হকি

খেলোয়াড় আমদানি করে হকি বাঁচানো যাবে কী?

Looks like you've blocked notifications!

ইউটিউব- নতুন জেনারেশনের কাছে পুরনো পৃথিবীকে ফিরিয়ে আনার সহজ এক মাধ্যম এখন। সার্চ দিলেই কত মানুষের কত সাফল্য গাথা সরবরাহ করছে প্রযুক্তিনির্ভর এই মাধ্যম। কিন্তু হকিতে বাঙালির বলার মতো কোনো সাফল্য কাহিনী খুঁজে পাচ্ছি না! যদিও ষাটের দশকে পাকিস্তান দলে দু-একজন বাঙালি হকি খেলোয়াড় খেলেছেন। ইউরোপ-আফ্রিকা ট্যুরও করেছেন। এমন কি ১৯৭১ সালে বার্সেলোনা ওয়ার্ল্ড কাপে পাকিস্তান দলে দুজন বাঙালিকে রাখা হয়েছিল। তার পেছনে অনেকে আবার রাজনৈতিক কারণও খুঁজে বেড়ান।

কিন্তু পাকিস্তানের হয়ে দুই বাঙালি হকি প্লেয়ার বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েছিলেন এটাই সত্যি। ভিডিও না থাকলেও কাগজের পাতায় সেটা আছে। তাঁদের একজন ইব্রাহিম সাবের। অন্যজন আব্দুস সাদেক।  দুজনই বাঙালির ক্রীড়া ইতিহাসে সাব্যসাচী ক্রীড়াবিদ হিসেবে থাকবেন। শুধু হকি নয়। ফুটবল, ক্রিকেট সবই খেলেছেন তাঁরা। ওই তালিকায় উপরের দিকেই থাকবেন বশীর আহমেদের নামটাও। পাকিস্তানের হয়ে তিনি এবং প্রতাপ হাজরাও একাধিক খেলায় অংশ নিয়েছেন। যদিও প্রতাপ হাজরাকে মানুষ বেশি মনে রেখেছেন ফুটবলার হিসেবে। যদিও মানুষটা অনেক বেশি হকি অন্তপ্রাণ। হকির প্রতি তাঁর টানটাও বেশি। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে হকির সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা কখনো কোচ, কখনো হকি ফেডারেশনের সদস্য হিসেবে। আব্দুস সাদেক, ইব্রাহিম সাবের স্বাধীনতার পর  আবাহনীর প্রথম হকি দলের সদস্য। আব্দুস সাদেক আরো একটু এগিয়ে। তিনি তো আবাহনীর প্রথম ফুটবল দলের অধিনায়কও। পরে  সেই আবাহনীর ফুটবল কোচও ছিলেন। এখন আবাহনীর পরিচালক এবং অস্বাস্থ্যকর এক অবস্থার মধ্য দিয়ে অনিচ্ছা নিয়ে এই মুহূর্তে বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের সহসভাপতি থেকে সাধারণ সম্পাদকের চেয়ারে! যে চেয়ার তাঁকে খুব একটা স্বস্তি দেয় না। বরং প্রায় প্রতি মুমুহূর্তে অস্বস্তি বাড়িয়ে দিচ্ছে। মার্জিত রুচি এবং স্বল্পভাষী ভদ্রলোক সেটা দিন কয়েক আগে এক চায়ের আড্ডায় পরোক্ষভাবে বলেও ফেললেন।

স্বস্তিতে তিনি থাকবেন কীভাবে? একটা লোক যে স্তরে নিজে হকি খেলেছেন, সেই তিনি দেখছেন তাঁর দেশের হকির এখন ‘গুরুদশা’ চলছে! গুরুদশা শব্দটা লিখতে হচ্ছে তাঁর এক ভালো বন্ধু ভারতীয় অলিম্পিক সোনা জয়ী হকি খেলোয়াড় গুরু বক্স সিং-এর কথা শুনে। যিনি পাঞ্জাবি হয়েও পশ্চিম বাংলার হয়ে হকি খেলেছেন। কলকাতায় বসত গড়েছেন। খেলোয়াড়োত্তর জীবনে তিনি পাশ্চিমবঙ্গ রাজ্য হকির চেহারা পাল্টাতে প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু সেখানকার হকির চেহারার কোনো বদল হয়নি। কলকাতা-ঢাকা-দিল্লি-কুয়ালালমপুর যেখানেই সাদেক-গুরুবক্স সিংয়ের দেখা হোক সেখানে দুই বাংলার হকির কথা প্রায়ই নাকি ওঠে এবং এটা খুব স্বাভাবিক। কারণ, দুজনই একই স্তরে হকি খেলেছেন। অথচ এখন দেখছেন এপার বাংলা-ওপার বাংলা দুই জায়গাতেই হকির খুব খারাপ অবস্থা। দুজনের জন্য যেটা হতাশার। দুঃখের। খানিকটা মর্মন্তাতিকও বটে।

বাংলাদেশ হকির খারাপ অবস্থার জন্য দায়ী কে? এটাও এখন খুব জরুরি এক প্রশ্ন। প্রশ্ন যখন ওঠে তখন তাঁর উত্তরও আছে। আর সেই উত্তরটা কয়েকটা অপশন থেকে টিক চিহ্ন দেওয়ার মতো নয়। ইচ্ছেমতো একটা দিয়ে দিলাম আর তাতেই হয়ে গেল। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে সেটা সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তরের মতো বড় হবে। অনেক কিছু বেরিয়ে আসবে। যাতে কেউ কেউ দুঃখ পাবেন। হতাশ হবেন। কষ্ট পাবেন। ক্ষুব্ধ হবেন। অপ্রিয় অনেক সত্য অনেকের গায়ে জ্বালা ধরাবে। তবে সব কিছুর আগে এই টুকু বলতে পারি, হকি- বাংলাদেশের খেলাধুলায় প্রথম গর্বের মিনার হতে হতেও হলো না! সেই মিনারটা গড়ে উঠছে, সেটা যখন দৃশ্যমান হতে শুরু করল তখনই হঠাৎ ধসে পড়ল! ক্রিকেটেরও আগে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ খেলার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। ১৯৯৭ সালে এক ঝাঁক ভালো হকি খেলোয়াড়ও পেয়েছিল বাংলাদেশ। মাহবুব হারুন-কামাল-সাদেক-নিক্সন-খুরশীদ-রবি অনেক নাম। যারা ১৯৯৫ সালের মাদ্রাজ সাফ গেমসে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তানের বিপক্ষে দুর্দান্ত হকি খেলে বিতর্কিত এক পেনাল্টি স্ট্রোকে হেরেছিল বটে। কিন্তু জানান দিতে পেরেছিলেন বাংলাদেশ উঠে আসছে। যে কারণে ১৯৯৭ সাল ইতালিতে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে যাওয়ার আগে হকি নিয়ে এ দেশের মানুষের স্বপ্নটা বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই স্বপ্নের সমাধি হলো আটলান্টিকের পাড়ে। তারপর থেকেই মূলত বাংলাদেশ হকির ইতিহাস মানে এক রাশ হতাশা। এখন যে অবস্থা তাতে বলতে হচ্ছে হকি বাংলাদেশের খেলাধুলার সিলেবাসের বাইরে চলে গেছে!

আর এর পেছনে ক্লাব কর্তাদের ব্যক্তিস্বাথর্, ফেডারেশন কর্তাদের সাবেকি চিন্তাভাবনা এবং সরকার আরো স্পষ্ট করে বললে বলতে হবে, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতা- সব মিলিয়ে বাংলাদেশে হকি বিস্মৃত প্রায় এক খেলা! মাঠের খেলার চেয়ে ক্লাব কর্তাদের স্বার্থকে বড় করে দেখছেন সবাই। ‘খেলব না’ বলে কয়েকটা ক্লাব গত কয়েক বছর হকির বাইরে থাকল। যেখানে কিছু খেলোয়াড়ও হকি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লেন নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থে! খেলোয়াড় কল্যাণ সমিতি নামের সাইনবোর্ড সর্বস্ব একটা সংগঠন ছিল, তার নেতাদের ভূমিকা হয়ে গেল সুতায় বাঁধা পুতুলের মতো! ক্লাব কর্তারা যেভাবে নাচিয়েছেন সেভাবে নেচেছেন! খেলোয়াড়দের স্বার্থ বিসর্জন দিতে দ্বিতীয়বার ভাবতে পারেননি তাঁরা! অনেক নাটক-টাটক করে ঘোলা পানি  খেল সেই ক্লাবগুলো। আবার মাঠে ফিরল তারা।

তারা মাঠে ফিরল। কিন্তু তাতে কী বাংলাদেশ হকির চেহারার কোনো বদল হলো। বা হবে। আপাত মনে হচ্ছে না। বরং তারা মাঠে ফেরার পর লিগ কমিটি পাঁচ বিদেশি এক ক্লাবে খেলানোর যে সিদ্ধান্ত নিল এবং ফেডারেশন তাকে যেভাবে অনুমোদন দিল, তাকে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছাড়া অন্য কিছু কি বলা যায়? ১২টা ক্লাবে পাঁচজন করে বিদেশি খেলোয়াড় খেললে, এ মৌসুমে ষাটজন স্থানীয় খেলোয়াড় দেশের সবোর্চ্চ লিগে খেলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দেশে ভালো মানের খেলোয়াড় নেই এই যুক্তিতে এভাবে বিদেশি খেলোয়াড় আমদানির অবাধ লাইসেন্স দেওয়ায় একে তো দেশের টাকা ডলার হয়ে যেমন বিদেশে চলে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে কতগুলো খেলোয়াড় খেলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে! তারা কেন, আগামী প্রজন্মই বা কেন হকি নামক খেলাটার প্রতি আর আগ্রহী হয়ে উঠবে?

হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক নিজেও এই প্রশ্নে বিব্রত। অস্বস্তিতে এবং নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাঁকে সায় দিতে হলো শুধু নাকি খেলাটাকে মাঠে রাখতে। সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে। সবার অংশগ্রহণ ভালো। তবে সেটা কখনো উচিত-অনুচিত বিষয়টাকে চরম ঔদাসীন্যে পদদলিত করে হতে পারে না। এতে সমকালকে কিছুটা প্রভাবিত করা যেতে পারে। তবে ভাবিকাল এসব সিদ্ধান্তকে ইতিহাসে নয়, অন্য কোনো জায়গায় স্থান দিতে পারে।

ইউটিউব- অনেক আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর মাধ্যম। সেখানে অনেক কিছু নাও থাকতে পারে। কিন্তু ইতিহাসের পাতা ওল্টালে সবই খুঁজে পাওয়া যায়। ইতিহাসনির্ভর হয়ে একটা কথা লিখতে হচ্ছে- বানের জলে ভেসে আসা বিদেশি দিয়ে কোনো না কোনো ক্লাব হয়তো ট্রফি জিতবে। তাতে আখেরে বাংলাদেশ হকি আরো মুমূর্ষু অবস্থায় চলে যাবে। তাঁকে বিদেশি কোচ, বিদেশি আম্পায়ার, ফ্লাড লাইট, উন্নত মানের টার্ফ- এসব সাপ্লিমেন্ট দিয়ে বাঁচানো যাবে না!

লেখক : স্পোর্টস এডিটর, দীপ্ত টিভি