নারীর অবমাননা

এ কোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়?

Looks like you've blocked notifications!
জাকির তালুকদার

এ কি সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যার প্রাক্তন ছাত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা গর্ববোধ করেন? এ কি সেই প্রতিষ্ঠান, যার চত্বরে প্রগতিশীলতা, আধুনিকতা, সুরুচি, জ্ঞানসাধনা, জীবনসাধনা, জীবন ও সমাজমুখী তর্ক-বিতর্কের সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তা পাওয়ার কথা? এখানেই তো নারীদের সবচেয়ে সাহসী-স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারার কথা। এ কি সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল? এখান থেকেই কি পাকিস্তানবাদের ফাঁকি ধরা পড়তে শুরু করেছিল? এখান থেকেই বায়ান্নর সূত্রপাত? বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন? ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান? পঁচিশে মার্চের প্রতিরোধ? এ কি সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যা ছিল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সূতিকাগার? এক-এগারোর পরে প্রথম গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাহস জুগিয়েছিল কি এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়?

১৪২২ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখের পর বিশ্বাস করা কঠিন যে এটা সেই একই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্বাস করা কঠিন, এই ক্যাম্পাসে শিক্ষকতা করতে করতে সত্যেন্দ্রনাথ বসু পরিপূর্ণতা দিয়েছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইনের কোয়ান্টাম তত্ত্বের। এ তথ্যটি কল্পকাহিনী বলে মনে হবে যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন মোহিতলাল মজুমদার, রমেশচন্দ্র মজুমদার। কেউ কি বিশ্বাস করবে, এখানে জীবনের সিংহভাগ সময় কাটিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আবদুর রাজ্জাকের মতো মহীরুহসম ব্যক্তিত্ব? রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা সাহিত্যে যাঁকে সত্যিকারের বহুমুখী সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব বলা হয়, সেই বুদ্ধদেব বসু ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র—এ কথা কি কেউ এখন বিশ্বাস করতে চাইবে?

এ বছরের পয়লা বৈশাখের পর যদি একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাত সংঘটিত হতো, তাহলে পাকিস্তানি বাহিনী এখানে হামলা চালানোর কোনো প্রয়োজনই মনে করত না। কারণ, এখানে আজ প্রতিবাদী-বিপ্লবী ছাত্রসমাজ নেই, শিক্ষকমণ্ডলী নেই। আছে কেবল পশুদের রাজত্ব। পশুদের অভয়ারণ্য আজ আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পাকিস্তানি নরপশুরা ‘মানুষ’ হত্যার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালিয়েছিল। আজ সেই বিশাল ক্যাম্পাসে মানুষের সংখ্যা নগণ্য। পশুরাই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

না। এই কথা বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আজকের অবস্থার জন্য পুরো দেশের সামাজিক অবক্ষয় দায়ী। এমন কথা বলে অন্তত কোনো বিশ্ববিদ্যালয় পাশ কাটিয়ে যেতে পারে না। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের তো হওয়ার কথা অবক্ষয়ের বিপক্ষে প্রথম প্রতিরোধ। নিজেদের দোষ এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নেই। এরা কোনো অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন না বলেই এই রকম ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটার সুযোগ পায়। কারো অপরাধের বিরুদ্ধেই তাঁরা ব্যবস্থা নেন না—না ছাত্রের, না শিক্ষকের, না কর্মচারীর।

নেন না যে তার পেছনে আছে ক্ষমতার লোভ, পদের লোভ। শিক্ষকের আদর্শ, শিক্ষকতার আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে তাঁরা মুক্তকচ্ছ হয়ে ছোটেন পদের পেছনে, টাকার পেছনে, বৃত্তির পেছনে, লিয়েনের পেছনে, বিদেশ-ভ্রমণের সুযোগের পেছনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পদ দখল করার জন্য কোনো প্রশাসনিক দক্ষতা, যোগ্যতা, নৈতিক মনোবল, সততার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন কেবল দালালিতে দক্ষতা, পদলেহনের যোগ্যতা। বড় ছাত্রসংগঠনের কোনো দুষ্কৃতকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা, সাহস, নৈতিক মনোবল তাঁদের নেই। উপরন্তু তাঁরা নিজেরাই নানা তদবির নিয়ে দ্বারস্থ হন ছাত্রনেতাদের; নিজের নিজের পদ অক্ষুণ্ণ রাখার সহায়তা চাওয়ার জন্য। তাঁরাই একে অপরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন ছাত্রনামধারী ক্যাডারদের, কর্মচারী-নামধারী ক্যাডারদের। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে এ রকম ঘটনা যত ঘটতে থাকে, ধর্মব্যবসায় এবং মৌলবাদীদের সুর ততই চড়া হওয়ার সুযোগ পায়। তারা অভিভাবকদের, বিশেষত ছাত্রীদের অভিভাবকদের বলতে পারে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়া মেয়েদের জন্য নিরাপদ নয়। তারা বিভিন্ন সভা-সমিতিতে জোর গলায় বলতে পারে যে মুক্তবুদ্ধির ক্যাম্পাস গড়ে তোলার ফল এসব ঘটনা। বলতে পারে যে আধুনিক শিক্ষা মানুষকে পশু বানায়। উদাহরণ—এসব ঘটনা।

আর লাভবান হয় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। অভিভাবকদের তারা তখন খুব ভালোভাবেই বোঝাতে সক্ষম হয় যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিদ্যাপীঠগুলো হচ্ছে মাস্তানের আস্তানা, খুনির আস্তানা, হাইজ্যাকারদের আস্তানা, নেশাখোর আর মাদক বিক্রেতাদের আস্তানা, নারী নির্যাতনকারীদের আস্তানা। সেখানে সন্তানদের পড়তে পাঠানো মানে হয় তাদের জীবনকে বিপন্ন করা অথবা তাদের অমানুষে পরিণত করা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নানা ধরনের অঘটন ঘটে চলে সারা বছর। শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের ঘটনা, সহপাঠী কর্তৃক অন্য ছাত্রছাত্রীকে নিপীড়নের ঘটনা, ক্যান্টিনে ক্যাডারদের ফাও খাওয়া, মিছিলে না গেলে হল থেকে ছাত্রদের বের করে দেওয়ার মতো ঘটনা মাঝেমধ্যেই মিডিয়া গোচরে আনে মানুষের। সেগুলো কি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অজানা? মোটেই অজানা নয়। কিন্তু তারা এসবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না। কোনো শাস্তিই প্রায় দেওয়া হয় না দোষী শিক্ষক বা ছাত্রকে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় সংস্কৃতিতে পরিণত এখন। যেখানে সব রকম দোষ করে পার পেয়ে যাওয়া যায়, সেখানে ১৪২২-এর পয়লা বৈশাখ এ রকম বিভীষিকা যে বয়ে আনবে শতেক নারীর জন্য, এটা প্রায় অনিবার্যই।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ মোতায়েন থাকে—সাদা পোশাকে এবং পুলিশের পোশাকে। কিন্তু তারা কখনো কোনো অপরাধীকে ধরেছে কিংবা কোনো অপরাধীকে নিরস্ত করতে উদ্যোগী হয়েছে কিংবা কোনো অপরাধ-সংঘটনকে বানচাল করতে পেরেছে—এমন উদাহরণ একটাও নেই। তাদের চোখের সামনে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অভিজিৎ রায় খুন হয়ে যান, নির্বিঘ্নে হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করে পালিয়ে যায় হত্যাকারী—পুলিশ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের তাহলে কাজ কী? মূলত যে কাজটি তারা করে, তা হচ্ছে হকারদের কাছ থেকে তোলা আদায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন বা পুলিশের কাছে পয়লা বৈশাখের এই অপঘটনার বিচার যে পাওয়া যাবে না, তা প্রায় নির্দ্বিধায় বলে দেওয়া যায়। কিন্তু বিচার আমাদের চাইতে হবেই। বিচার চাইতে হবে এবং ন্যায়বিচার আদায় করে নিতে হবে। আমরা একমাত্র যার কাছ থেকে এই বিচার পাওয়ার আশা করতে পারি, তিনি হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমরা তাঁকে মনে করিয়ে দিতে চাই যে, এ রকম ঘটনা কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী হিসেবে তাঁর গর্বকেই নস্যাৎ করে দেয় না, বরং একজন নারী হিসেবে তাঁরও অবমাননা ঘটায়। দ্বিবিধ কারণেই বিচারের নিশ্চয়তার ব্যবস্থা তাঁকে করতেই হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পশুমুক্ত করে সত্যিকারের জ্ঞানসন্ধানী মানুষের পদচারণার ক্ষেত্র হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।

পাদটীকা : পয়লা বৈশাখে পশুশক্তির নারকীয় তাণ্ডবের মোকাবিলায় এগিয়ে গিয়েছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা। তাঁদের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন নরপশুদের হাতে। তার পরেও তাঁরা বেশ কয়েকজন দুষ্কৃতকারীকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করেছিলেন। পুলিশ তাদের যথারীতি ছেড়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের পক্ষ থেকে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের অভিবাদন।

লেখক: কথাসাহিত্যিক