সোজা কথা

মিতু হত্যার রহস্যের জট খুলবে কি?

Looks like you've blocked notifications!
নাজিয়া আফরীন

এক অদ্ভুত সময়ের বেড়াজালে বন্দি আমরা সবাই। কেমন এক দমবন্ধ করা সন্দেহ, অবিশ্বাস চারপাশে। বিশ্বাস করাই কঠিন এখন সবকিছু। ভালোমন্দের হিসাবনিকাশই যেন এখনকার অস্থির সময়ে বেমানান। কার লাভ-ক্ষতির হিসাব মেলাতে গিয়ে কাকে যে কখন বলি হতে হয় তাই যেন এখন সব মানুষেরই চিন্তার বিষয়। নির্মম হলেও সত্য যে আমাদের দেশের পুলিশ বাহিনীর ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা বরাবরই কম। তার ওপর সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক দুর্ঘটনা সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। বদনাম যত সহজে সব মানুষের কানে পৌঁছায়, সুনাম কিন্তু তত জনপ্রিয়তা পায় না। 

তারপরও চট্টগ্রামের পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তার সেই কঠিন কাজটি করতে পেরেছিলেন। তিনি সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, বাবুল আক্তার এমন একজন পুলিশ অফিসার হতে পেরেছিলেন যার জন্য জনসাধারণ মসজিদ-মন্দিরে দোয়া করেছেন এবং যার বদলির খবর শুনে স্থানীয়রা নিজ এলাকায় রাখতে মানববন্ধন-আন্দোলনও করেছেন। পুলিশ মানেই জনমনে যে ধারণার জন্ম নেয়, সেই চিরাচরিত ধারণা পাল্টে দিয়ে বাংলাদেশ পুলিশে অনন্য নজির স্থাপন করেছেন তিনি। সততা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও সাহসী কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে পুলিশের দায়িত্ব পালনে, সমাজ সংস্কারমূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ঠিক এতটাই জনপ্রিয় তিনি সাধারণ মানুষের কাছে। পুলিশ বাহিনীতে চৌকস অফিসার হিসেবে বাবুল আক্তারের একটা ইমেজ ছিল। 

জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সাহসিকতার জন্য তিনি তাঁর বাহিনীতে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিও পেয়েছেন। সেই সাহসী পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে (৩৩) ৫ জুন রোববার সকালে চট্টগ্রাম মহানগরীর জিইসি মোড় এলাকায় ছুরিকাঘাত ও গুলি করে নৃশংসভাবে খুন করে দুর্বৃত্তরা। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বাবুল আক্তার বাদী হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন। হত্যাকাণ্ডের তদন্তের কয়েকদিন পর পরই নিচ্ছে নতুন মোড়। ঘটনার পর পুলিশ জানায়, জঙ্গি দমনে বাবুল আক্তারের সাহসী ভূমিকা ছিল। এ কারণে জঙ্গিরা তাঁর স্ত্রীকে খুন করে থাকতে পারে। হত্যাকাণ্ডের পর বাবুল আক্তার অজ্ঞাতপরিচয় তিন ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা করেন।

২০১৫ সালের ৫ অক্টোবর নগরীর কর্ণফুলী থানার খোয়াজনগরে তৎকালীন অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) বাবুল আক্তারের নেতৃত্বে নগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি টিম অভিযান চালিয়ে পাঁচ জেএমবি সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। এদের মধ্যে জেএমবির চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিস্ফোরক শাখার প্রধান মো. জাবেদ ওরফে জায়েদকে নিয়ে ডিবি আরেকটি অভিযানে গেলে সে গ্রেনেড বিস্ফোরণে মারা যায়। খোয়াজনগর থেকে গ্রেপ্তার হওয়া পাঁচ জঙ্গি হলেন মো. জাবেদ (২৪), ফুয়াদ ওরফে মো. বুলবুল (২৬), সুজন ওরফে বাবু (২৫), মাহবুব (৩৫) এবং সোহেল ওরফে কাজল (৩৫)।

মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকাণ্ডের পর গোয়েন্দাদের হাতে আসে কারাবন্দি জেএমবি সদস্য ফুয়াদ ওরফে বুলবুলের লেখা এক চিরকুট, যা নিয়ে বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু হত্যাকাণ্ড অনুসন্ধানে নামে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। পরে তাঁকে রিমান্ডেও নেওয়া হয়।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, গত মাসে বুলবুলের লেখা ওই চিরকুটটি নগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাতে আসে। কিন্তু এ নিয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধানের মধ্যেই হত্যাকাণ্ড ঘটে যায়। চিঠিতে জেএমবি নেতা জাবেদের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পুলিশ সদস্যদের হত্যার আহ্বান জানানো হয়। বিভিন্ন হাত ঘুরে চিরকুটটি পৌঁছায় পিবিআইসহ আরো এক গোয়েন্দা সংস্থার কাছে।

চিরকুটের আহ্বান অনুযায়ী বাবুল আক্তারের ওপর প্রতিশোধ নিতে জেএমবি মিতুকে খুন করেছে কি না পিবিআই এখন সেটি খতিয়ে দেখছে। বুলবুলসহ বাকি ‍চার সদস্যের কাছ থেকে পুলিশ জঙ্গি কর্মকাণ্ড সম্পর্কিত বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর তথ্য উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। বর্তমানে কারাবন্দি বুলবুল জেএমবির চট্টগ্রাম অঞ্চলের সেকেন্ড ইন কমান্ড। দুই পৃষ্ঠার চিরকুটের শেষ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় প্যারায় জায়েদকে হত্যা ও নির্যাতনের প্রতিশোধে পুলিশ সদস্যদের হত্যার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। হয়তো জেএমবির শীর্ষ নেতৃত্বের কাছেই চিরকুটটি পাঠানো হচ্ছিল। সেখানে বুলবুল লিখেছেন, যেখানে যে অবস্থায় পুলিশ কর্মকর্তাদের পাওয়া যাবে সেখানেই যেন তাদের হত্যা করা হয়। এসব খবর আমরা গণমাধ্যমেই দেখেছি।

যাই হোক এর সমাধান হতে না হতেই শুক্রবার (২৪ জুন) মধ্যরাত থেকে শনিবার (২৫ জুন) বিকেল পর্যন্ত বাবুল আক্তার নিখোঁজ থাকায় জন্ম নেয় নানা জল্পনা-কল্পনা ও প্রশ্নের। এ বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিক কোনো কথা না বলায় চারদিকে গুজবের ডালপালা ছড়াতে থাকে।

পরে আসামি শনাক্ত ও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এসপি বাবুল আক্তারকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এমনটি পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হলেও একটি মহল তাঁর দিকেই হত্যাকাণ্ডের সন্দেহের তীর ছুড়ে দেয়। এমনকি নানা মহল থেকে গুজবও ওঠে, বাবুল আক্তারকে আটক করে চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু শনিবার বিকেলেই ডিএমপির গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগের (ডিবি) উপকমিশনারের (ডিসি, পূর্ব) গাড়িতে করে বাবুল আক্তার বাড়ি ফিরে আসেন।

মেয়ের জামাইকে নিয়ে কিছু গণমাধ্যমে অতি উৎসাহী সংবাদ প্রচারে নিন্দা প্রকাশ করেন বাবুল আক্তারের শ্বশুর সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন।

তিনি জানান, ‘একটি চক্র দুটি পরিবারের চরিত্র হননের চেষ্টা এবং মিতু হত্যার তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার উদ্দেশ্যেই এসব করছে। সে খুব মেধাবী। পেশাগত শত্রুরা তার (বাবুল) পেছনে লাগতে পারে। তারাই গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা খবর প্রচার করিয়েছে। সব পেশাতেই কে কাকে ডিঙিয়ে এগিয়ে যাবে, এখন সেই অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। সেই চক্রের চক্রান্তেরই অংশ এমন সংবাদ।’

তিনি আরো জানান, ‘মেয়ে হত্যার বিচার নিয়ে হতাশ নই। প্রকৃত খুনিরা ধরা পড়বে। তাদের বিচার হবেই। তাই নিরপরাধ কাউকে যেন হয়রানি বা গ্রেপ্তার করা না হয়।

কোনো আসামিকে ক্রসফায়ারে দেওয়া না হয়। তবে তদন্তের স্বার্থে মামলার বাদী হিসেবে বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে কোনো আপত্তি নেই।’

সিএমপি সূত্রে জানা যায়, পুরো চট্টগ্রাম বিভাগটি জঙ্গিদের পাশাপাশি মাদক পাচারের জন্য খুবই ‘হট স্পট’। বিশেষ করে টেকনাফ ও কক্সবাজারে ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক খুব সহজলভ্য। ওইখান থেকে মাদক আসে চট্টগ্রাম শহরে এবং সেখান থেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। অভিযোগ আছে, কোনো ঝামেলা ছাড়া মাদক পাচারের জন্য মাদক ব্যবসায়ীরা একধরনের ‘সিকিউরিটি মানি’ দিয়ে আসছিল বিভিন্ন মহলকে। কিন্তু বাবুল আক্তার জঙ্গিদের পাশাপাশি মাদক ব্যবসায়ীদের জন্য দুঃসংবাদ নিয়ে আসেন। তিনি সিএমপি ও কক্সবাজারে দায়িত্বরত অবস্থায় জঙ্গিসহ বিভিন্ন মাদক ব্যবসায়ীদের দমন করেন। এতে মাদক ব্যবসায়ীরা বেকায়দায় পড়ে, সঙ্গে ওই সব স্থানীয় প্রভাবশালী মহলও বঞ্চিত হয় বাড়তি আয় থেকে। তাই তারা বাবুল আক্তারকে পছন্দ করতেন না। প্রশ্ন উঠেছে বাবুল আক্তার পদোন্নতি পেয়ে ঢাকায় বদলি হয়ে আসার পর সে কারণেই কি অকেজো হয়ে পড়ে অনেক সিসিটিভি ক্যামেরা? ক্যামেরা লাগানোর উদ্যোগও বাবুল আক্তারই নিয়েছিলেন।

বাবুল আক্তারের স্ত্রী হত্যাকাণ্ডসহ আরো কিছু হত্যাকাণ্ডের তদন্তের জের ধরে পুলিশ সারা দেশে সপ্তাহব্যাপী বিশেষ অভিযানের ঘোষণা দেয়। পুলিশ বলছে, সাতদিনের অভিযানে মোট ১৯৪ জন সন্দেহভাজন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জঙ্গিবিরোধী অভিযানে ঢালাও গ্রেপ্তারের অভিযোগ ওঠার পর থেকে সারা দেশে মোট গ্রেপ্তারের তথ্য আর গণমাধ্যমকে জানায়নি পুলিশ সদর দপ্তর।
পুলিশের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া ১৯৪ জন সন্দেহভাজন জঙ্গির মধ্যে ১৫১ জন জেএমবি, সাতজন জেএমজেবি, ২১ জন হিযবুত তাহরীর, নয়জন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, চারজন আল্লার দল, একজন হরকাতুল জিহাদের সদস্য এবং একজন আফগান ফেরত জঙ্গি।
এদিকে, পুলিশ বাবুল আক্তারকে হঠাৎ করে ঢাকায় তার শ্বশুরবাড়ি থেকে গভীর রাতে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর দীর্ঘ সময় সে তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি। বিষয়টি নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, বাবুলকে কেন এভাবে নিয়ে যাওয়া হলো? তাকে কি গুম করে ফেলা হবে ইত্যাদি নানা প্রশ্ন। বাবুলকে নিয়ে যাওয়ার পর শনিবার (২৫ জুন) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘আসামি শনাক্তের জন্য বাবুল আক্তারকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারকে কয়েকজন আসামির সামনে মুখোমুখি করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাঁর স্ত্রী মিতু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেপ্তার তিন আসামিকে চিহ্নিত করতে ও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাবুল আক্তারকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখনো সবকিছু জানানোর সময় হয়নি। তবে শীঘ্রই সবকিছু জানতে পারবেন।’

এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন করা হলে ২৬ জুন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘মিডিয়ায় নানা সময় নানা ধরনের খবর আসে। এগুলো সব মিথ্যা তাও ঠিক নয় আবার সব সত্য তাও ঠিক নয়। এ ঘটনায় সিএমপিতে একটি মামলা হয়েছে। এ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছে এবং হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত একটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ মামলার বাদী যেহেতু বাবুল আক্তার, তাই আইন মেনেই তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা যেতেই পারে। এটি তদন্তের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ। এটা নিয়ে অপব্যাখ্যার কোনো দরকার বা সুযোগ নাই।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা তাঁকে কল করেছিলাম, তুলে নিয়ে যাইনি। বাবুল আক্তার পুলিশের একজন এসপি। মামলার সংশ্লিষ্ট বিষয় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে কল করা হয়। বাবুল আক্তারকে তাঁরা টেলিফোন করে বলেছিলেন, তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন, তিনি যেতে পারবেন কি না। জবাবে বাবুল বলেছিলেন, গাড়ি পাঠালেই তিনি যাবেন। তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। আমরা তো আর তাঁকে সিএনজি বা রিকশায় আসতে বলতে পারি না। আমরা গাড়ি পাঠিয়েছি, উনি এসেছেন। আমাদের ডিবি অফিসে বসে সিএমপির তদন্তকারী দল তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এখানে ডিএমপির কোনো বিষয় নয়। ডিএমপি কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করেনি, ডিএমপি কাছেই যায়নি। এখন তারা সকালে কমফোর্টেবল, না বিকেলে কমফোর্টেবল, না রাতে কমফোর্টেবল- দ্যাটস অ্যানাদার থিং। সেটা উভয় পক্ষের সম্মতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।’

হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বাবুল আক্তারের দায়ের করা মামলায় দুজনকে এর আগে গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে। নতুন করে আরো দুজনকে গ্রেপ্তার করার কথা জানিয়ে একদিন বিকেলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার ইকবাল বাহার সাংবাদিকদের বলেন, ‘গ্রেপ্তার ওয়াসিম ও আনোয়ার দুজনই পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম (মিতু) হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয়। তারা দুজন পেশাদার খুনি। তারা পরিকল্পিতভাবে পুলিশ পত্নী মিতুকে হত্যা করেছে।’

গ্রেপ্তারদের দেওয়া তথ্য উল্লেখ করে ইকবাল বাহার বলেন, ‘ওয়াসিম মোটরসাইকেলে ছিল। সে সরাসরি মিতুকে গুলি করেছে। আর আনোয়ার ব্যাকআপ টিমের সদস্য ছিল। তারা হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিতে রাজি হয়েছে।’ সেদিন তাদের আদালতে হাজির করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

তবে কেন, কী কারণে তারা মিতুকে হত্যা করে বা কারা এ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাব কৌশলে এড়িয়ে যান পুলিশ কমিশনার ইকবাল।

গ্রেপ্তারকৃতরা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত কি না এ প্রশ্নের জবাবে পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘খুনিরা পেশাদার। তাদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই।’

মিতু হত্যার সঙ্গে জঙ্গিরা সংশ্লিষ্ট- পুলিশ শুরু থেকে এমন দাবি করে এলেও এখন তা থেকে সরে এসেছেন, কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘আমরা আমাদের কোনো বক্তব্য থেকে সরে আসিনি। মামলার তদন্ত চলছে। ছয় থেকে সাতজন এ ঘটনায় জড়িত। বাকি যারা, সবাইকে পেলে তদন্ত করে ঘটনার মোটিভ বলতে পারব। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সব কিছু বলা যাচ্ছে না।’

মিতুর স্বামী পুলিশের এসপি বাবুল আক্তারকে নজরবন্দি রাখা হয়নি উল্লেখ করে কমিশনার বলেন, ‘তার বাসায় নিরাপত্তার জন্য পুলিশ দেওয়া হয়েছে। বাদীকে জিজ্ঞাসাবাদ আমি বলব না, তার সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে এবং পরে তিনি বাসায় চলে যান।’

জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মধ্যরাতে কেন তুলে নিয়ে যাওয়া হলো এবং এরপর কেন তাঁর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতে পারেননি স্বজনরা- এসব প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দেননি সিএমপি কমিশনার।

প্রতিদিন পত্রিকায় মিতু হত্যারহস্য নিয়ে নানা প্রশ্ন দানা বেঁধে উঠছে। যে প্রশ্নের সন্তোষজনক কোনো জবাব মিলছে না। সদ্য মাতৃহীন দুই সন্তান এবং পরিবারের আর কারো সঙ্গে ওই জিজ্ঞাসাবাদের সময় যোগাযোগ করতে না দেওয়ার কোনো ব্যাখ্যা নেই। মিতু হত্যার তদন্ত ঘিরে রহস্য খোলাসা হওয়ার চেয়ে তা আরো জটিল হতে শুরু করেছে। কাকে রক্ষা করার চেষ্টা হচ্ছে, সেই প্রশ্ন ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। কেন অপরাধীকে রক্ষা বা আড়াল করতে হবে? ভাড়াটে খুনিরা আদালতে জবানবন্দি দিয়ে নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে নেয়, কিন্তু তাদের যে বা যাঁরা ভাড়া করেছেন, তাঁদের পরিচয় জানা যাবে না, এমনটি মেনে নেওয়া কঠিন। অথচ তেমনটিই ঘটছে। 

রোববার ২৬ জুন চট্টগ্রামের আদালতে মিতু হত্যায় জড়িত যে দুজন সন্দেহভাজন ব্যক্তি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন, তাঁরা কেউই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বা আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছেন, এমন কথা বলেননি। পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, তাঁরা দুজন স্রেফ ভাড়াটে খুনি। অথচ শুরুতে এমন ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে। তদন্ত শুরুর আগে এবং তদন্তের সময়েও রাজনৈতিক দোষারোপ দেখতে আমরা অভ্যস্ত। ফলে চাঞ্চল্যকর মামলাগুলোর তদন্ত রাজনৈতিক ধারাতেই পরিচালিত হতে থাকে এবং বিচারপ্রার্থীদের চোখের পানি মোছা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। এমনটি বিএনপির আমলেও হয়েছে এবং তার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বর্তমানের মন্ত্রী-সাংসদরাও বলে থাকেন। অথচ এর কোনো সুরাহা হচ্ছে না।

‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় এসেছে বাবুল আক্তার আর তাঁর কর্মক্ষেত্রে ফিরবেন কি না তা নিয়েই সংশয় দেখা দিয়েছে। তিনি আর চাকরিতে ফিরছেন না বলে অসমর্থিত একটি সূত্র জানিয়েছে বলে পত্রিকায় প্রকাশ।‌ সর্বত্র আলোচনা, বাবুল আক্তার কি পুলিশ বাহিনী থেকে চলে যাচ্ছেন? একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, কর্মকর্তাদের একটি অংশ চায় না, তিনি আর বাহিনীতে ফিরে আসুন। পুলিশ বাহিনীর ভেতরেও এ নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে।

জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।

বাবুলের এক স্বজন বলেন, ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর থেকে কাজে ফেরা নিয়ে বাবুলের মধ্যেও সংশয় তৈরি হয়েছে। গত শুক্রবার গভীর রাতে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাঁকে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। এরপর ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়। সেখানে যে পুলিশ পাহারা ছিল, তাও তুলে নেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে প্রথম আলো জানিয়েছে, গত শুক্রবার রাতে বাবুলকে ডিবি কার্যালয়ে আনার পর এক উপকমিশনারের কক্ষে ডিআইজি পদমর্যাদার তিনজন কর্মকর্তা জিজ্ঞাসাবাদ করেন। ওই সময় তাঁকে দুটি শর্ত দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। বলা হয়, ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার সব তথ্য-প্রমাণ তাঁদের হাতে রয়েছে। তাঁকে জেলে যেতে হবে অথবা বাহিনী থেকে সরে যেতে হবে। বাহিনী থেকে সরে যাওয়ার ব্যাপারে বাবুল সম্মতি দেন বলে জানা গেছে।

জিজ্ঞাসাবাদে থাকা দুজন কর্মকর্তার কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তাঁরা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। একজন কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ মহাপরিদর্শক ছাড়া এ ব্যাপারে কেউ কিছু বলতে পারবেন না।

এদিকে দুই আসামির আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তাঁরা আদালতে পরস্পরবিরোধী তথ্য দিয়েছেন বলে জানা গেছে। জবানবন্দিতে আসামি মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম বলেছেন, তিনি ফাঁকা গুলি ছুড়েছেন। তাঁর কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে কামরুল সিকদার ওরফে মুছা গুলি করেন মাহমুদাকে। আরেক আসামি মো. আনোয়ার বলেছেন, মাহমুদাকে গুলি করেছেন ওয়াসিম। তাঁর গুলিতেই বাবুল আক্তারের স্ত্রী মারা যান।
 

মুছাকে আটক করা হয়েছে কি না, এ বিষয়ে গতকাল সোমবার ২৭ জুনও পুলিশ স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট নগর পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, মাহমুদা হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া সাত-আটজন আসামি পুলিশের নজরদারিতে রয়েছেন। যেকোনো সময় পুলিশ তাঁদের আটক কিংবা গ্রেপ্তার দেখাতে পারে। ওয়াসিম ও আনোয়ারকে গত শনিবার গ্রেপ্তার করা হয় বলে পুলিশ জানায়।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও বলেছেন, এ হত্যার সঙ্গে জড়িত আরো দু-একজন ধরা পড়বে বলে তিনি নিশ্চিত। মাহমুদা হত্যায় জড়িত সন্দেহভাজনদের শনাক্ত করা হয়েছে। বাবুল আক্তারকে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সন্দেহভাজন আসামিদের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিতে তাঁকে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়েছিল।

আদালত সূত্র জানা গেছে, দুই আসামি জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন হত্যাকাণ্ডে ওয়াসিম, আনোয়ার, মো. রাশেদ, আবদুল নবী, মো. শাহজাহান, কামরুল সিকদার ওরফে মুছা ও মো. কালু অংশ নেন। ওয়াসিম, মুছা ও আবদুল নবী মোটরসাইকেলে ছিলেন। বাবুল আক্তারের স্ত্রীকে ছুরিকাঘাত করেন আবদুল নবী। অন্যরা ঘটনাস্থলের আশপাশে ছিলেন। ভোলা নামের এক ব্যক্তি অস্ত্র সরবরাহ করেন। জবানবন্দিতে বলা হয়, বাবুল আক্তারের স্ত্রীকে তাঁরা চিনতেন না। মুছার কথামতো ভাড়াটে হিসেবে তাঁরা খুনে অংশ নেন। মুছাকে পুলিশের ‘বড়’ সোর্স হিসেবে তাঁরা জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন। জবানবন্দিতে কোনো পুলিশ কর্মকর্তার নাম তাঁরা বলেননি।

তবে সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাদের দাবি একটাই, বাবুল আক্তার যদি দোষী হন তবে তাঁকে কেন বিচারের আওতায় না এনে চাকরি থেকে সরে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হবে? আর যদি তিনি দোষী না হয়ে থাকেন তবে কোন অপরাধে তিনি স্বজন হারাবেন? সেই সঙ্গে হারাবেন তার এতদিনের অর্জন? কোনোটাই গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা সত্যটা জানতে চাই।

লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ