শ্রদ্ধা

স্যার গ্যারি অগ্রগামী ক্রিকেটের মুখ

Looks like you've blocked notifications!

মঙ্গল গ্রহে ক্রিকেট শুরু হলো। মঙ্গলের মাটিতে যে ক্রিকেট তা যদি এই গ্রহের চেয়ে এগিয়ে না থাকে, তাহলে মানুষ দেখবে কেন? অগ্রগামী ক্রিকেট দেখার একটা বিজ্ঞাপণ তৈরির চিন্তাও করে ফেললেন আয়োজকরা। কিন্তু সেই বিজ্ঞাপণের মুখ হবেন কে বা কারা!

অ্যাডভ্যান্স ক্রিকেট বলুন। এগিয়ে থাকা ক্রিকেট বলুন। কিংবা আগামী দিনের ক্রিকেট বলুন। অফুরন্ত বিনোদন বিলাতেও সেখানে টাকার দরকার হবে। তাই ভারতকে অগ্রাহ্য করবেন কীভাবে! ক্রিকেটের বড় বাজারের একটা মুখ সেখানে না থাকলে চলে কীভাবে? মঙ্গল থেকে যদি ই-মেইল পাঠানো হয় ভারতীয় বোর্ডের কাছে একটা নাম চেয়ে, তার জন্য বিসিসিআই-এর জরুরি সভা ডাকার প্রয়োজন হবে না। কোন নির্বাচক প্যানেল গঠন করার দরকার পড়বে না। সেখান থেকে যে নাম আসবে তা নিয়ে তর্ক-বির্তক হওয়ার সম্ভাবনা শুন্যের কোটায়। কারণ, একশ পঞ্চাশ কোটি ভারতীয়র কাছে যিনি ‘ক্রিকেট ঈশ্বর’, তাঁর নাম বাদ দেবেন কোন ভারতীয়!

  ক্রিকেটের ধাত্রীভূমি ইংল্যান্ড। মঙ্গলে ক্রিকেট আর তার বিজ্ঞাপণ চিত্রে কোন ইংরেজের মুখ থাকবে না তা হয় না কী! তাদের কাছেও একটা মুখ চেয়ে পাঠানো হলো। ভদ্রলোক ক্রিকেটার আর পেশাদার ক্রিকেটারের মাঝের বিভাজন দূরে সরিয়ে রেখে, দাড়িওয়ালা ভদ্রলোকের নামটাই ইংলিশরা পাঠালো। আধুনিক জমানার অনেকের মন খারাপ হবে। তবুও ভদ্রতা দেখিয়ে মেনে নেবেন তারা ডাব্লুজি গ্রেসের নামটা।

অস্ট্রেলিয়ানদের অবশ্য এতো সমস্যা নেই। আগামীতে হবে বলেও মনে হয় না। ওদের কাজটা একজন খুব সহজ করে রেখে গেছেন। মঙ্গল কেন, স্বর্গেও অস্ট্রেলিয়ানদের ক্রিকেটীয় মুখ একটাই। স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান। শুধু অস্ট্রেলিয়া কেন, ক্রিকেট গ্রহ তাঁর চেয়ে ভাল ব্যাটসম্যান দেখেনি।

নিউজিল্যান্ড হয়তো পাল্টা ই-মেইল পাঠিয়ে জানতে চাইবে, ব্যাটসম্যান, বোলার নাকি অলরাউন্ডার হলে আপনাদের ভাল হয়। উত্তর যদি হয়; আপনরা আপনাদের সেরা ক্রিকেটারের নামটাই পাঠান। স্যার রিচার্ড হ্যাডলি নাকি স্বর্গবাসী মার্টিন ক্রো? শেষ পর্যন্ত প্রথম নামটাই পাঠিয়ে দিল কিউইরা।

সাউথ আফ্রিকা পড়ে যাবে বড় সমস্যায়। শুধু যোগ্যতা নয়। গ্রাত্র বর্ন নিয়েও তাঁদের একটু ভাবনা চিন্তা করতে হবে। তা ছাড়া অনেক বড় বড় নাম রয়েছে ওদের ক্রিকেট ইতিহাসে। স্যার ডনের পরই ব্যাটসম্যান হিসেবে যার নাম উচ্চারিত হতে শুরু করেছিল সেই গ্রায়েম পোলক আছেন। তাঁর পরের প্রজন্মের গ্রায়েম স্মিথ, জ্যাক কালিস, শন পোলক। ভারি ভারি অনেক নাম। তবে ক্রিকেট বিজ্ঞাপণের সেরা মুখ হতে পারতেন যিনি, তিনি আবার সাউথ আফ্রিকা ক্রিকেটে তর্কযোগ্যভাবে সর্বকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী ওয়ানডে অধিনায়ক। ক্রিকেটে এখন তিনি অস্পৃশ্য মহানায়ক। ম্যাচ ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে মানুষ ক্রোনিয়েকে আপনি ঘৃণা করতে পারবেন। কিন্তু তাঁর ক্রিকেটকীর্তিকে অগ্রাহ্য করা যাবে না। তা ছাড়া তিনি তো ম্যাচ ফিক্সিং-এর দায় স্বীকার করে নিয়ে নিজের সব জলাঞ্জলি দিয়ে ক্রিকেটকে নতুনভাবে পরিশুদ্ধ করার পথ বাতলে দিয়েছিলেন। তাকে ঠিক তাই উপেক্ষ্ওা করা যায় না। তবে উপেক্ষিত তিনি হয়েছেন। জীবিত থাকার সময়-ই। আর এখন অনেক প্রায়শ্চিত করে, জীবনের সবমুল্য চুকে দিয়ে তিনি ওপারের বাসিন্দা। অতএব তিনি পরিত্যাজ্য। গ্রায়েম পোলকের নামটাই পাঠানো হবে সাউথ আফ্রিকা থেকে।

পাকিস্তানিদের রেষারেষি অনেক। ফিক্সিং-স্পট-ফিক্সিং কেলেংকারিতে অনেক নাম। তারপরও ওদের সুবিধা সব চেয়ে বেশি। কারদার, হানিফ মুহাম্মদ, জাভেদ মিয়াঁদাদ, জহির আব্বাস, ওয়াসিম আকরাম, ইনজামাম। কিন্তু এই নামগুলো ক্রিকেটীয় প্রভাব আর সাফল্যের নিরীক্ষে অনেক অনেক আলোকবর্ষ দূরে পড়ে থাকে, ইমরান খান নামটা চলে এলে। অতএব। পাক বোর্ডের কর্তারা অপছন্দ করলেও শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্ব্ওে ইমরান খানের নামটা পাঠাতে হবে।

লঙ্কান বোর্ডে আবার বেশি রাজনীতি ঘেষা লোকজন। ওদের পছন্দ- অপছন্দ কখন কোন দল ক্ষমতায় তার ওপর অনেক বেশি নির্ভর করে। মঙ্গল থেকে যদি ই-মেলটা এখন আসে নিশ্চিত বলা যায়, মুরালিধরণের নামটা পাঠানো হবে না। ‘বিশ্বাসঘাতক’ ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া হয়েছে তাঁর নামের আগে। কারণ, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হোম সিরিজে তিনি আবার শত্রু শিবিরের পরামর্শক। সুতরাং টেস্ট ক্রিকেটে তিনি যতই প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে আটশ উইকেট পান না কেন, তাঁর সম্ভাবনা নেই। প্রথম বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা ঠিক ছিলেন। কিন্তু তাঁকে অপছন্দ করা লোকের সংখ্যা বোর্ডে বেশি হয়ে যেতে পারেন। তাই সাম্প্রতিক সময়ে ক্রিকেট গ্রহে সবচেয়ে প্রভাবশালী লংকান নাম- কুমার সাঙ্গাকারা। সেই নামটা পাঠিয়ে সবকুল রাখতে চাইবে শ্রীলংকা।

জিম্বাবুয়ের? ওদের ক্রিকেটের যা অবস্থা এখন, কোন নাম না পাঠালেও কোন ক্ষতি নাই। অ্যাডভান্স ক্রিকেটা কেন, ওরা সাম্প্রতিক সময়ের ক্রিকেটের কথাই ঠিকঠাক মত ভাবতে পারছেন না। আর যদি তর্ক ওঠে তাহলে, গ্রায়েম পোলক ওদের হয়ে কিছু কথা বলতে পারবেন। কারণ, জিম্বাবুয়ে এক সময় তো রোডেসিয়া হিসেবে সাউথ আফ্রিকার সংগে জড়িয়ে ছিল। সেটা গ্রায়েম পোলকদের জমনায়।

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে ই-মেইল পাঠাবে কী না তা নিয়ে খানিকটা দ্বিধাগ্রস্থ মঙ্গল ক্রিকেট কর্তৃপক্ষ থাকতেই পারে। দেখা গেলো, একজন মুখ খুঁজতে তিন- স্তরের একটা কমিটি গঠন করা হলো! তা ছাড়া এই মুর্হুতে কাউকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের মুখ হিসেবে বেছে নিতে হলে; মুস্তাফিজকে উড়িয়ে নিলে কেউ আপত্তি করবেন না। বাংলাদেশ? সে তো ল্যান্ড অফ ফিজ। একই সঙ্গে ফেস অফ বাংলাদেশ।

সবচেয়ে বড় সমস্যা ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের নিয়ে। থ্রি ডাব্লুজ। লয়েড। ভিভ। লারা। গর্ডন গ্রিনিজ, হেইন্স, হোল্ডিং, র্গানার, রবার্টস, মার্শাল, ওয়ালশ, অ্যামব্রোস। কত নক্ষত্র। তারপর আবার এরা বেশির ভাই এক একটা আলাদা আলাদা দ্বীপের প্রতিনিধিত্ব করেন। একই সঙ্গে এদের ক্রিকেটীয় দক্ষতার সৌধ অনেক উচ্চু। কিন্তু তাতে কী? ক্যারিবীয় ক্রিকেটের স্বাস্থ্য এখন যতই ভঙ্গুর হোক, আবার তার হৃষ্টপুষ্ট চেহারার বড় বিজ্ঞাপণ যতোই হোক ক্লাইভ লয়েডের অপ্রতিরোধ্য দল, তবে ক্যারিবীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপণী মুখ  স্যার গারফিল্ড সোবার্স। তর্কহীনভাবে ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা অলারাউন্ডার। শেষ পর্যন্ত স্যার গ্যারির নামটাই হাতে পৌঁছালো মঙ্গল গ্রহের ক্রিকেট কর্তাদের।

এবং এই নামটা হাতে পাওয়ার পর সবচেয়ে বিব্রত হলেন তাঁরা। কারণ, অ্যাডভান্স ক্রিকেটের বিজ্ঞাপণ নির্মাতারা গো ধরে বসলেন, এই বিজ্ঞাপণ চিত্রে একটার বেশি মুখ দরকার নেই। তারা একটার বেশি মুখ ব্যবহার করতেও রাজি নন। কর্তারা নির্মাতাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, অন্যদের কাছে যে আমরা নাম চেয়েছিলাম। এখন সেই মুখগুলো ব্যবহার না করলে, আমরা তাঁদের কাছে মুখ দেখাবো কীভাবে! আমরা ছোট হয়ে যাব। কিন্তু স্ট্যান্স বদল করতে নারাজ নির্মাতা। তাঁর কথা; ‘ক্রিকেট গ্রহ হোক আর মঙ্গল গ্রহ হোক, খেলাটা যেখানেই হোক তার বিজ্ঞাপণের জন্য একজন স্যার গ্যারি সোর্বাসের মুখই যথেষ্ট। আর সেটা টেস্ট, ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি, টি-টেন কিংবা সিঙ্গেল উইকেট যে ফরম্যাটেই হোক, একাশিতে পা রাখা এই ভদ্রলোকই দ্য গ্রেটেস্ট।’ তাঁর কথাকে গুরুত্ব দিতেই হবে। কারণ, তিনি হচ্ছেন সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা ক্রিকেটার। টি-টোয়েন্টি যখন ক্রিকেট বিজ্ঞানীদের কল্পনায়ও আসেনি, সেই সময় ভদ্রলোক এক ওভারে ছয় ছক্কা মেরেছেন ফার্স্ট ক্লাসে ক্রিকেটে! ব্যাটিং-বোলিং সবকিছুতেই বৈচিত্র। একাই পেস বল করছেন। স্পিন করছেন। আবার তিনিই চায়নাম্যান।

স্যার ডনের প্রতি শ্রদ্ধার সামান্যতম শ্রদ্ধা কম না দেখিয়েও বলা যায়, মঙ্গল গ্রহে যদি ক্রিকেট শুরু  হয়,তাহলে সবার আগে ডাক পড়বে স্যার গারফিল্ড সোবার্সের। মঙ্গলগ্রহে ক্রিকেটের ব্র্যান্ড অ্যাম্বেসেডর যদি তিনি হন, ক্রিকেটীয় মঙ্গলের ব্র্যান্ড অ্যাম্বেসেডরের নামও হবে স্যার গারফিল্ড সোবার্স। আজ স্যার গারফিল্ড সোবার্স একাশিতে পা রাখতে যাচ্ছেন। ব্রিজটাউনে আজ যে মোমবাতি জ্বালানো হবে, সেটা শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের মঙ্গল কামনায় নয়। শুধু জীবনের বাইশ গজে সোবার্সের শুভ কামানায় নয়। সেটা ক্রিকেট গ্রহে মঙ্গল দ্বীপ হয়েই জ্বলবে।

লেখক: স্পোর্টস এডিটর, দীপ্ত টিভি।