ক্রিকেট

বাংলাদেশ, ল্যান্ড অব ফিজ!

Looks like you've blocked notifications!

ফিজ। শব্দটা এখন বাংলাদশের মানুষের কাছে পরিচিত। খুব পরিচিত। এবং সেটা ক্রিকেটের সৌজন্যে। সাতক্ষীরার অজপাড়াগাঁয়ের এক তরুণ মুস্তাফিজ, যাকে ক্রিকেটের কারণে গোটা বিশ্ব চিনল ‘ফিজ’ নামে। তাঁর বাঁ হাতের স্লোয়ার-কাটারের অবিশ্বাস্য রহস্য গবেষণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্রিকেটের সফটওয়্যার বিশ্লেষকদের কাছে। মুস্তাফিজ এখন যেখানেই খেলছেন, সেখানেই হয়ে উঠছেন ‘বাংলাদেশের মুখ’। সেটা জাতীয় দল থেকে আইপিএল। কিংবা ন্যাটওয়েস্ট টি-টোয়েন্টি ব্ল্যাস্ট। তাঁর পারফরম্যান্সে অন্যদের চোখের সামনে প্রকাশিত হচ্ছে গোটা বাঙালি জাতির ক্রিকেট-সত্তার দক্ষতা।

মুস্তাফিজ স্বল্পভাষী, কিন্তু তাঁর বোলিংটা বুদ্ধিদীপ্ত। ছোট ছোট শিল্পের ফুলকি। সেই ফুলকিটা দেখল ইংলিশ দর্শক সাসেক্সের হয়ে তাঁর অভিষেক ম্যাচে। এসেক্সের বিপক্ষে ৪ ওভারে ২৩ রানে ৪ উইকেট! এটা নিছক কিছু অঙ্ক ছাড়া অন্য কিছু নয়। এই সংখ্যা দিয়ে মুস্তাফিজকে এখন আর মাপা বা বোঝার তেমন কিছু নেই। মুস্তাফিজের পারফরম্যান্স নিয়ে খেলার পাতায় লাখ লাখ শব্দ খরচ হচ্ছে। আগামীতেও হবে। এবং সেটা বাংলা-ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষায়।

তাহলে মুস্তাফিজকে নিয়ে আবার লেখা কেন? কারণ একটাই। ফিজ। এই শব্দটা এখন আমাদের মতো আমজনতা কিংবা ওর পরের প্রজন্মের লাখ লাখ শিশু-কিশোর-তরুণের কাছে শুধু একটা নামের অপভ্রংশ নয়। ফিজ মোটেও শুধু মুস্তাফিজ নামটাকে সংক্ষিপ্তরূপে আধুনিকতার মোড়কে মোড়ানো কোনো শব্দ নয়। ফিজ ইজ এ হিউজ সিম্বল অব হোপ। হ্যাঁ, সেটা গোটা জাতির জন্য। সাসেক্সে খেলতে যাওয়ার জন্য যে ব্রিটিশ ভিসা পেতে মুস্তাফিজকে খানিকটা বিড়ম্বনায় পড়তে হলো, সেখানে পা রেখেই বিস্ফোরণ ঘটালেন মুস্তাফিজ। চেমসফোর্ডে মুস্তাফিজ কী করেছেন, সেটা সবার জানা। ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটারের সৌজন্যে দেখেও ফেলেছেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। এই লেখা শুরু করার আগে যুক্তরাজ্যে পা রেখে পরিচিত এক ছোট ভাই মোবাইলে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে যা বলল, তাতে অভিভূত হতে হলো! ‘দাদা, ভয়ে ছিলাম। হিথরো বিমানবন্দরে ঝামেলা করে কি না। উৎকণ্ঠা আরো বেড়ে গিয়েছিল মিউনিখে তখন অলিম্পিয়া শপিংমলে বন্দুকধারীদের গুলির খবর সব চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ চলছে। লাইভ চলছে। সে অবস্থায় ইমিগ্রেশন অফিসারের হাতে সবুজ পাসপোর্ট এগিয়ে দিলাম। পাতা উল্টে-পাল্টে তিনি বললেন, ‘ইউ কাম ফ্রম ল্যান্ড অব ফিজ।’

ল্যান্ড অব ফিজ! সত্যিই মুস্তাফিজ এখন ক্রিকেটবিশ্ব বাংলার মুখ। দিন কয়েক আগে গুটি কয়েক উগ্র-সন্ত্রাসী-জঙ্গি তরুণ যখন গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠেছিল, তাতে অন্য রকম এক কলঙ্কের সিল-ছাপ্পড় পড়ল বাংলাদেশের মুখে! সেটা ঘষেমেজে ওঠানোর কাজটা শুরু করলেন মুস্তাফিজ। এবং বলা যায় ইংলিশদের জমিনে পা রেখেই।

চোখের সামনে বাংলাদেশে তারুণ্যের দুটো রূপ দেখল বিশ্ব। তবে যেটা প্রবলতর, তার ধারক মুস্তাফিজরা। যাঁরা মনে করেন, আধুনিকতা মানে উগ্রতা নয়। আধুনিকতা মানে উন্নয়ন। রাষ্ট্রের গায়ে অন্ধের মতো সিল-ছাপ্পড় না মারা। কোনো নিব্রাস-রোহান-ইমতিয়াজরা বাংলাদেশকে যেভাবে উচ্চশিক্ষার নামে বর্বর, মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতার দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, মুস্তাফিজের মতো সহজ-সরল তরুণ তাঁকে ১৮০ ডিগ্রি বিপরীতমুখী করে দিতে পারেন। আরো একবার সেটা টের পেল এ দেশের মানুষ।

মানছি বাংলাদেশ বিচিত্র এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এদিকে, রক্তপিপাসু, উগ্র, জঙ্গিবাদে বিশ্বাসী কিছু বিপথগামী তারুণ্য। এবং তাঁদের নেপথ্যের শক্তি। অন্যদিকে, মুস্তাফিজদের মতো লাখ লাখ তরুণ। যারা অন্যদের স্বপ্ন দেখান, বিশ্বের সামনে দেশকে তুলে ধরেন, যে দেশটা উন্নয়নের পথে চলছে। ধর্ম সেখানে উন্নয়নের পথ থেকে কোনো জমি কেড়ে নিতে পারে না। সে কারণে সাতক্ষীরা থেকে মুস্তাফিজ-সৌম্য সরকাররা উঠে এসে একই বাংলাদেশের জার্সি গায়ে জড়িয়ে ক্রিকেটবিশ্ব দাপিয়ে বেড়াতে পারেন। একই সঙ্গে, একই সুরে গাইতে পারেন, ‘আমার সোনার বাংলা আামি তোমায় ভালোবাসি।’

রাজনৈতিক বয়ানে যে যা-ই বলুক না কেন, এই বাংলাদেশে আধুনিকতা মানে ‘উন্নয়ন’। সেই উন্নয়ন শহরে শহরে উড়াল সেতু, চার লেনের হাইওয়ের চেয়ে বেশি দৃশ্যমান মুস্তাফিজ-সাকিব-তামিম-সিদ্দিকুর কিংবা কলসিন্দুর মেয়েদের আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে সাফল্য। ঘরে-বাইরে অনেক বাধা পেরিয়ে তাঁরা এগিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন। গোটা একটা দেশকে ওরা এক সুতায় বাঁধতে পারেন। যখন সেই বাংলাদেশটা শুধু আর তার ভৌগোলিক সীমানায় আটকে থাকেন না। ‘বাংলাদেশ’ ‘বাংলাদেশ’ শব্দটা তখন দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বাইরের উচ্চারিত হয়। কোনো জঙ্গি-সন্ত্রাসীর চাপাতি-ছুরির ডগায় কিংবা গ্রেনেডে সাময়িকভাবে রক্তাক্ত হতে পারে। কিন্তু পড়ে পড়ে গোঙাবে না। কারণ, মুস্তাফিজরা আছেন। ওদের হাতে যে বাংলাদেশের পতাকা, ওদের বুকে যে বাংলাদেশের নাম লেখা, সেই বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসে কিংবা সংজ্ঞায় সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ বলে কিছু নেই।

পুনশ্চ : ফিজ ইজ এ সিম্বল অব ইিউজ হোপ। আমরা হতাশ হব কেন?

 

লেখক : স্পোর্টস এডিটর, দীপ্ত টিভি।