিলাম―এ কাজ আমার নয়। আমার কাজ উপন্যাস লেখা। আমি বরং তাই লিখতে থাকি।

তো আজকের ঘটনায় আমার সন্দেহ হলো, উপস্থাপিকা ইচ্ছে করেই মাসুদ পথিকের নামের শেষে মুরাদ পারভেজের নামটি যুক্ত করে দিয়েছেন; যদিও পরবর্তী ঘোষণায় আর মুরাদ পারভেজের নাম উচ্চারণ করেননি। কিন্তু প্রথমবার কেন করলেন? এটা ভুল, নাকি ইচ্ছেকৃত? আমার কাছে মনে হলো ইচ্ছেকৃতই। এটা ভুল হওয়ার পেছনে যৌক্তিক কোনো কারণই খুঁজে পেলাম না। একটি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে একজনের নামের সঙ্গে আরেকজনের নাম যোগ করে দেওয়াটা অশোভন। এর পেছনে কারো ইন্ধন আছে কি না, নাকি উপস্থাপিকার ভুল―তথ্য মন্ত্রণালয় আশা করি তথ্যটা খতিয়ে দেখবে।

সবচেয়ে বড় ভুলটা হয়েছে, তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে যে স্যুভিনিয়রটি প্রকাশিত হয়েছে সেখানে কবি নির্মলেন্দু গুণের নামটি না থাকা। অথচ ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ সিনেমাটি নির্মিত হয়েছে তাঁর কবিতা অবলম্বনেই। তাঁর নামটি উল্লেখ না করাটা দুঃখজনক। তথ্য মন্ত্রণালয় এই ভুলটি আশা করি সংশোধন করে নেবে।

প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে সবাই যখন পুরস্কার নিতে মঞ্চে উঠছিলেন দর্শকরা করতালি দিচ্ছিলেন। শ্রেষ্ঠ গায়ক হিসেবে পুরস্কার নিতে কণ্ঠশিল্পী মাহফুজ আনাম জেমস যখন উঠলেন, এমন মুহুর্মুহু করতালি শুরু হলো যে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কারটি না নেওয়া পর্যন্ত করতালি আর থামল না। জেমসের এত জনপ্রিয়তা! অথচ আমি কখনো তাঁর গান মনোযোগ দিয়ে শুনিনি। একজন সংগীতশিল্পীর এমন জনপ্রিয়তা দেখে ভালোই লাগল।

চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের জন্য আজীবন সম্মাননা দেওয়া হলো অভিনেতা সৈয়দ হাসান ইমাম ও অভিনেত্রী রানী সরকারকে। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থতায় ভুগছেন রানী সরকার। মঞ্চে উঠতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। একজনের হাত ধরে খুব কষ্ট করে উঠছিলেন। ফটো সাংবাদিকদের জন্য তিনি মঞ্চে ওঠার পথ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তখন প্রধানমন্ত্রী হাতের ইশারায় সাংবাদিকদের সরতে বললে সঙ্গে সঙ্গে সবাই সরে দাঁড়ালেন। রানী সরকার উঠে এলেন। পুরস্কার নিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর হাতে খাকি কাগজের একটা খাম গুঁজে দিলেন। সম্ভবত কোনো চিঠি। কী লেখা আছে তাতে? হয়তো তাঁর দুঃখ-দুর্দশার কথা। হয়তো চিঠি লিখে প্রধানমন্ত্রীর আরো সাহায্য কামনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী চিঠিটা টেবিলে রাখলেন। পেছন থেকে একজন দেহরক্ষী এসে চিঠিটি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত ব্যাগটিতে রেখে দিলেন।

পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান শেষ হলো। শুরু হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সঙ্গীরা দর্শকসারিতে এসে বসলেন। আমিও নেমে এলাম নিচতলায়। এবার আর কেউ বাধা দিল না। কিন্তু ভেতরে নিরাপত্তাবাহিনী সতর্ক পাহারায়। তাদের একেকটি চোখ যেন ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। কেউ ফাঁকি দেবে? অসম্ভব। দর্শকদের অনেকে বেরিয়ে গেলেন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে কবি নির্মলেন্দু গুণের খুব ঠাণ্ডা লাগছিল বলে তিনিও বেরিয়ে গেলেন। তার সঙ্গে কবি অসীম সাহাও। আমি ভাবছি কীভাবে প্রধানমন্ত্রীকে আরো কাছ থেকে দেখা যায়।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যখন শেষ হলো, প্রধানমন্ত্রী যখন চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন, দর্শকরাও যখন দাঁড়িয়ে গেল, ভিড়ের ফাঁকে আমি প্রধানমন্ত্রীর আরো কাছে এগিয়ে গেলাম। এবার আরো কাছ থেকে তাঁকে দেখলাম। আচ্ছা, তাঁকে এত দেখার কী আছে? আছে। তিনি প্রথমত বঙ্গবন্ধুকন্যা, দ্বিতীয়ত বঙ্গাধিপতি। মানে একটি দেশের রাজা। রাজারা কাছ থেকে দেখতে কেমন―এই অভিজ্ঞতার তো দরকার আছে। তা ছাড়া তিনি ইতিহাসের নায়ক। আগের দিন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বড় ঘটনা। শেখ হাসিনার পক্ষেই সম্ভব হয়েছে দেশ ও জাতির এই কলঙ্ক মোছার কাজটি সম্পন্ন করা। তিনি যখন চলে যাচ্ছিলেন, আমার খুব বলতে ইচ্ছে হলো, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি কি আপনার সঙ্গে একটা ছবি তুলতে পারি?’ কিন্তু বলা হলো না। তিনি দ্রুত বেরিয়ে গেলেন।

যা হোক, কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতা অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হলো। এই পুরস্কারটি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল ‘বৃহন্নলা’র পরিচালক মুরাদ পারভেজকে। তীব্র প্রতিবাদের মুখে সেই সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত বাতিল করা হয়। এই ব্যাপারে আমি ছিলাম সবচেয়ে বেশি প্রতিবাদমুখর। ফেসবুকে, পত্রপত্রিকায় লিখে গণমাধ্যম ও সরকারের নজরে এনেছি বিষয়টি। পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্ত হওয়ার পর আবার বাতিল হওয়ার ঘটনা সম্ভবত বাংলাদেশে এই প্রথম। বাতিল করার জন্য তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ। চুরিবিদ্যাকে নিরুৎসাহিত করতে এর বিকল্প ছিল না। এর পর আশা করি আরো কেউ লেখকের গল্প চুরি করে সিনেমা বানানোর সাহস করবে না।

‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ সিনেমাটির পেছনে বন্ধু মাসুদ পথিকের অনেক শ্রম রয়েছে। ছবিটি মোট ছয়টি ক্যাটাগরিতে পুরস্কৃত হয়েছে। এটি নিশ্চয়ই আমার জন্য আনন্দের সংবাদ। মাসুদ পথিককে অভিনন্দন। আপনার জয় হোক।

লেখক : কথাসাহিত্যিক