প্রিয় দিল্লি

Looks like you've blocked notifications!
অরবিন্দ কেজরিওয়াল

এক বছর আগে হাজার হাজার তরুণ-তরুণী দিল্লিতে এমন এক কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন, যা আগে কখনো হয়নি। তাঁরা রাতের বেলা খাবার টেবিলে বাবা-মায়ের সাথে রাজনীতি নিয়ে তর্ক শুরু করেছিলেন। দিল্লির মানুষ সব সময়ই রাজনৈতিক বিতর্ক করেছে কিন্তু তখনকার বিষয়টা আলাদা ছিল। তারা নতুন একটি দলের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল, চেয়েছিল পরিবর্তন আনতে। সে জন্য নিজেদের কষ্টের টাকাও দলটির নির্বাচনী প্রচারণায় খরচ করে তারা। 

কিন্তু কয়েক মাস পরই তাদের বিব্রত হতে হয়েছিল। বাবা-মা, বন্ধুবান্ধব সবাই মুখ বাঁকিয়ে বলেছেন, ‘আগেই বলেছিলাম!’ দিল্লির অনেক মানুষই ভেবেছেন তাঁদের এই অপমানের জন্য আমরাই দায়ী। আর সে কারণেই গত বছরের মে মাসে আমরা তাদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চেয়েছি। কেউ যদি সে খবরটা পেয়ে না থাকেন তবে আবারও ক্ষমা চাচ্ছি। ক্ষমা চাচ্ছি আপনাদের বিব্রত করার জন্য, আপনাদের প্রত্যাশার সঠিক প্রতিদান না দেওয়ার জন্য।   

আম আদমি পার্টি চেয়েছিল বুক ভরে তাজা নিঃশ্বাস নিতে। আর সে কারণেই শুরু থেকে আমাদের পার্টি ফান্ডের ব্যাপারে পুরোপুরি স্বচ্ছতা রাখা হয়েছিল। আমরা মিথ্যা বলিনি, আমরা চুরিও করিনি। কিন্তু আমি জানি আমাদের কাজে মানুষ মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছে। কারণ আম আদমি পার্টি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা আমাদের সবার চেয়ে বড় ছিল। 

মানুষ কষ্ট পেয়েছে, কারণ একটা রাজনৈতিক দলকে তারা নিজেদের শ্রম এবং পয়সা দিয়ে গড়ে তুলেছে কিন্তু মাত্র ৪৯ দিনের ব্যবধানে সে দলটি তাদের থেকে মুখ ফুরিয়ে নিল। এবং তখন সবাই এটা ধরে নিয়েছিল, দিল্লির বিধানসভা ছেড়ে লোকসভায় প্রধানমন্ত্রিত্বের জন্য লড়ব আমি।  

আমি যখন পদত্যাগ করি তখনই আমি দিল্লিতে নতুন নির্বাচনের দাবি জানিয়েছিলাম। সংখ্যালঘু সরকার হওয়া সত্ত্বেও আমাদের গ্রহণযোগ্যতা ছিল ৭১ শতাংশ। কিন্তু তখন আমার দাবি মানা হয়নি। পদত্যাগ করাটা আমার ভুল ছিল, সৎ উপায়ে করা একটি ভুল। কিন্তু ভুল সব সময়েই ভুল। সবকিছুর পরও জনতা যদি আমাদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিত তাহলে তাদের প্রত্যাশা থাকত আমরা আরো ধৈর্য্ ধরে নেতৃত্ব দেব। যেমন, কয়েকদিন আগে আমাকে একজন বলেছিলেন, দিল্লির একটি দল হিসেবে দিল্লির মানুষের জন্য আমরা কী করলাম সেটাই তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এই গুরুত্বটা বুঝতে পেরেছি এবং ব্যাপারটা গুরুত্বের সাথে নিয়েছি। 

আম আদমি পার্টির কাছে মানুষের চাওয়া অনেক। কারো প্রত্যাশা বিশৃঙ্খলা থামিয়ে সাধারণ মানুষের পথে বের হওয়াকে নিশ্চিত করবে আম আদমি। কেউ ভাবেন সাম্প্রদায়িকতা এবং জাতের ভেদাভেদহীন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করব আমরা। কারো কারো কাছে এই পার্টি তাদের অধিকার, স্বাধীনতা এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করবে যা সংবিধান তাদের দিয়েছে। আমরা এই প্রত্যাশাগুলো পূরণের স্বপ্ন নিয়েই গত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলাম। চাঁদাবাজি না করে দল চালানো এবং দেশের সম্পদ চুরির যে মহোৎসব চলছে তা বন্ধ করা ছিল আমাদের লক্ষ্য।  

আমাদের সবার প্রত্যাশা এক। একটি স্থিতিশীল এবং সংবেদনশীল সরকার। এমন একটা প্রশাসন যেখানে ঘুষ ছাড়াই জনগণ তাদের প্রাপ্য সুবিধা পাবেন। যে সমাজে সৎভাবে ভালোমতো বাঁচার সুযোগ আছে এবং বাচ্চাদের একটি সুখী ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা যায়। সোজা কথায় আমরা সুখী এবং নিরাপদ সমাজে বাঁচতে চাই।

আম আদমি পার্টি থাকবে কি থাকবে না, কেজরিয়াল থাকবেন কি থাকবেন না—এ ধরনের চিন্তাভাবনা এখনো আমাদের মাঝে আছে। আমরা সেটাকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে পারি না। আম আদমি পার্টি অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই টিকে আছে। আমরা অনেক বাধা পেরিয়েছি, কারণ আমরা একটা পরিবারের মতো একসাথে কাজ করেছি। এই পরিবারে অর্থনীতি বা সামাজিক কোনো অবস্থানের বাধা নেই।

আমরা দিল্লির মানুষ, আমরা জানি দিল্লির সমস্যা কীভাবে সমাধান করতে হবে এবং আমরা এটাও জানি দিল্লিবাসী চায় তাদের সরকার তাদের জন্যই কাজ করুক। 

আমরা জানি, মানুষ চায় আমরা কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে মিলে গঠনমূলক কাজ করি। আমরা বুঝি দিল্লির সরকারকে একই সাথে সৎ এবং স্থিতিশীল হতে হবে। এমন একটি সরকার যারা প্রতিদিন দিল্লিকে একটু একটু করে এগিয়ে নেবে বাকি বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে। যে সরকার মানুষের জন্য কান খোলা রাখবে এবং সবার প্রয়োজন পূরণে সচেষ্ট থাকবে। 

সাধারণ মানুষের শক্তিকে ছোট করে দেখা দুঃসাহস। আমাদের নেতারা আমাদের সেবা করার জন্য রয়েছেন। আমাদের সরকারের সামর্থ্যকে ছোট করে দেখা উচিত নয়। যে সরকার তার জনতাকে বিব্রত করে, সে সরকার তার জনগণের ওপরই ভরসা করে। সরকার টিকে থাকে স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা বজায় রেখে উন্নয়ন করার আশায়। ভয় এবং অস্থিতিশীলতাকে পুঁজি করে লম্বা বক্তৃতা দেওয়ার জন্য নয়। এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে ধার করে বলতে পারি, ছোট ছোট দেয়াল তুলে জগৎকে আলাদা করে রাখা যায় না।

আমাদের একটি লক্ষ্য রয়েছে। দিল্লিকে ভারতের প্রথম ‘ঘুষমুক্ত’ প্রশাসনে পরিণত করা। যেখানে ব্যবসায়ীরা নির্বিঘ্নে বিনিয়োগ করতে পারবেন, নতুন নতুন উদ্যোক্তারা তাঁদের ব্যবসা এখান থেকে শুরু করতে পারবেন। তথ্যপ্রযুক্তি এবং বড় বিনিয়োগের জন্য বিশ্বের অন্যতম সেরা জায়গা হবে দিল্লি। 

ব্যবসা, স্বাস্থ্য ও সেবা খাত, শিক্ষা এবং নারীর সুরক্ষায় দিল্লি হবে উদাহরণ। এসব একদিনে করে ফেলা সম্ভব নয়। কিন্তু সঠিক দিকনির্দেশনা, সৎ উদ্দেশ্য এবং একসাথে কাজ করার অঙ্গীকার নিয়ে মাঠে নামলে লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন কিছু নয়। এমনকি যারা আমাদের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন তারাও যদি আমাদের সাথে কাজ করেন তবে আমরা যা চাই সেটা বাস্তবে করে দেখানো সম্ভব। চলুন, আবারও দিল্লিতে এক হই। 

দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে ভোটগ্রহণের দিন আসন্ন। ভোটে আপনাদের আশীর্বাদ চাই আমি। আমার বিশ্বাস নিজের মতাদর্শে অটল থেকে, জনগণের কাছে সৎ থেকে স্থিতিশীল সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে আমি এটুকু বলতে পারি, এতে আমাদের শক্তি আরো বেড়েছে। দিল্লিকে আমরা পৃথিবীর অন্যতম সেরা এবং আধুনিক শহরে পরিণত করতে চাই। আমাদের দৃষ্টি স্বচ্ছ এবং হৃদয় পরিপূর্ণ। আমাদের হৃদয়ে কাজের প্রতি ভালোবাসা রয়েছে এবং যে কোনো লক্ষ্য পূরণের জন্য আমরা সচেষ্ট।  

লেখাটা শেষ করার আগে আমি সেসব সাধারণ মানুষের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চাই, যাঁরা আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। নিজেদের ব্যস্ত জীবনকে পাশ কাটিয়ে আমাদের জন্য ভোট চাইতে পথে নেমেছেন। তাঁরা মানুষকে বুঝিয়েছেন সৎ উপার্জনের টাকা দিয়ে একটি রাজনৈতিক দল দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে লড়ে জিততে পারে। আমার প্রতিটা দিন শুরু হয় আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা দিয়ে। আপনারা এখনো আমাদের জন্য বাড়ির দরজা খোলা রেখেছেন। আপনাদের চিন্তা এবং আশীর্বাদ দিয়ে আমাদের ধন্য করেছেন। 

আমরা প্রায়ই বলি, আগামী দিনের নেতৃত্ব দেবে তরুণরাই। কিন্তু আমি এর সাথে দ্বিমত পোষণ করি। আমি বলি, আগামী দিনে নয় আজই তরুণদের দরকার ভারতের। তারা আমাদের সাথেই আছে, এখানেই। তাদের আমাদের সাথে নিতে হবে, আমাদের কর্তব্যগুলো তাদেরও ভাগ করে নিতে হবে। 

সবশেষে আমি আপনাদের কাছে প্রতিজ্ঞা করছি, আমি মেয়াদ শেষ না করে পদত্যাগ করব না। 

অরবিন্দ কেজরিওয়াল : আম আদমি পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান। দিল্লির সপ্তম মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মাত্র ৪৯ দিন দায়িত্ব পালন করে পদত্যাগ করেছিলেন তিনি। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে লেখাপড়া করে কেজরিওয়াল ভারত সরকারের রাজস্ব বিভাগে কাজ করেন। ২০০৬ সালে র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। 

লেখাটি গত পয়লা ফেব্রুয়ারি এনডিটিভির অনলাইন সংস্করণের মতামত কলামে ছাপা হয়েছিল। ভাষান্তর ফাহিম ইবনে সারওয়ার।