বাজেট আলাপ
আকাশ-কুসুম স্বপ্ন বিপদ ঢেকে আনতে পারে
![](https://publisher.ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2016/06/05/photo-1465119082.jpg)
শিশু-কিশোর-যুবা থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে স্বপ্ন দেখে মানুষ। হাজারো স্বপ্নের মাঝে যেমন ভয়ের-কষ্টের স্বপ্ন থাকে, তেমনি থাকে আনন্দের-মিষ্টি-মধুর স্বপ্নও! এর বাইরে কখনো কখনো এমন কিছু বিষয়ে মানুষ স্বপ্ন দেখে যার সঙ্গে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের কোনো মিল থাকে না। আকাশ-কুসম বাগধারার মতোই বাস্তবতাবর্জিত জেনেও মানুষ এসব স্বপ্নের কথা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে। স্বপ্নাতুর হওয়া দোষের নয়, শিক্ষাজীবনে বড় কিছু হওয়ার জন্য স্বাপ্নিক হওয়া জরুরি। দিনশেষে ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টি যেহেতু রাষ্ট্র চালায় তাই তারাও স্বপ্ন দেখে, স্বপ্নের মতে করে রাষ্ট্র পরিচালনার ইচ্ছে পোষণ করে। যেমন দেশের অর্থমন্ত্রী ‘উচ্চাভিলাষী’ স্বপ্নের কথা বলেছেন আগামী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে পেশের আগে ও পরে।
একজন শিক্ষার্থীর স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন না হলে তাতে সে ছাড়া অন্যের কিছু যায় আসে না। কিন্তু অর্থমন্ত্রী তথা রাষ্ট্রীয়ভাবে আকাশ-কুসুম বা উচ্চাভিলাষী আকাঙ্ক্ষা বা স্বপ্ন বাস্তবায়ন না হলে ভুগতে হয় দেশবাসীকে। সমাজ জীবন, আর্থিক খাত থেকে রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়ার শঙ্কা থাকে। প্রস্তাবিত বাজেট দেখলে এমন আশঙ্কা দেখা দেয়।
বাজেট শুধু সরকারের এক বছরের আয় ব্যয়ের দলিল নয়, এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত দেশ পরিচালনার নীতিনির্ধারণী পরিকল্পনা ও উদ্যোগ। ফলে কত টাকা আয় হলো আর কত টাকা ব্যয় হলো কেবল তা দিয়ে বাজেট মূল্যায়নের সুযোগ নেই। কীভাবে এবং কাদের কাছ থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা সংগ্রহের পরিকল্পনা করছেন, অর্থমন্ত্রী সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবার টাকা খরচের ক্ষেত্রটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ কারণে উচ্চাভিলাষী আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলে যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে জনগণ! ১৩ লক্ষাধিক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় বা অনুন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নে সরকারের হেরফের করার সুযোগ নেই। ঘাটতি হলেও মাসভিত্তিক প্রজাতন্ত্রের সেবকদের পেছনের ব্যয় আগে পরিশোধ করতে হবে। ফলে রাজস্ব আদায় কমে গেলে উন্নয়ন বাজেটে থেকে কাটছাঁটের ভিন্ন উপায় নেই অর্থমন্ত্রীর কাছে। যেমন চলমান অর্থবছরে ৩১ হাজার কোটি টাকা ছেঁটে ফেলতে হয়েছে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায়। প্রস্তাবিত বাজেটে এ অঙ্ক যে আরো বাড়বে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। এবারের বাজেটে সবচেয়ে শঙ্কা বা দুর্বল দিক হলো রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা।
সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর অনেক সময় স্বপ্ন কাহিনীটা পুরো স্মরণ রাখা যায় না। আবছা আবছা মনে থাকে ঘটনা, স্বপ্নে দেখা মুখগুলো ঠাওর করা সম্ভব হয় না। ঠিক তেমনই ঝাপসা ও ঘোলাটে ভাব দেখা যায় অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা ও বছর শেষে চূড়ান্ত হিসাব-নিকাশের মধ্যে।
বাজেট যখন সংসদে পেশ করা হয়, তখনো পুরো একটি মাসের আয়-ব্যয়ের হিসাব বাকি থাকে। নতুন বাজেটের আলোচনায় হারিয়ে যায় চলমান বাজেটের প্রকৃত অর্জন বা বাস্তবায়নের বিষয়গুলো। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, সরকারি নথিতে প্রস্তাবিত বাজেট বরাদ্দের হিসাব থাকে। বছরের শেষ দিকে কাটছাঁট করা হলেও সেসব বাজেট নথিতে স্থান পায় না। কোথায় কত বরাদ্দ ছিল আর মধ্য মেয়াদি সংশোধনীতে কোথায় কত কমল তা হিসাব করে বের করা অত্যন্ত কঠিন। এই শুভঙ্করের ফাঁকি চলছে বছরের পর বছর।
ফিরে আসি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও অর্জনের আলোচনায়। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘প্রতিবছরই আমাদের রাজস্ব আয় প্রবৃদ্ধি হচ্ছে দুই অঙ্কের ঘরে। তাই আগামী অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমি ইচ্ছে করেই উচ্চাভিলাষী টার্গেট দিয়েছি।” রাজস্ব আয়ে দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি হওয়া নিয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই। দুই অঙ্ক মানে ৯-এর পরে যেমন ১০/১১ হতে পারে, তেমনি হতে পারে ১৫/১৬ কিংবা ২০/২২ ভাগ বা কমবেশি। দুই অঙ্কের মধ্যে পার্থক্য অনেক হতে পারে বলে এভাবে গড় কথা বলার মধ্যে খণ্ডিত চিত্র পাওয়া যায়। প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে সংখ্যা নির্দিষ্ট করতে হবে। চলতি অর্থবছরে এক লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা তুলতে হিমশিম খাওয়া এনবিআরকে তুলতে হবে দুই লাখ তিন হাজার কোটি টাকা। তাই প্রশ্ন, হুট করে কীভাবে ৩৫ ভাগ রাজস্ব আয় বাড়বে তা নিয়ে। এনবিআরের এমন কিছু গুণ ও সংখ্যাগত পরিবর্তন আসেনি এক বছরে। হয়নি তেমন কোনো সংস্কার, করের আওতা বাড়াতে নেওয়া হয়নি নতুন পদক্ষেপ।
কীভাবে আসবে বাড়তি টাকা সেই প্রশ্নের উত্তর নেই বিশাল বাজেট বক্তৃতায়। মোদ্দা কথা, লক্ষ্যহীন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে বাহ্বা পাওয়ার কিছু নেই। বরং এটা লজ্জার, অর্থ আদায় করতে না পেরে লক্ষ্য থেকে পিছিয়ে আসা। এতে বিশ্বাসে চিড় ধরে, প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের কাজে ঢিলেমি আনতে পারে। কাটছাঁট আসবে জেনে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। যেটা অর্থমন্ত্রী নিজেও স্বীকার করেছেন, ৩০ অক্টোবর কর দিবস নির্ধারণ করতে গিয়ে। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘...রিটার্ন দাখিলের শেষ তারিখ একাধিকবার বর্ধিত হয়। করদাতারা প্রতিবছরই সময় বাড়বে বলে ধরে নিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিটার্ন দাখিল থেকে বিরত থাকেন। এর ফলে কর নির্ধারণ ও রাজস্ব আহরণ কার্যক্রম পিছিয়ে যায়।’ ফি বছর আয়ের লক্ষ্যমাত্রা সংশোধনের প্রভাব কি এনবিআর কর্মকর্তাদের ওপর পড়বে না? ব্যবসায়ীদের আন্দোলনের মুখে এক বছর পর জুলাই ২০১৭ থেকে নতুন ভ্যাট আইন চালু কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। শেষ পর্যন্ত এ সিদ্ধান্তেও তিনি অটল থাকবেন তারই বা গ্যারান্টি কি?
আর কর ব্যতীত রাজস্ব আয় এক বছরে কীভাবে ১৪ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে হবে ২২ হাজার কোটি টাকা, তারও কোনো ব্যাখ্যা নেই বাজেটে। সমস্যা এখানেই শেষ নয়, টানাপড়েনের জোগান দিতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী নিজেই নিজের আইন ভাঙছেন বারবার। প্রস্তাবিত বাজেট মানে আগামী জুলাই থেকে কার্যকর করার হবে। কিন্তু জুনের প্রথম সপ্তাহ থেকেই মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর আরোপিত নতুন কর কাটা শুরু হয়েছে। এ কায়দায় জনগণের কাছ থেকে অর্থ আদায় সহজ বলেই অর্থমন্ত্রী ও রকম পদক্ষেপ নিয়েছেন। নতুন ভ্যাট আইনের ক্ষেত্রে জটিলতা নিরসনে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের নিয়ে নয় সদস্যের কমিটি করেছিলেন তিনি। সেই কমিটি যে সাতটি সুপারিশ করেছিল, যা এনবিআরের নথিভুক্ত হয়েছে কিন্তু ভ্যাট আইনে যুক্ত করা হয়নি।
স্বপ্নের লক্ষ্যমাত্রা সব দেশের অর্থমন্ত্রীরা বাজেটে করে থাকেন। সব দেশেই লক্ষ্যমাত্রা ও অর্জনের মধ্যে পার্থক্য থাকে। সিপিডির গবেষণা বলছে, রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রার ৯২ ভাগ অর্জন করে ভারত। আর বাংলাদেশ করতে পারে ৭৯ দশমিক ৮ ভাগ। একইভাবে অনুন্নয়ন ব্যয়ে ভারত প্রায় ৯৩ ভাগ, যেখানে বাংলাদেশ মাত্র ৮১ ভাগ। উন্নয়ন বাজেট ব্যয়ের ক্ষেত্রে ভারতে সাড়ে ৮৮ ভাগ আর আমরা মাত্র সাড়ে ৭৩ ভাগ। সুতরাং তুলনামূলক চিত্র বলে দেয় আমরা কতটা আকাশ-কুসুম স্বপ্ন দেখি।
বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত প্রতিবেশী সবগুলো দেশের চেয়ে পিছিয়ে। নেপালে যেখানে ১৫-এর বেশি তখন বাংলাদেশে ৯-এর নিচে। ভারতে যা ১০ এর বেশি। নেপালের মতো ল্যান্ডলক ছোট্ট পাহাড়ি দেশ যা পেরেছে তা আমরা পারিনি নেক্সট ইলেভন তকমা পেয়েও। আমাদের মতো রাজনৈতিক টানাপড়েনের দেশে টানা আটবার বাজেট দেওয়ার সুযোগ বিরল। ফলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আলোকে কর-জিডিপির অনুপাত বৃদ্ধি বা করের আওতা বাড়ানোর সুযোগ কাজে লাগাতে পারতেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু করদাতার সংখ্যা ১১ লাখের মধ্যে আটকে থাকায় বোঝা যায় সে কাজে তিনি সফল নন। উপজেলা তো বটেই, গ্রামগঞ্জেও অনেকে আছেন করের আওতায় আসার মতো। কিন্তু শহরের বৃত্ত ভেঙে বের হতে পারছে কি এনবিআর? উল্টো যাঁরা কর দিচ্ছেন, তাঁদের ওপরেই বাড়তি করের বোঝা চাপাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। আগামী বাজেটে যা আরো বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন। কালো টাকা উদ্ধার ও অর্জনের পথ বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ নেই বাজেটে। একইভাবে কর ফাঁকিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো আলামত নেই বিশাল বক্তব্যে। প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন ও সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রযাত্রার বাজেট নয়, আয় বৈষম্যকে উসকে দেবে, ধনী-গরিবের পার্থক্য আরো বাড়বে প্রস্তাবিত বাজেটে।
লেখক : সাংবাদিক