কথা রাখেননি সজল খালেদ!

Looks like you've blocked notifications!
অভিযাত্রী সজল খালেদ। ছবি : সংগৃহীত

তিন বছর আগের কথা। দুই বছরের ছেলে সুস্মিতকে কোলে নিয়ে স্ত্রী শৈলীর চোখে চোখ রেখে এক দৃঢ়সংকল্প অভিযাত্রী বলেছিলেন, ‘এভারেস্ট জয় করে আমি তোমাদের কাছে ফিরে আসব।’ বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট জয়ের প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছিলেন তিনি। কিন্তু ফিরে আসেননি। কথা রাখেননি সজল খালেদ। আমার সজল ভাই।

এভারেস্ট জয়ের আগে অভিযাত্রী সজল খালেদ বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলেন ভারতের সিকিমের ফ্রে পর্বত (২০০৬), হিমালয়ের মেরা পিক (২০০৭), অন্নপূর্ণা রেঞ্জের সিংগুচুলি পর্বত (২০০৮), নেপালের মাকালু (দুইবার ২০০৯ এবং ২০১১ সালে), বাংলাদেশ-নেপাল ফ্রেন্ডশিপ পিক (২০১০) প্রভৃতি পর্বতশিখরে। 

২০১৩ সালের এভারেস্ট অভিযান কিন্তু সজল খালেদের প্রথম বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ ছোঁয়ার প্রচেষ্টা নয়। ঠিক দুই বছর আগে ২০১১ সালের মে মাসে এভারেস্ট অভিযানে গিয়েছিলেন আরো একবার। সেবার উঠেছিলেন প্রায় ২৩ হাজার ফুট পর্যন্ত। কিন্তু ফুসফুসে পানি জমে অসুস্থ হয়ে নেমে আসতে হয়েছিল ওখান থেকেই।

এরপর অসুস্থ ছিলেন অনেক দিন। এভারেস্ট জয়ের এত কাছ থেকে ফিরে আসা নিশ্চয়ই মেনে নিতে পারেননি এই অভিযাত্রী। তাই সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ সংকল্পে অবিচল ২০ মে ঠিকই এভারেস্টের চূড়ায় উড়িয়েছিলেন বাংলাদেশের পতাকা। “পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়া এভারেস্ট জয় করে নামার পথে ৮,৬০০ মিটার উচ্চতায় ‘অজানা কারণে’ মারা যান তিনি।” – ইন্টারনেটের মুক্ত তথ্যভাণ্ডার উইকিপিডিয়ায় তাঁর মৃত্যুর কারণ এভাবেই লেখা। কিন্তু ‘মারা যান’ না বলে হারিয়ে যান বললেই বোধহয় ঠিক ছিল। কীভাবে হারালেন? এই অজানা রহস্য কোনোদিন উদ্ঘাটিত হবে কি না কে জানে!

অবশ্য সজল খালেদ নিখোঁজের পরপরই বাংলাদেশ ও নেপাল সরকারের উদ্যোগে তাঁর দেহ খুঁজে পেতে হেলিকপ্টারে করে দল পাঠানো হয়। কিন্তু বৈরী আবহাওয়ায় ফিরে আসে তারা।

এরপর দিনের পর দিন শৈলী ভাবি আর সজল ভাইয়ের বন্ধুরা নেপাল গিয়ে পড়ে থাকলেন। এর-ওর পেছন ঘুরলেন। লাভ হলো না। সজল খালেদ হারিয়ে যাওয়ার সময় যে শেরপা সঙ্গে ছিলেন, কোনো এক রহস্যময় কারণে সেই শেরপাও ধরা দিলেন না চোখের সামনে। আস্তে আস্তে সবার সামনে থেকে শারীরিকভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেন স্বপ্নবাজ এক দেশপ্রেমিক।

প্রায় ১০ বছর আগে সজল ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয়। বন্ধুরা মিলে লিরিক নামে একটি গানের কাগজ প্রকাশ করতাম আমরা। শিল্পী স্বপন চৌধুরীর বাসায় নিয়মিত যাতায়াত করতাম লিরিকের কাজে। একদিন স্বপনদা আমাকে ডেকে বললেন যে উনি একটি প্রদর্শনী করবেন গ্যালারি চিত্রকে; ওনার পেইন্টিং আর সজল নামে ওনার এক ছাত্রের ফটোগ্রাফি। সজল অনেক দিন পর দেশে এসেছেন। এক্সিবিশনের বিভিন্ন কাজে আমি যেন তাঁকে সাহায্য করি।

কাজ শুরু করলাম। কাজের ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক গল্প করতাম দুজন। একটু একটু করে বুঝতে শুরু করলাম মানুষটাকে। দেখে অবাক হলাম, ওনার দেশপ্রেমের গভীরতা দেখে।

কাজের ফাঁকে ফাঁকেই লিরিকের আদ্যপান্ত জানতে চাইতেন। দেশে ফিরেই সজল ভাই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নিয়ে তাঁর ডকুমেন্টারি ফিল্ম ‘একাত্তরের শব্দসেনা’র কাজ শুরু করেছিলেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ফিল্ম নিয়ে কথা হতো প্রতিদিন। মাঝে মাঝে আমাকে শুটিংয়ে নিয়ে যেতেন। কতবার তাঁর মগবাজারের বাসার চিলেকোঠায় আড্ডা দিয়েছি তার হিসাব নেই।

লিরিকের একটি সংখ্যা করেছিলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নিয়ে, যা সজল ভাইয়ের সাহায্য ছাড়া কখনো সম্ভব হতো না। ওই সংখ্যায় তাঁর একটা ইন্টারভিউও করেছিলাম আমি। সেই ইন্টারভিউতে সজল ভাই ফিল্ম সম্পর্কে যাই বলেছেন প্রতিবার ‘আমরা’ শব্দটি উচ্চারণ করেছেন। হঠাৎ একবার ভুলে ‘আমি’ বলে ফেলেছিলেন। পরে আমাকে বললেন আমরা যেন কোনোভাবেই ওনার কোনো কথায় ‘আমি’ শব্দটি ব্যবহার না করি।

সরকারি অনুদানে মুহম্মদ জাফর ইকবালের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি করেছিলেন চলচ্চিত্র ‘কাজলের দিনরাত্রি’। সেখানেও আমাকে সঙ্গে রেখেছিলেন সজল ভাই। পর্বতারোহণ নিয়ে সুবিখ্যাত পর্বতারোহী এড ভিশ্চার্সের লেখা একটি বইও অনুবাদ করেছেন, ‘পর্বতের নেশায় অদম্য প্রাণ’। প্রকাশিত হয়েছিল বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে।

যতবার সজল ভাইয়ের সামনে যেতাম একধরনের জড়তা অনুভব করতাম। এর একটাই কারণ, তাঁর সহজাত বিনয়। এত অল্প স্বরে তিনি কথা বলতেন আর সবাইকে এত সম্মান দিয়ে কথা বলতেন যে তাঁর বিশালতার সামনে নিজেকে খুব বেমানান মনে হতো।

আর সজল খালেদের এই বিনয় আর সততার সুযোগ নিয়ে অনেকেই তাঁকে ঠকিয়েছেন বহুবার। দু-একটি উদাহরণ না দিলেই না। একটি ইস্পাত কোম্পানির ব্রশিওরের কাজ করলাম আমি আর সজল ভাই। সব কাজ শেষ হওয়ার পর পেমেন্ট করল না সেই কোম্পানি। তাঁর বানানো ‘একাত্তরের শব্দসেনা’ বিক্রি হয়ে গিয়েছিল তাঁর অজান্তেই! সজল ভাই কষ্ট পেয়েছিলেন। তাঁর সেই চেহারাটা এখনো আমার সামনে ভেসে ওঠে, আর আমার চোখ ভিজে আসে। পর্বতারোহণ নিয়ে তাঁর বিভিন্ন লেখা নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছিল কোনো এক সেলিব্রিটি পর্বতারোহী।

অদ্ভুত এক স্বপ্নবাজ মানুষ ছিলেন সজল ভাই। দারুণ সব বিজনেস আইডিয়া নিয়ে প্রজেক্ট পেপার তৈরি করেছিলেন তিনি। ঢাকা শহরের ময়লা-আবর্জনা রিসাইকেল করা, কুমির আর চন্দন কাঠের ফার্ম, বিদেশ গমনে ইচ্ছুক নিরক্ষর মানুষদের প্রশিক্ষণ দেওয়া... আরো কত কি!

শুধু কি তাই! বিএমটিসি আর এক্সট্রিমিস্ট ক্লাবের হয়ে কত কিছু আয়োজন করেছেন তিনি। ঘুড়ি উৎসব, ম্যারাথন, রমনা পার্ক পরিষ্কার, সাইক্লিং আরো কত কি!

এভারেস্টে রওনা হওয়ার দু-তিনদিন আগে আমার অফিসে এসেছিলেন বিদায় নিতে। সেটাই ছিল আমার সজল ভাইয়ের সঙ্গে শেষ দেখা। এরপর তিন বছর কেটে গেছে। সজল ভাইয়ের প্রতি অভিমান এখনো যায়নি আমার। কেন গেলেন উনি এভারেস্টে! কী আছে ওখানে! 

হিমালয়ের বরফের বিশাল রাজ্যে সজল খালেদ হারিয়ে যাওয়ার পর শুরুর দিকে অনেকগুলো দিন এক অদ্ভুত মিরাকলের আশায় ছিলাম। সজল খালেদ হয়তো বেঁচে আছেন। কোনো একদিন বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে আমাদের শৈলী ভাবীর হাত ধরে দেশের মাটিতে ফিরবেন তিনি। সুস্মিতকে কোলে নিয়ে মিডিয়ার সামনে বলবেন তাঁর অলৌকিকভাবে ফিরে আসার গল্প।

অবশ্য সেই আশাটা মরে গেছে বহু আগেই। এখন ভাবি, তাঁর দেহটা হয়তো কোনোদিন খুঁজে পাওয়া যাবে এভারেস্টের বরফের কোথাও। কোনো পর্বতারোহী হয়তো খুঁজে পাবেন কয়েক বছর আগে হারিয়ে যাওয়া এক বাঙালি অভিযাত্রীর মৃতদেহ। দেশে ফিরে আসবেন সজল খালেদ। স্ত্রীকে দেওয়া কথা রাখবেন তিনি।

লেখক : প্রযুক্তিবিদ