এক্সট্রা কাভার

বাংলাদেশের পতাকা তো ক্রিকেটারের রক্তেও ভেজা

Looks like you've blocked notifications!

মিরপুর ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ‘গ্র্যান্ডস্ট্যান্ড’ শব্দটা বেশ বড় করে লেখা আছে। তবে আরো দুটো স্ট্যান্ড আছে, যার গায়ে বড় বড় অক্ষরে নাম দুটো লেখা নেই! তবু স্ট্যান্ড দুটো অন্য রকম এক মর্যাদা ধারণ করে আছে। বুকে নিয়ে আছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদের ইতিহাস। যেখানে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের ক্রিকেটও। শহীদ মুস্তাক ও শহীদ জুয়েল স্ট্যান্ড। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে দুই শহীদ। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ ক্রিকেটের দুই মুখ। আর ক্রিকেট এখন হয়ে উঠছে বাংলাদেশের মুখ। ১৬ বছর আগে নর্দাম্পটনে বাংলাদেশ যখন বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারিয়েছিল, সেদিন গোটা ইংল্যান্ডে আওয়াজ উঠেছিল ‘বাংলাদেশ! বাংলাদেশ!’, তার পর আরো বহুবার বিভিন্ন জায়গায় জিতেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। ‘বাংলাদেশ’ শব্দে বহুবার ক্রিকেটবিশ্ব কেঁপে উঠেছে। কিন্তু ১৯ এপ্রিল মিরপুর স্টেডিয়াম ‘বাংলাদেশ! বাংলাদেশ!’ শব্দটা চোখ ঝাপসা করে দিয়েছে জলে! হ্যাঁ, হয়তো শব্দহীন নীরব কান্না। আবার কেউ কেউ কান পেতে সেটা শোনার চেষ্টাও করেছেন। মিরপুর স্টেডিয়ামে অনেককেই দেখা গেছে আনন্দে কেঁদে উঠেছেন! চোখের জল ফেলেছেন! বিখ্যাত একটি বাংলা গানের লাইনকে তখন সত্যিই ভুল মনে হয়েছে! ‘চোখের জলের হয় না কোনো রং!’ ভুল। এদিন মিরপুর স্টেডিয়ামে ফ্লাডলাইটের আলোর মাঝেও একজনকে চোখের জল মুছতে দেখে মনে হলো, ভদ্রলোকের চোখের জলের রংও যে লাল-সবুজ! হ্যাঁ, মিরপুর স্টেডিয়ামে তখন লাল-সবুজের উৎসব! পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জয়ের উৎসব। আর সেই উৎসবের রং শুধুই লাল-সবুজ। যে লাল-সবুজ পতাকার জন্য রক্ত দিয়েছিলেন শহীদ জুয়েল, শহীদ মুস্তাক। তাঁদের স্মৃতির পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ জয়ের সাক্ষী হলেন জুয়েলের সঙ্গে যিনি ক্রিকেট খেলেছেন আর মুস্তাককে যিনি নিজের ক্রিকেট গুরুতুল্য মনে করেন, সেই রকিবুল হাসান। ‘একজনের সঙ্গে বহু ম্যাচ খেলেছি। আর একজনকে তো আমি মনে করি, আমার ক্রিকেটের গডফাদার। সেই দুজনের আত্মা আজ নিশ্চয়ই শান্তি পাবে। দেরিতে হলেও পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশ সিরিজ জিতেছে। ওদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি, আমাদের ক্রিকেটাররা সেটা প্রমাণ করল পাকিস্তানকে হারিয়ে,’ বলছিলেন বাংলাদেশ দলের সাবেক অধিনায়ক।

রকিবুল হাসানেরও কি ক্রিকেটের জন্য ত্যাগ কম ছিল? ‘জয় বাংলা’ স্টিকার ব্যাটে লাগিয়ে পাকিস্তান দলের হয়ে আন্তর্জাতিক একাদশের বিপক্ষে খেলতে নেমেছিলেন ’৭১-এর সেই অগ্নিঝরা দিনে। তার পর ফেরারি। টেস্ট খেলার স্বপ্নকে বিসর্জন দিতে হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে ছুটে গেলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। বাংলাদেশ দলের ব্লেজার পরলেন। বাংলাদেশের হয়ে ক্রিকেট খেললেন। অধিনায়কত্ব করলেন। কিন্তু রকিবুল হাসানের টেস্ট খেলা হলো না! সেই রকিবুল হাসান পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ জয়ের পর গর্ব করে বললেন, ‘ক্রিকেট খেলে ভুল করিনি আমি। টেস্ট খেলার স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছি। আজ গর্ব হচ্ছে সেই পাকিস্তানকে বাংলাদেশ বলে বলে হারাচ্ছে! আমি নিশ্চিত, যেখানে যে গ্রহেই থাকুক না কেন জুয়েল-মুস্তাক, তাঁরা আরো বেশি গর্বিত হচ্ছেন বাংলাদেশের এই জয়ে।’

এবং পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের টানা দুটো জয় এলো সেই মিরপুরে, যে জায়গাটি ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের পরও বেদখল ছিল! মুক্তিযোদ্ধা, নাট্যব্যক্তিত্ব, খেলাপ্রেমী পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় খেলা দেখতে দেখতে মনে করিয়ে দিলেন, এই মিরপুর স্টেডিয়ামটা একসময় কবরস্থান ছিল। হয়তো কত শহীদের কবরও হয়েছিল এর আশপাশে। ‘এই মিরপুরে পাকিস্তানি ও বিহারিরা কত বাঙালিকে হত্যা করেছে। সেখানেই আজ পাকিস্তানিদের সিরিজ জয়ের স্বপ্নকে কবর দিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা।’

‘ক্রিকেটের সঙ্গে রাজনীতিকে টেনে আনা ঠিক হচ্ছে না’—এমনটা অনেকের মনে হতে পারে। কিন্তু ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই ভূখণ্ডের কোন জিনিসটার সঙ্গে পাকিস্তানিরা রাজনীতি মেশায়নি ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত! রাজনীতির কারণে বাঙালি ক্রিকেটাররা কি বঞ্চনার শিকার হননি পাকিস্তানিদের কাছে? সেসব বঞ্চনার জবাব অন্যান্য সেক্টরের মতো ক্রিকেটেও দিতে শিখেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। হ্যাঁ, দেরিতে হলেও সেটা দিতে শুরু করেছেন তাঁরা। বাঙালি ক্রিকেট খেলতে পারে না—রকিবুল হাসানদের কি এই কথাটা শুনতে হয়নি? সেই পাকিস্তানিরা আজ জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বলছেন না, ‘বাংলাদেশ আমাদের চেয়ে বেটার ক্রিকেট খেলছে।’

ক্রিকেটারের রক্তে ভেজা বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকাটা মিরপুর স্টেডিয়ামে উড়ছে। ওটা দেখতে দেখতে পরম শান্তিতে ঘুমাতে পারেন শহীদ জুয়েল, শহীদ মুস্তাক। কিন্তু বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে মিরপুর স্টেডিয়ামে যাঁরা ঢুকছেন, তাঁরা অনেকেই দেখতে পান না কোনটা শহীদ জুয়েল স্ট্যান্ড, কোনটা শহীদ মুস্তাক স্ট্যান্ড! চোখে পড়ার মতো করে নাম লেখা হয়নি স্ট্যান্ড দুটোর। অথচ ওঁদের রক্তে ভেজা বাংলাদেশের পতাকা আজ উড়ছে সবখানে!

অঘোর মন্ডল : ক্রীড়া সাংবাদিক ও লেখক।