সোজা কথা

বাংলাদেশের বিষাদময় ঈদ

Looks like you've blocked notifications!

বাংলাদেশের মানুষের জন্য এবারের ঈদটা ছিল একেবারেই অন্যরকম। এমন বিষাদময় ঈদ আর কখনো আসেনি এই দেশে। নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমরা বারবার বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেও ঠিক মাথা তুলে দাঁড়িয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছি, মাথার ওপর ছাদ আর পেটে ঠিকমতো খাবার না জুটলেও মুখের হাসি ম্লান হয়নি কখনোই। কিন্তু সবাই মিলে আনন্দে থাকা মানুষগুলোর হাসিমুখ মিলিয়ে দিয়েছে গুটিকয়েক দিকভ্রান্ত মানুষ। চারপাশে চাপা আতঙ্ক, ভয় আর অবিশ্বাসের বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিয়েছে এই অসুস্থ মানুষগুলো।

পয়লা জুলাইয়ে গুলশানে হলি আর্টিজান নামের একটি রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার ঘটনায় সারা দেশের মানুষের বিহ্বলতা কাটতে না কাটতেই ঈদের দিন সকালে ঈদের জামাত শুরুর আগে দেশের ঐতিহ্যবাহী শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলা। এই প্রথমবারের মতো কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ময়দানে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে জঙ্গিগোষ্ঠী। এটা ছিল কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ময়দানে ১৮৯তম ঈদুল ফিতরের জামাত। মসনদ-ই-আলা ঈশা খাঁর ষষ্ঠ বংশধর দেওয়ান হয়বত খান বাহাদুর কিশোরগঞ্জের জমিদারি প্রতিষ্ঠার পর ১৮২৮ সালে এই ঈদগাহ চালু করেন। প্রথম জামাতে সেখানে সোয়া লাখ মুসল্লি অংশগ্রহণ করেন বলে মাঠের নাম হয় ‘সোয়া লাখি মাঠ’। পরে উচ্চারণের বিবর্তনে তা পরিণত হয় আজকের নাম শোলাকিয়ায়। ঈদ জামাতে দূর-দূরান্ত থেকে মুসল্লিদের আসার সুবিধার্থে ‘শোলাকিয়া স্পেশাল’ নামে দুটি বিশেষ ট্রেনেরও ব্যবস্থা করে রেল কর্তৃপক্ষ। গত ১ জুলাই ঢাকার গুলশানে বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন জঙ্গি হামলার ঘটনায় ২০ জন নিহতের পর এবার দেশের প্রধান সব ঈদ জামাতেই বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। শোলাকিয়াতেও ওয়াচ টাওয়ার থেকে এবং ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার সাহায্যে প্রতি মুহূর্তের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। ঈদের সকাল থেকে ঈদগাহ মাঠ ও আশপাশের এলাকায় সহস্রাধিক পুলিশ সদস্যের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক র‍্যাব ও আর্মড পুলিশ সদস্য মোতায়েন ছিলেন বলে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে।

প্রায় ২০০ বছর ধরে শোলাকিয়ায় ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কিন্তু এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা এর আগে কখনো দেখেনি কিশোরগঞ্জবাসী। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ অনুযায়ী, সকাল ৯টার দিকে মুসল্লিরা যখন নামাজের জন্য শোলাকিয়ার মাঠে যাচ্ছিলেন, তখন চাপাতি হাতে কয়েকজন যুবককে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখেন তাঁরা। এ সময় মাঠের পাশেই আজিমউদ্দীন স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা টহল পুলিশের একটি দল তাদের দিকে এগিয়ে গেলে বোমা হামলা করে দুর্বৃত্তরা। তখন প্রাণভয়ে যে যেদিকে পারে, দৌড়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। হামলাকারীরা সংখ্যায় ৮-১০ জন ছিল। বোমা হামলার পর পুলিশ ও হামলাকারীদের মধ্যে দফায় দফায় গুলিবিনিময় হয়। হামলাকারীরা প্রথমে আজিমউদ্দিন স্কুলের আশপাশের বাড়িতে গিয়ে ঢুকে পুলিশের ওপর গুলি চালায়। এ সময় পুলিশও পাল্টা অবস্থান নিয়ে গুলি করে। গুলশানের সন্ত্রাসী হামলার পর এবার শোলাকিয়া মাঠে প্রবেশে সর্বোচ্চ কড়াকড়ি ও কঠোর নিরাপত্তা ছিল।

মাঠে প্রবেশের সব পথে নিরাপত্তা চৌকি বসানো হয়। মুসল্লিদের ব্যাগ ও দেহ তল্লাশি করে মাঠে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। এই ধরনের কড়াকড়ি ও কঠোর তল্লাশি না করলে সাধারণ মুসল্লিদের সঙ্গে নির্বিঘ্নে মাঠে প্রবেশ করে আরো বড় ধরনের ভয়াবহ নাশকতা ও প্রাণহানির জঘন্যতম ঘটনা ঘটত বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়ি ও কঠোর নিরাপত্তার মাঝেই লাখ লাখ মুসল্লি মাঠে প্রবেশ করেন। সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় পুরো মাঠ। সন্ত্রাসী হামলার খবর পুলিশ ও মাঠে উপস্থিত সুশীলসমাজের নেতারা জানতে পারলেও আগত মুসল্লিদের তা জানতে দেওয়া হয়নি। দূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণেই মাঠে কোনো গোলযোগ হয়নি। জামাতে ইমামতি করার কথা ছিল মাওলানা ফরিদউদ্দিন মাসুদের। হেলিকপ্টারযোগে তিনি কিশোরগঞ্জ এলেও নিরাপত্তার কারণে তিনি মাঠে আসেননি। তিনি না আসার পরও মাওলানা সোয়েবকে দিয়ে নামাজ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করা হয়।

এদিকে বোমায় নিহত হয়েছেন কনস্টেবল জহুরুল হক ও আনছারুল। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে পুলিশের গোলাগুলির সময় নিজের বাড়িতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন গৃহবধূ ঝর্ণা রানী ভৌমিক। পুলিশের গুলিতে অজ্ঞাতপরিচয় এক হামলাকারী নিহত হয়েছে, আটক হয়েছে তিনজন। বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন তিন পথচারী। র‌্যাব ‌১৪-এর মেজর সাইফুল সাজ্জাদ জানান, শফিউল ইসলাম ওরফে আবু মোকাদ্দেল (১৯) নামের এক হামলাকারীকে আহত অবস্থায় আটক করা হয়েছে। শফিউল জানিয়েছে, তার বাড়ি দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে। সেখানে এক মাদ্রাসা থেকে তার আলিম পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। পরীক্ষা না দিয়ে ‘ওস্তাদের’ কথায় ‘অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে’ সে কিশোরগঞ্জে চলে আসে। তার সঙ্গে হামলায় আরো পাঁচজন ছিল, যাদের সে চেনে না বলে দাবি করেছে। এ ছাড়া পুলিশ আরো দুজনকে আটক করেছে বলে কিশোরগঞ্জ মডেল থানার ওসি মীর মোশাররফ হোসেন নিশ্চিত করেছেন। 

কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলাকারী নিহত জঙ্গি সদস্য আবির রহমান নিখোঁজ ছিল চার মাস ধরেই। শোলাকিয়ায় নিহত হওয়ার আগের দিন তাঁর নিখোঁজ থাকার বিষয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে রাজধানীর ভাটারা থানায়। ফেসবুক ও গণমাধ্যমে ছবি দেখে স্বজনরা জানতে পারেন, শোলাকিয়ায় নিহত হয়েছেন আবির। আবির রহমানের বাবার নাম সিরাজুল ইসলাম। রাজধানীতে তাদের বাড়ি, ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়। তাঁর বাবা ঠিকাদারি করেন। চার ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট আবির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথে বিবিএ পড়তেন। এর আগে তিনি ‘ও-এ’ লেভেল সম্পন্ন করেন বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল টিউটোরিয়ালে (বিআইটি)।

আবিরদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলায়। ভাটারা থানার কর্তব্যরত কর্মকর্তা জিডির বিষয়ে বলেছেন, আবিরের পরিবার ৬ জুলাই জিডি করে। এতে বলা হয়, গত মার্চ থেকে নিখোঁজ আবির। মার্চের ১ তারিখের পর থেকে তার সঙ্গে পরিবারের যোগাযোগ নেই। নিহত আবিরের বাবা সিরাজুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আবির ছেলেবেলা থেকে চুপচাপ ও শান্ত স্বভাবের ছিল। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েও উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়ার মতো স্বভাব লক্ষ করা যায়নি। গত মার্চ মাসের ১ তারিখ বলে, পড়াশোনা করতে মালয়েশিয়ায় যাবে। আমি বলি, তোমার দুই ভাই থাকে অস্ট্রেলিয়ায়, পড়াশোনা শেষ করে অস্ট্রেলিয়ায় যাও। কিন্তু সে মানতে চায়নি। এ নিয়ে বাকবিতণ্ডা হয়। পরে ওই দিন সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। আর ফিরে আসেনি। ভেবেছিলাম ছেলেটা তো ছোট, রাগ করে হয়তো বা মালয়েশিয়া চলে গেছে, আবার ফিরে আসবে। কিন্তু এমন কাজে জড়িয়েছে বুঝতেই পারিনি। গুলশানে রেস্তোরাঁয় হামলার ঘটনার পর সন্দেহ হয়। তারপর জিডি করি।’ সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আর কোনো বাবার যেন এমন পরিস্থিতিতে পড়তে না হয়। সব বাবা-মায়ের কাছে আহ্বান, সন্তানদের খোঁজ নিন। কোথায় যায়, কী করে খোঁজ নিন। কাউকে যেন আমার মতো বিপর্যস্ত হতে না হয়,’ বললেন নিহত আবিরের বাবা।

কী ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা এই অভিভাবকদের। হতভাগা এ দেশের মানুষগুলোও। যে দেশের মানুষ সহজ-সরল সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত হঠাৎ করে তাদের সন্তানরা এমন কঠোর হিংস্র হয়ে উঠল তারা সেটা ভেবেই কূল পাচ্ছে না। এ ধরনের বীভৎস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এ দেশের ধর্মপ্রাণ সব ধর্মের মানুষকে হতাশ আর বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে। এও কি সম্ভব এই দেশে? সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশে মৌলবাদীর স্থান কখনো ছিল না, কখনো হবেও না। কিন্তু কিসের নেশায় কিসের আশায় এই তরুণ প্রজন্ম বিপথগামী হচ্ছে?

রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে যারা হামলা করে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, সেই একই জঙ্গিগোষ্ঠী জেএমবি হামলা চালিয়েছে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায়। এ ধরনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলার সময়ে আহতাবস্থায় র‌্যাবের হাতে আটক জঙ্গি শফিউল ইসলাম। দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে বিদেশের দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য এসব জঙ্গি হামলাগুলোর পেছনে জামায়াত-শিবির, পাকিস্তান ও তাদের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই জড়িত বলে মনে করছে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে উঠে এসেছে, সমাজের বিত্তবান ও উচ্চশিক্ষিত উঠতি বয়সী বিপথগামী তরুণদের মগজ ধোলাই (ব্রেনওয়াশ) করে আত্মঘাতী পথে ঠেলে দিয়ে এ ধরনের জঙ্গি হামলায় উৎসাহী করে তোলা হচ্ছে। তাদের উত্তেজক কিছু খাইয়ে নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে কি না তার ডিএনএ পরীক্ষা করা হচ্ছে। সারা দেশ থেকে দেড়শো থেকে দুই শতাধিক বিত্তবান ঘরের উচ্চশিক্ষিত তরুণ যারা নিখোঁজ রয়েছে, যাদের ফিরে আসার আহ্বান জানানো হচ্ছে, তারা জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে। জঙ্গিগোষ্ঠীর সন্ত্রাসী হামলাকারীর আশ্রয়দাতা, নির্দেশদাতা, অর্থদাতা, মদদদাতাদের খুঁজে বের করার জন্য তদন্ত ও অনুসন্ধান করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা।

দেশের সাম্প্রতিক এসব ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা দিকভ্রান্ত হলেও এ দেশের তরুণরাই ফিরিয়ে আনবে তাদের মাঝ থেকে হঠাৎ করে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের।

লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ