ক্রিকেট

ইতিহাসে মুখ গুঁজে থাকায় বিশ্বাসী নন তিনি

Looks like you've blocked notifications!

নিজেকে নিয়ে বলার অপূর্ব একটা ধরন আছে তাঁর। স্মৃতিতে ধরা ঘটনাগুলোকে পুঙ্খানুপুঙ্খ গল্পের মতো বলতে পারেন। ক্রিকেটার হিসেবে তাঁর ব্যাটিং দেখার জন্য যতটা স্বস্তিদায়ক, আরামদায়ক ছিল চোখের জন্য, তার চেয়ে অনেক অ-নে-ক গুণ ভালো তাঁর বলার ধরন। ডিটেলে নিটোল গল্পের মতো করে বলতে পারেন তিনি। সেটা শোনা শ্রবণ-ইন্দ্রিয়ের জন্য দারুণ স্বস্তিদায়ক। তৃপ্তিদায়ক। ক্রিকেট নিয়ে তাঁর বলাটাও একটা আর্ট, যা তাঁর ব্যাটিংয়ের চেয়ে অনেক বেশি শৈল্পিক। কী খুঁজে পাওয়া যায় না তাঁর কথায়। ক্রিকেট শুধু একটা খেলা নয়। এটা বিজ্ঞান, অঙ্ক, দর্শন, সংস্কৃতির মিশেলে আরো বেশি কিছু। সেটাই খুব ডিটেলে বোঝাতে পারছেন তিনি। কিন্তু বোঝাচ্ছেন কাদের? যারা এখনো ক্রিকেট-সংস্কৃতির সঙ্গে অপরিচিত। যাদের দেশে খেলাটার চর্চা কম। যাঁরা মনে করেন, খেলা মানে অলিম্পিক বা কোনো আন্তর্জাতিক গেমসে পদক জেতা!

কিন্তু খেলাটার নাম যে ক্রিকেট। তাতে অলিম্পিকে পদক জিতবে কোথা থেকে? প্রথম অলিম্পিকে না হয় ফরাসিরা চ্যাম্পিয়ন হয়ে স্বর্ণপদক জিতেছিল। তার পর সেই খেলাটা যে আর অলিম্পিকের ডিসিপ্লিন হয়ে উঠতে পারল না! অথচ এই খেলাটারও একটা বিশ্বকাপ আছে। তা নিয়েও তিনশ-সাড়ে তিনশ কোটি মানুষের মধ্যে চলে মাতামাতি। উচ্ছ্বাসের জোয়ারে ভাসে পৃথিবীর দুই গোলার্ধের কিছু দেশ। তারপরও খেলাটার গায়ে বিশ্বজনীন তকমা লাগেনি। আভিজাত্যের আবরণে আটকে রয়েছে খেলাটা গোটা দশেক দেশের মধ্যে। সেই খেলাটা শেখানোর জন্য তিনি চরকির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। বিশেষ করে চীন নামক বিশাল এক দেশে, যারা বিশ্ববাজারে যার যার চাহিদামতো সবকিছু সাপ্লাই দিচ্ছে। শুধু পারে না ক্রিকেটার সাপ্লাই দিতে। সেই বিশাল ভূখণ্ডের বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে ক্রিকেটার তুলে আনার চেষ্টা করছেন এক বাংলাদেশি।

এ রকম একটা কাজের জন্য তাঁকে আগে শিখতে হয়েছে চীনা ভাষা। তার পর তাঁদের দিতে হচ্ছে ক্রিকেট জ্ঞান। সেখানেও বাধা চীনাদের সেই পদক চিন্তা। পদক-ই যদি না জেতা যায়, তাহলে এই খেলাটা খেলে লাভ কী! এই হচ্ছে জাতিগতভাবে যাদের ক্রীড়া দর্শন, তাদের ক্রিকেট শেখানোর কাজটা কী রকম কঠিন হতে পারে?

কিন্তু এই কঠিন কাজটা সহজভাবে করতে পারাই তাঁর জীবনের দর্শন। তার জন্য শুধু নিজের খেলোয়াড়ি জীবনের অভিজ্ঞতাই যথেষ্ট নয়। তাই প্রতিনিয়ত পড়তে হচ্ছে। শিখতে হচ্ছে। কখনো কখনো ছুটে যাচ্ছেন অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউট অব স্পোর্টসে। ক্রিকেট কোচিংয়ে প্রথম জীবনে চরমভাবে ব্যর্থ হওয়ার পর যে জায়গায় ছয় বছর পড়ে থাকার পর ডেভ হোয়াটমোরের পুনর্জন্ম হয়েছিল কোচ হিসেবে। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে শ্রীলঙ্কাকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করেছিলেন। আসলে সেখান থেকেই আমিনুল ইসলাম বুলবুল নতুন করে শিখেছেন কোচিং কী? তাই তিনি বলতে পারেন, ‘খেলাটা খেলেছি বলেই আমি ভালো কোচ হয়ে যাব, তা হয় না। আবার ক্রিকেট সর্বোচ্চ পর্যায়ে না খেলেও জন বুকানন সফল কোচ হয়েছেন! আসল কথা হচ্ছে রিসার্চ। গবেষণা করে নিজেকে নিজের শক্তিটা বের করতে হবে। তার পর সেটা প্রয়োগ করতে হবে। আমি কাউকে ফলো করার পক্ষে নই।’ বলছিলেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। এখন যার পরিচয় আইসিসির ডেভেলপমেন্ট অফিসার, যার কাজ এশিয়া অঞ্চলে কোচদের নিয়েও কাজ করা।

কোচিং বিষয়টি বুলবুলের কাছে কী? এ প্রশ্নের একটা সহজ উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম তাঁর সঙ্গে লম্বা সময় কথা বলে। কিন্তু ওর বলার ধরন দেখে বারবার মনে হচ্ছিল, এ তো সেই অধ্যাপকের মতো। মরাল সায়েন্স পড়াতে এসে যিনি দর্শন পড়িয়ে চলে গেলেন! আমিনুল ইসলাম বুলবুলও তাই। ক্রিকেট কোচিংয়ের কথা বলতে গিয়ে বারবার যা বললেন, তা ক্রিকেট দর্শন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনা যায়। শুনতে শুনতে ক্লান্তি আসার সম্ভাবনা খুব কম। যদি ক্রিকেট নামক খেলাটার প্রতি আপনার সামান্যতম আগ্রহ থাকে।

আসলে দর্শন ছাড়া জীবন চলে কি? আর ক্রিকেট সে তো অনেকের কাছে জীবনের অংশ। একটা ক্রিকেট ম্যাচে বারবার ফুটে ওঠে জীবনের নানা রঙের ছবি। দর্শন বাদ দিয়ে ক্রিকেট হয় কীভাবে? বুলবুল অবশ্য বললেন, হতে পারে। যদি খেলাটা ক্রিকেটীয়ভাবে অশিক্ষিত কিছু লোকের হাতে পড়ে যায়। যার পরিণতি ভয়ংকর। মর্মান্তিক। খেলাটাকে তখন অনেক বড় মাশুল গুনতে হয়। ক্রিকেট কোচদের এখন তাই শরীর বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, অর্থনীতি, সমাজনীতি, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান সব জানতে হয়। পড়তে হয়। পড়াতে হয়।’

তাহলে ক্রিকেট কোচিং কী? প্রশ্নের উত্তরটাও দিলেন তিনি অধ্যাপকের মতো করে। ‘ক্রিকেট কোচ! কথাটা শুনতেই মানুষের চোখের সামনে ভেসে ওঠে এই ভদ্রলোক ব্যাট হাতে নিয়ে ক্যাচিং প্র্যাকটিস করান! আসলে বিষয়টা মোটেও তা নয়। ক্রিকেট কোচিং হচ্ছে খুব কম কথায় ম্যানেজমেন্ট অব স্কিল। আর ম্যানেজমেন্ট হচ্ছে টেকনিক্যাল, ফিজিক্যাল, প্র্যাকটিক্যাল অ্যান্ড মেন্টাল।’

আমিনুল ইসলাম বুলবুলের সঙ্গে এখন ক্রিকেট বা ক্রিকেট কোচিং নিয়ে কথা বললে মনে পড়ে, ‘অ্যা ম্যান ইজ অ্যাজ ইন্টারেস্টিং অ্যাজ দ্য স্টোরিজ হি হোল্ডস’ একটা মানুষ ততটাই চিত্তাকর্ষক, যতটা মনোগ্রাহী তাঁর জীবনের গল্প। বুলুবল তেমনই এক চরিত্র। ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন যিনি। সালাউদ্দিন হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে যার ফুটবলজীবন শুরু। সালাউদ্দিনের মতো ১০ নম্বর জার্সি পরে যিনি ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবে ফুটবল খেলতেন। সযত্নে যিনি সালাউদ্দিনের মতোই একদিন আবাহনীতে খেলার স্বপ্নটা মনের মধ্য দীর্ঘদিন লালন করেছিলেন। ছিয়াশির বিশ্বকাপ ফুটবলে ম্যারাডোনার খেলা দেখে যিনি ‘ম্যারাডোনা আসক্ত’ হয়ে পড়েছিলেন। অথচ শেষ পর্যন্ত তিনি হয়ে গেলেন ক্রিকেটার। ক্রিকেট নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে আছেন এখনো। আর তাঁর ক্রিকেটার হয়ে ওঠার বাঁকে বাঁকেও কত ঘাত-প্রতিঘাতের গল্প!

আবার বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের অংশ হতে চেয়েছিলেন যিনি, ক্রিকেট-ঈশ্বর তাঁকে দিয়েই ইতিহাস লিখিয়ে ফেললেন! বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপে টস করতে নামলেন যিনি, বাংলাদেশের প্রথম অভিষেক টেস্ট সেঞ্চুরি করলেন যিনি, তাঁর নাম আমিনুল ইসলাম বুলবুল। ইতিহাসের স্রষ্টা ছাড়া কী বলবেন তাঁকে?

এই প্রশ্নে অন্য এক বুলবুলকে খুঁজে পাওয়া যায়। যিনি বলতে পারেন, ‘আমি ইতিহাসের পাতায় মুখ গুঁজে থাকি না। ক্রিকেট আমার জীবনটাকে নতুনভাবে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। দিচ্ছে।’ আমরা নতুন এক বুলবুলকেই দেখি ক্রিকেট পঠনপাঠনের মধ্য দিয়ে যিনি নিজেও নতুনভাবে নিজেকে আবিষ্কার করেন।

লেখক : স্পোর্টস এডিটর, দীপ্ত টিভি।