স্মরণ

জাহানারা ইমাম ও আরাধ্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

Looks like you've blocked notifications!

বাইশ বছর আগে আজকের এই দিনে সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে মর্মন্তুদ খবরটি এলো - জাহানারা ইমাম আর নেই। চিকিৎসার জন্য শেষবার  ঢাকা ছাড়বার আগে বলেছিলেন আমাদের, “ওদের মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেছে। দেখিস, এবার ফিরে এলেই দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলব আমরা। দেশ জেগে গেছে, তরুণরা হাল ধরেছে। আমার সন্তানরা একাট্টা হয়েছে ‘দানবশক্তি’র বিরুদ্ধে - তাই ‘জয় আমাদের সুনিশ্চিত’।” কিন্তু দেহে বাসা বাঁধা কর্কটব্যাধি তাঁকে দেশব্যাপী জেগে ওঠা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাদীপ্ত মানুষদের নিয়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করার পবিত্র কাজটি সম্পন্ন করতে দেয়নি। ব্যাধি যতই প্রকটতর হয়েছে, উদ্দেশ্য সাধনে তিনি যেন আরো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছেন। মৃত্যুশয্যায়ও তিনি ভোলেননি স্বীয় দায়িত্ব। কম্পিত-হস্তে খোলা চিঠি লিখেছেন - ‘দানব-দমন’-এর দায়িত্ব অর্পণ করেছেন জনগণের ওপর।

১. স্বাধীন বাংলাদেশে নানা অজুহাতে মুক্তিযুদ্ধপক্ষ শক্তির বিভাজন ও ১৯৭১ সালে পরাজিত হওয়া সেই অপশক্তির পুনরুত্থানের গল্পই মোটা দাগে আমাদের বিগত ৪৫ বছরের ইতিহাস। যদিও ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে নেওয়া সদ্যোজাত বাংলাদেশ ঘাতক বাহিনীর সকল মারণযজ্ঞের বিরুদ্ধে এক সরব প্রতিবাদ; কিন্তু বীর বাঙালির কাছে পরাভূত হওয়ার বিষয়টি পাকিস্তানি বাহিনী ও এদেশীয় দালাল/ঘাতকদের কাছে দুর্বহ ছিল। তাই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই বদ্বীপে পুনরায় তাদের আধিপত্য বিস্তারের অপেক্ষায় থেকেছে এই অপশক্তি। পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর একাদিক্রমে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত মূলত সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অঙ্গুলী হেলনে দেশ পরিচালিত হয়। তরুণ মনে প্রোথিত হয় এক অদ্ভুত বিভ্রান্তিকর তথ্যের তরুমূল, যা ক্রমেই শাখা-প্রশাখায় পল্লবিত হয়ে সমাজের এক বিরাট অংশকে গ্রাস করতে সমর্থ হয়েছে। ফলে আজকের তারুণ্যের এক উল্লেখযোগ্য অংশই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি, ইতিহাস ও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত নেতা ও ব্যক্তিবর্গকে অসম্মানের চোখে দেখে; বিভ্রান্তিকর তথ্যপুষ্ট হয়ে এই তরুণ মন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী নানা উস্কানীতে সমর্থন প্রদান করে ও প্রশ্নাতীতভাবে জড়িত হতে আগ্রহী হয় এই দেশের ঘাতক শক্তি, যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে। নির্বাসিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুনরায় তারুণ্যের মনে জাগ্রত করার আন্দোলন শুরু হয় ১৯৯১-এ। শহীদজননী জাহানারা ইমাম নেতৃত্ব দেন সেই আন্দোলনের।

২. ২০০৮ সালের নির্বাচন প্রমাণ করেছে যে বাংলাদেশের তরুণ মনকে সম্পূর্ণভাবে বিভ্রান্ত করা সম্ভব নয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির পক্ষে বাংলাদেশের আজকের তরুণের মতপ্রকাশ এক ইতিবাচক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়। এ দেশের গণশত্রু একদল অতিপরিচিত যুদ্ধাপরাধী যারা একাত্তরে আমাকে এবং আমার মতো নিযুত মানুষকে পিতৃহীন করেছে, কাউকে করেছে মাতৃহীন - বিলম্বে হলেও তাদের বিচারের প্রক্রিয়া যখন শুরু হয়েছে তখন দেখছি অত্যন্ত নগ্নভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এই বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে ও পুরো পরিবেশকে ধোয়াশাচ্ছন্ন করতে তৎপর।

৩. আজ আমরা যাকে ‘জেনোসাইড’ বলে জানি - দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত সে অপরাধকে ছোট এক শব্দে প্রকাশ করার মতো কোনো নাম ছিল না। কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই বর্বরের দল নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে কোনো চিহ্নিত গোষ্ঠী, সম্প্রদায়ের মানুষদের নিশ্চিহ্ন করার মতো অপরাধ বা জেনোসাইড করে আসছে। যুক্তরাজ্যের একদা প্রধানমন্ত্রী চার্চিল বলতেন, এটি ‘নামহীন একটি অপরাধ’। পোল্যান্ডের নাগরিক রাফায়েল লেমকিন সর্বপ্রথম ‘জেনোসাইড’ শব্দটি উল্লেখ করার পর বিশ্ববাসী যুগে যুগে সংঘটিত ‘জেনোসাইড’-এর নারকীয় আখ্যান আরো বিশদভাবে জানতে পেরেছে গবেষকদের কল্যাণে। এর মধ্যে বাংলাদেশের নারকীয় অধ্যায় কোনো কোনো বিচারে নৃশংসতম। বাংলাদেশে শুধু ‘জেনোসাইড’-ই নয়, ‘এলিটিসাইড বা বুদ্ধিজীবী নিধন’ও হয়েছে। আজ যে নামেই অভিহিত করি না কেন, তাতে অপরাধের মাত্রার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটবে না।

৪. মানুকে বিভ্রান্ত করার এজেন্ডা নিয়ে যে গোষ্ঠী বাংলাদেশে তৎপর, তাদের সব অপচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য, কারণ হিসাব মেলাতে হবে মুক্তিযুদ্ধের দর্পণের দিকে চেয়েই। ইতিহাসের সত্য এই যে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের মতো বাংলা ভাষায় কথা বলত এমন একটি গোষ্ঠী পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে মুক্তিকামী মানুষদের হত্যাসহ নানা ধরনের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে লিপ্ত ছিল। যুদ্ধে স্বজন হারানো শহীদ পরিবার ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় অর্জনের সময় থেকেই এসব নরঘাতকের বিচারের দাবি তুলেছে এবং বঙ্গবন্ধু তাদের বিচার প্রক্রিয়া শুরুও করেন। কিন্তু ঘরের ও বাইরের নানা ষড়যন্ত্রের কারণে তা সফলতার মুখ দেখেনি, বরং পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার মাধ্যমে এই বিচারের সব পথ রুদ্ধ করার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা নিতে সচেষ্ট হয় পঁচাত্তর-পরবর্তী (সামরিক বাহিনীর মদদপুষ্ট) সরকারগুলো।

৫. একাত্তরের ঘাতক-দালালের বিচারের দাবিতে আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন তদানীন্তন খালেদা জিয়া সরকার অন্যদের সঙ্গে আন্দোলনের নেত্রী জাহানারা ইমামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করেছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি উত্থাপন করাই ছিল তাঁদের অপরাধ। কিন্তু আজকের তরুণ প্রজন্ম জানে - যে মাতা বিচার চাইলেন সেই সব বর্বরে যাদের অবয়ব রঞ্জিত, তাঁর সন্তান ও এ দেশের লাখ লাখ শহীদের রক্তে; যে মাতা কোরবানি করলেন তাঁর সন্তানকে এই রাষ্ট্রের জন্যে - তিনি কীভাবে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ হবেন? কিন্তু এ জগৎ দেখেছে হন্তারকের বিচার চাইবার অপরাধে একজন শহীদজননীর নাম সরকারের খাতায় উঠেছে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে; এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপবাদ নিয়েই সে শহীদমাতা এই ধরা ত্যাগ করেছেন। বাংলাদেশের তদানীন্তন সরকার যুক্তি বা আবেগ নয়, অপযুক্তি, কু-যুক্তি ও নিরাবেগের বশবর্তী হয়ে সজ্ঞানে শহীদমাতাকে রাষ্ট্রদ্রোহী সাব্যস্ত করেছিল।

৬. কে না জানে, মুক্তিযুদ্ধ ছিল আমাদের অস্তিত্বের লড়াই - তাই ভিনদেশি শত্রু ও তাদের এদেশীয় দোসরদের নিরন্তর ছোবলে মুক্তিকামী বাঙালি একদিকে যেমন ‘নিজ বাসভূমে পরবাসী’ হয়েছে, হয়েছে ‘উদ্বাস্তু’, অন্যদিকে ‘এ লড়াই বাঁচার লড়াই’ জ্ঞানে ঘুরে দাঁড়িয়েছে জীবন বাজি রেখে। তথ্যপ্রবাহের সব দ্বার রুদ্ধ করে ১৯৭১-এ যে দৈত্য-দানোরা নদী-বিধৌত ৫৫ হাজার বর্গমাইলের এই বদ্বীপে ‘পাইকারি হারে মানব-হত্যা‘ ও ‘রমণী দলন’-এর মর্মন্তুদ কাহিনী রচিত করছিল - তাদের ধারণায় ছিল না যে ক্রমেই ঘরে-বাইরে মুক্তিকামী বাঙালিরা একাট্টা হয়ে উঠছে। তাদের সঙ্গে যোগ হচ্ছে সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের সমর্থন। যার ফলস্বরূপ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নিযুত প্রাণের আত্মদান ও অগণিত নারীর সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে এ দেশ হলো আমাদের। ধরা যাক, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় অর্জিত হয়নি। কী হতো তাহলে? যে বৈরী পরিবেশের মধ্য দিয়ে সময় এগুচ্ছিল তখন তা বিবেচনায় নিলে বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় যে, মুক্তিযুদ্ধ প্রলম্বিত হলে শহীদের তালিকা আরো দীর্ঘ হতো, অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হতেন আরো অগণিত নারী, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি আরো দখলে নিত পাকিস্তানি বাহিনীর এদেশীয় দালালেরা। জাতিকে মেধাশূন্য করার উদ্দেশ্যে গঠিত আল-বদর বাহিনী ও আল-শামস বাহিনীর সদস্যরা নিঃসন্দেহে তাদের কাজ সুসম্পন্ন করতে সারা দেশ ঘুরে প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের আরো অনেককে অপহরণ করত এবং নৃশংস নির্যাতনের পর হত্যা করত। কারণ, হত্যাকারী ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের মগজ তখন মুক্তিকামী বাঙালি সম্প্রদায়কে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার দীক্ষায় বুঁদ হয়ে ছিল। গ্রিক মহাকবি হোমারের এক চরিত্র অ্যাগামেমননের নিষ্ঠুরতম সেই সংলাপটি এ ক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য :

“We are not going to leave a single one of them alive, down to the babies in their mothers’ wombs – not even they must live. The whole people must be wiped out in existence, and none be left to think of them and shed a tear.” 

(“এদের একজনকেও আমরা বাঁচিয়ে রাখব না, এমনকি মায়ের গর্ভের শিশুটিকেও নয়, কারণ এদের কারোরই বাঁচার কোনো অধিকার নেই। এদের প্রত্যেককে হত্যা করতেই হবে যেন তাদের কথা মনে করার মতো কিংবা তাদের জন্য চোখের দুই ফোঁটা জল ফেলার মতো কেউই আর অবশিষ্ট না থাকে” - লেখক।)

আজ ২০১৬ সালে চলমান মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারীদের বিচার প্রক্রিয়ার আলোকে মুক্তিযুদ্ধের সাড়ে চার দশকে দাঁড়িয়ে তরুণ প্রজন্ম জানতে পারছে, আমাদের বাবা, মা, আপন স্বজনসহ সব মুক্তিকামী বাঙালিকে হত্যা-নির্যাতনের বিষয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের মনোভাব ছিল উপরোক্ত অ্যাগামেমননের সংলাপের অনুরূপ। যদি সত্যি তারা সময় পেত, তাহলে মুক্তিকামী বাঙালির প্রত্যেককে তারা ঝাড়ে-বংশে শেষ করত।

৭. কোনো সম্প্রদায়ের মানুষদের শারীরিক, মানসিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, নৃতাত্ত্বিকসহ সর্বতোভাবে পঙ্গু ও নিশ্চিহ্ন করতে হত্যাসহ যাবতীয় ধারাবাহিক ও নিরন্তর প্রচেষ্টা নেওয়ার অপর নাম “জেনোসাইড”, যা আমাদের ওপর ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে চূড়ান্তভাবে আরোপিত হওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু বাঙালির পরিচয় মুছে দেওয়ার কাজটি তো চলেছে পুরো পাকিস্তানপর্ব (১৯৪৭-১৯৭১) জুড়ে। বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতির ওপর আঘাত এসেছে পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই এবং তা ক্রমাগত আরো কঠিনতর হয়েছে। ১৯৭০-এর নির্বাচনে পুরো পাকিস্তানের নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের অন্যান্য বাঙালির কাছে অর্পিত হলে পাকিস্তানিচক্রের আত্মগরিমায় আঘাত লাগে - ফলে এর প্রত্যুত্তরে তারা চূড়ান্তভাবে পাল্টা আঘাত হানে, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি নিধন। এ নিধনযজ্ঞ বাস্তবায়নে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাংলাভাষী ‘বিভীষণ’-এর দল মুক্তিযুদ্ধের সূচনাভাগে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী এবং যুদ্ধের কয়েক মাস অতিবাহিত হওয়ার পর হিটলারের এসএস ফোর্স-এর অনুকরণে ঘাতক বাহিনী আল-বদর ও আল-শামস গড়ে তোলে।

৮. জেনোসাইড বা গণহত্যার পেছনে যে দর্শন ও মনোবিদ্যা কাজ করে, তা অনুধাবন না করে উপেক্ষা করলে আমরা আবারও আত্মঘাতী ভয়াবহ এক ভবিষ্যৎ নির্মাণ করব। বিষয়টি বোঝার সুবিধার জন্য প্রথমে সাদা দাগে আমরা এ পৃথিবীর মানুষদের দুই ভাগে ভাগ করে নিই: একদল যারা গণহত্যাকারী/এর পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতাকারী/সমর্থক এবং আরেক দল যারা গণহত্যার শিকার এবং/অথবা এর বিরোধিতাকারী। প্রথমোক্ত দলের মানুষেরা এই পৃথিবীতে যুগে যুগে নিজেদের দর্শনকে শ্রেষ্ঠ ও অবশ্যমান্য ভেবেছে এবং তা অন্যের ওপর জোরজবরদস্তি করে চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। তাদের এই বিকারগ্রস্ততার মাত্রা ক্রমশ এতটাই ভয়াবহ হয়ে উঠতে থাকে, যে তারা মানুষের চেহারা ধারণ করেই ভেতরে ভেতরে একেকজন অমানুষ হয়ে ওঠে। ফলে তারা যাদেরকে শত্রু ভাবে- তাদের আর নিস্তার নেই। অ্যাগামেমননের মতো তাদের শত্রুপক্ষকে নির্বংশ করতে হত্যালীলায় মেতে উঠে দানবীয় আনন্দ উপভোগ করে। এরা অন্ধকারের কুশীলব। ঠিক এর বিপরীত মানসিকতাসম্পন্ন হয় শেষোক্ত দলের মানুষেরা। জীবন দিয়ে হলেও রক্ষা করতে চায় যা কিছু সভ্য, যা কিছু ভালো, যা কিছু মানবীয়। এরাই আলোর পথযাত্রী। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পক্ষ ছিল দুটি : একদিকে অন্ধকারের কুশীলব, অন্যদিকে আলোর পথযাত্রী। পাকিস্তানি প্রভুর আশীর্বাদ নিয়ে এই দানবীয় শক্তি ‘হাউ-মাউ-খাউ, মানুষের গন্ধ পাউ’ বলে বাংলাদেশের নগর-বন্দর-গ্রাম-গঞ্জে, পথে-প্রান্তরে, জল-স্থল-অন্তরীক্ষে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। দানবের আকস্মিক আক্রমণের আশঙ্কায় মুক্তিকামী এদেশবাসী প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর প্রহর গুনেছে যেমন সত্য; অন্যদিকে জীবনের পূর্ণ ঝুঁকি নিয়ে পল্লী-গাঁয়ের প্রৌঢ়া মাতা, দরিদ্র কৃষক কিংবা গ্রাম্য বালা কখনো আশ্রয় দিয়েছে, কখনো ক্ষুৎপিপাসা মিটিয়েছে আলোর যাত্রী মুক্তিযোদ্ধাদের। ফলে দানব-বেষ্টিত এই দেশে মুক্তিযোদ্ধারা আপামর সাহসী মানুষের সহযোগিতায় লড়াই চালিয়ে যেতে পেরেছে মানুষখেকো অমানুষদের বিরুদ্ধে।

৯. পুরো মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি এককভাবে বাংলাদেশের লড়াই ছিল না - বিশ্বের আপামর গণমানুষের বাঁচার লড়াইয়েরই একটি ধারা ছিল এই যুদ্ধ। বিশ্ব রাজনীতির আওতাভুক্ত অন্যান্য দেশ কেউ আমাদের পক্ষে কেউ বা আমাদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। আজকের পৃথিবীতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির বিপক্ষে যাওয়ার কুশীলবের হয়তো অভাব হবে না। কিন্তু মানবতার প্রতি চরম অবমাননা করে ১৯৭১ সালে আমাদের দেশে যারা যুদ্ধাপরাধ করেছিল তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো আজকের তারুণ্যের জাতীয় কর্তব্য। স্বাধীন বাংলাদেশে ইতিহাস ঐতিহ্য বিসর্জনের যে সংস্কৃতি আমরা তৈরি করেছি, তা থেকে বেরিয়ে এসে কে সম্মানের পাত্র ও কে ঘৃণার পাত্র তা অনুধাবন করার মতো পরিবেশ নিশ্চিত করতে আজকের তরুণ প্রজন্ম আগুয়ান হয়েছে, আরো হবে। লাখ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের ফসল আমাদের প্রিয় জন্মভূমি কোন রাজনৈতিক দর্শনকে প্রাধান্য দেবে, আমাদের অনাগত প্রজন্ম কোন মতাদর্শকে ধারণ করে বিকশিত হবে তা নির্ধারিত হয়ে গেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে। ইতিহাসের আলোকেই এ দেশের অনাগত তরুণদের পক্ষ নির্ধারণ করতে হবে। মেধা ও মনন গঠনে আমাদের ভাবী প্রজন্ম নিশ্চয় আরো ইতিহাসমুখী হবে, দেশের ভিত্তিভূমির প্রতি সম্মান জানাবে এবং তাদের কর্তব্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে নির্ধারণ করে নেবে। নিশ্চয় এই বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাদীপ্ত হবে। এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মাঝে যুগোপযোগী সব অধিকার নিশ্চিত করার যে অঙ্গীকার রয়েছে, তার রশ্মিতে এই দেশ দীপ্যমান থাকবে চিরকাল। সেই সত্য অনুধাবন করার কাজটি সফলভাবে তরুণ প্রজন্মের হৃদয়ে প্রোথিত করার মূল কৃতিত্ব দিতে হবে শহীদজননী জাহানারা ইমামকে। আজ বাইশতম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।