প্রতিক্রিয়া

সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডে শঙ্কা বাড়ছে

Looks like you've blocked notifications!

ঘুম থেকে জেগে পত্রিকা হাতে নিতেই এখন অস্বস্তি কাজ করে, না জানি কার মৃত্যুর সংবাদ অপেক্ষা করছে।  স্বজনদের বুকফাটা কান্নার ছবি, লাশের বীভৎস ছবি- এ সবকিছুই সারাদিনভর মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে পাঠকের।  এই গুমট দমবন্ধ করা পরিস্থিতি কিছুতেই কাটতে চাইছে না।  কারণ খুব কম সময়ের ব্যবধানে এত মৃত্যুর খবর আসছে আমাদের কাছে, সরকারের কথামতো ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ ভেবে ভুলে থাকা যাচ্ছে না।  চারপাশে সাধারণ মানুষগুলো যখন হত্যাকাণ্ডের টার্গেট হচ্ছে তখন তো নিজের মনে শঙ্কা জাগেই। 

শুরুতে গেল মুক্তমনা, যাঁরা ধর্ম নিয়ে কটাক্ষ করেন তাঁদের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড।  প্রথম শিকার হলেন বরেণ্য শিক্ষক হুমায়ুন আজাদ।  এরপর ব্লগার হত্যার ধারাবাহিকতা বিষয়টাকে প্রতিষ্ঠিত করলো কট্টর মৌলবাদী গোষ্ঠী।  তারপরও তাঁরা ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেলেন। কিন্তু বিষয়টি আরো জটিল হলো।  ভিন্ন ধর্মাবলম্বী সাধারণ মানুষ, যারা কারো সাতে পাচেঁও নেই, তাদের মারা শুরু হলো সারাদেশে, হিন্দু পুরোহিত কিংবা বৌদ্ধ ভিক্ষু, খ্রিস্টান পাদ্রি যারা অন্য কারো ধর্ম নিয়ে কখনো কটূক্তি করেছে এমন কথা কখনো শোনা যায়নি তারাও মরতে শুরু করল। 

অনেকেই যখন ভাবতে শুরু করল যে এবারে বুঝি সংখ্যালঘুদের টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছে।  এর পরই হত্যা করা হলো পুলিশ অফিসারের স্ত্রীকে, দিনের বেলায় প্রকাশ্যে।  এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে উৎকণ্ঠা বাড়ছে পুলিশের ভেতরে।  সরকারকে চাপে রাখতে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটছে বলেও অনেকের ধারণা।  দুবৃর্ত্তদের এই টার্গেটে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ এবং বিশেষ করে তাদের পরিবার আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।  বিশেষ করে টহল কিংবা চেকপোস্টগুলোতে দায়িত্ব পালন করতে এখন অনেকেই ভয় পাচ্ছেন।  এসব টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনায় র‌্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দাদের ওপর চাপ বাড়ছে।  প্রতিটি ঘটনার যোগসূত্র বের করতে এবং জড়িতদের ধরতে বারবার সরকার থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে।  

গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর গুলশানে কূটনৈতিক পাড়ায় ইতালীয় নাগরিক সিজারি তাভেল্লাকে হত্যার মাধ্যমে বড় ধরনের অপরাধের সূত্রপাত ঘটায় অপরাধীরা।  এর মাত্র ৫ দিনের মাথায় একইভাবে রংপুরে খুন হন জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি।  এরপর ঢাকার উপকণ্ঠ সাভারের আশুলিয়ায় একটি চেকপোস্টে কতর্ব্যরত অবস্থায় খুন হন পুলিশ কনস্টেবল মুকুল হোসেন।  এর আগে ২২ অক্টোবর রাতে গাবতলীতে চেকপোস্টে দায়িত্বপালনরত পুলিশের এএসআই ইব্রাহীম মোল্লা সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে মারা যান।  কুমিল্লা সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার ঘাটুরা এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে গেলে পুলিশের পাঁচ সদস্য আহত হন।  স্বাভাবিকভাবেই আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারি বাহিনীর ভেতরে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বেড়েই চলেছে। 

তবে সাম্প্রতিক সময়ে পরপর তিনিটি হত্যা কাণ্ড সরকার আইনশৃঙ্খলাবাহিনীসহ সারাদেশের মানুষকে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।  নাটোরের বড়াইগ্রামের বনপাড়ায় রোববার সুনীল দানিয়েল গমেজ (৬০) নামে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের এক মুদি দোকানিকে তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা।  নিহত সুনীল বনপাড়ার মৃত যোসেফ গমেজের ছেলে।  হত্যার দায় স্বীকার করেছে জঙ্গি সংগঠন আইএস (ইসলামিক স্টেট)।  যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জঙ্গি কার্যক্রম পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ এক টুইটবার্তায় এ তথ্য জানিয়েছে।  একই বিবৃতিতে আইএস দাবি করেছে গত মাসে তারা বান্দরবানে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুকে হত্যার সাথেও জড়িত ছিল।  হত্যাকাণ্ডের পাঁচ ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে হত্যার দায় স্বীকার করার দাবি জানালো আইএস। 

এর পরই রাজধানীর উত্তরার নিজ বাসায় সেনা কর্মকর্তার মাকে খুনের খবর আসে।  নিহতের নাম মনোয়ারা সুলতানা (৬৫)।  হত্যার পর তাকে সোফাসেটে হেলান দিয়ে রাখে খুনিরা।  এ ঘটনায় পুলিশ বাসার নিচতলার বিউটি পার্লারের মালিক এক নারী, কাজের বুয়া ও দারোয়ানকে সন্দেহ করছে।  কাজের বুয়া ও দারোয়ান পলাতক রয়েছে।  পার্লারের মালিকসহ ১০-১২ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।  পুলিশের প্রাথমিক ধারণা, সম্পদ লুট করতে এ খুন করা হতে পারে।  সম্প্রতি মনোয়ারা সুলতানা ফ্ল্যাটে কয়েকজনের সঙ্গে গল্প করে বলছিলেন, তার কাছে ১০০ ভরি স্বর্ণ আছে, যা বিক্রি করে তিনি মসজিদ বানাবেন।  খুনিরা বাসা থেকে কী কী নিয়ে গেছে তা জানার চেষ্টা করছে পরিবার ও পুলিশ সদস্যরা। পুলিশ জানায়, মনোয়ারা সুলতানা উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরের এক নম্বর রোডের ১১ নম্বর বাড়ির দ্বিতীয়তলায় এক ফ্ল্যাটে থাকতেন।  স্বামী ডাক্তার আবু মোহাম্মদ ইউসুফ মারা গেছেন।  দীর্ঘদিন ইউসুফ সৌদি আরবে ছিলেন।  তিন ছেলের মধ্যে বড় ইকবাল বিন ইউসুফ থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়, মেজ লে. কর্নেল খালিদ বিন ইউসুফ থাকেন চট্টগ্রামে এবং ছোট ছেলে আমীন বিন ইউসুফ থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে।  বড় ছেলে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। 

মনোয়ারার অনেক স্বর্ণালংকার থাকলেও তা বাসায় নেই বলেই জানি।  জানা মতে, তা ব্যাংকের ভল্টে রয়েছে। 

সব ঘটনাকে ছাপিয়ে গেছে চট্টগ্রামের মাহমুদা আক্তারের হত্যার ঘটনা।  চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী তিনি। দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন দিনের বেলায় অনেক মানুষের চোখের সামনে।  সকালে সন্তানকে স্কুলের বাসে তুলে দেওয়ার উদ্দেশে বাসা থেকে বের হন। বাসার কাছাকাছি জিইসি মোড়ের কাছে মোটরসাইকেলে আসা তিনজন মিসেস আক্তারকে প্রথমে ছুরিকাঘাত ও পরে গুলি করে পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। বাবুল আক্তার সবশেষ চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। সম্প্রতি পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ সুপার হন বাবুল আক্তার। গত সপ্তাহে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পুলিশ সদর দপ্তরে যোগ দেন তিনি। এই ঘটনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী হত্যার ঘটনায় জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। তিনি বলেন, বাবুল আক্তার একজন সৎ, নির্ভীক ও পরিশ্রমী অফিসার।  তিনি দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গি দমনে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁকে না পেয়ে তাঁর স্ত্রীকে টার্গেট করা হয়েছে।এর উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’

অনেক পুলিশ কর্মকর্তাও একই কথা মনে করছেন। বাবুল আক্তারের সাম্প্রতিক ফেসবুক স্ট্যাটাসেও উঠে এসেছে তাঁর কাজের কথা, ‘পুলিশের চাকরিতে সকলকে সন্তষ্ট করা সম্ভব নয়।  হয় অভিযোগপত্র না হয় চুড়ান্ত রিপোর্ট। এর মাঝামাঝি কোনো অবস্থানে থাকার সুযোগ নেই। সে কারণে অনেকের বিরাগভাজন হয়ে থাকতে পারি।  তবে এতটুকু বলতে পারি নিজ স্বার্থের জন্য কিছু করিনি।’

পুলিশকে টার্গেট করাটা অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে তবে পরিবারের সদস্যের ওপর হামলা এবারই প্রথম। পুলিশের মনোবল ভাঙতেই এধরনের ঘটনা ঘটছে বলে সাদা চোখে দেখা যাচ্ছে।  কিন্তু ঘটনাগুলোকে একসুতোয় গাঁথলে দেখা যাবে যারাই এইসব টার্গেট কিলিং করছে তাদের এগুলো হয়তো টেস্ট কেস। তাদের আরো অনেক বড় পরিকল্পনা রয়েছে। বিচ্ছিন্নভাবে এই হত্যা কাণ্ডগুলো ঘটিয়ে তারা প্রতিক্রিয়া দেখছেন কী ঘটে।  এই সব হিসাব মিলিয়ে তারা হয়তো বড় কোনো পরিকল্পনা করছে।  আমার আশঙ্কা মিথ্যে হোক এটাই আমার একান্ত চাওয়া। অপরাধীরা ধরা পড়ুক মনেপ্রাণে আমি চাই।  প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়তার সাথে বলেছেন গুপ্ত হত্যাকারীরা পার পাবে না, হিসেব নেওয়া হবে।  তাঁর এই কথায় সারাদেশের মানুষের মতো আমিও স্বস্তি পেয়েছি। কারণ আমাদের চৌকশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী অবশ্যই তাদের ধরতে পারবে। তবে একটাই অনুরোধ বিষয়টিকে কোনো রাজনৈতিক রং লাগিয়ে আসল অপরাধীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখার মতো ভুল যেন কেউ না করে বসে। 

লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ