সিটি করপোরেশন নির্বাচন এবং নাগরিক প্রত্যাশা

Looks like you've blocked notifications!

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় স্থানীয় শাসনব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। একদিকে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানিক লালন-পালন, অন্যদিকে জনহিতব্রত দীক্ষার প্রাথমিক পাঠ হিসেবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একে গণতন্ত্রের সূতিকাগার বলে অভিহিত করেন।

বিশেষত, নগর শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা অনেকটা সেবাদান প্রতিষ্ঠানের মতো। এ ধরনের নগর শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা ‘ডেলিবেরিটিভ ডেমোক্রেসি’, অর্থাৎ গণসেবার গণতন্ত্র বলে অভিহিত করে থাকেন। নগর শাসনব্যবস্থায় আইন প্রণয়ন, প্রশাসন, বিচারের যতটা না গুরুত্ব তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো নাগরিক জীবনের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ। একদিন যদি পানি অথবা গ্যাস অথবা বিদ্যুৎ না থাকে, তাহলে নাগরিক জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠতে বাধ্য। ইংরেজিতে যাকে ‘ইউটিলিটি সার্ভিস’ বলে, সেটাই পৌরসভার কাজ। পৌরসভা যখন খুব বড় হয়ে দাঁড়ায় তখন তাকে বলা হয় সিটি করপোরেশন। পৃথিবীর বড় বড় শহর মেগাসিটি করপোরেশন অথবা সিটি গভর্নমেন্ট দ্বারা পরিচালিত।

বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটি হচ্ছে ঢাকা সিটি করপোরেশন। দীর্ঘকাল ধরে অনেক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এটি এখন সিটি করপোরেশন। জনসংখ্যা এবং আয়তনের দোহাই দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার এটি দুই ভাগে ভাগ করে। অনেকেই মনে করেন, এটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। গত ১২ বছর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন না হওয়ায় নাগরিক সাধারণ হতাশায় ভুগছিলেন। এবারে রাজনৈতিক দোলাচলের একপর্যায়ে ঢাকা সিটি করপোরেশন দুটির নির্বাচন হতে যাচ্ছে। আইনগতভাবে রাজনৈতিক দলের সরাসরি অংশগ্রহণে এ নির্বাচন সিদ্ধ নয়। কিন্তু বাংলাদেশ সমাজের অতিমাত্রিক রাজনীতিকীকরণের কারণে সিটি করপোরেশনসহ সব স্থানীয় সরকার নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের প্রভাব অনুভূত হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো একরকম খোলামেলাভাবেই আচরণবিধির ব্যতিক্রম করে নির্বাচনে তাদের প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ—সরকারি এবং বিরোধী—সবাই স্ব-স্ব দলের পক্ষে প্রচারে অংশ নিচ্ছেন। অতিক্রান্ত রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে এ গণতান্ত্রিক চর্চাকে অনেকে স্বাগত জানিয়েছেন। যদিও আচরণবিধি নিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে বিপুল অভিযোগ জমা হয়ে আছে নির্বাচন কমিশনে। তবুও আচরণবিধির কারণে আগেকার জাঁকজমকপূর্ণ অর্থ-বাহুল্যের নির্বাচন প্রদর্শনী হচ্ছে না। এ টুকুই সান্ত্বনা।

গোটা বিশ্বে স্থানীয় সরকারগুলো রাজনৈতিক নেতৃত্বের সূচনা করে। হুট করেই কেউ নেতা হয়ে যায় না। প্রাথমিক অবস্থায় স্থানীয় জনগণের সমস্যা, সমাধানের উপায়, জনসম্পৃক্ততা এবং ছোট্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে রাজনীতিক নেতাদের আবির্ভাব ঘটে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক প্রেসিডেন্টই তাদের ক্যারিয়ারের সূচনা করেছিলেন মেট্রো গভর্নর হিসেবে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান এবং ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আহমদ নেজাদের উত্থানও ঘটে সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে। স্থানীয় পর্যায় থেকে মানুষের ভালোবাসা এবং নেতৃত্বের কৌশল ব্যক্তিকে সফলতার দিকে নিয়ে যায়। আমাদের দেশেও এ রকম উদাহরণ বিরল নয়। নিকট অতীতে আমাদের দুই বড় নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উত্থানও ঘটে কলকাতা করপোরেশনের মেয়র হিসেবে। প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ মশিউর রহমান জাদু মিয়া ইউনিয়ন কাউন্সিলের একজন সদস্য হিসেবে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। সে যা-ই হোক, এসব কথা আমরা লিখলাম রাজনীতিতে স্থানীয় সরকারের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য।

ঢাকা যেমন মহানগরী, তেমনি তার মহাজনবসতি বাংলাদেশের এক-দশমাংশ লোক ঢাকায় বসবাস করে। জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ এই শহর আয়তনে নিষ্পিষ্ট এই লোকালয়। হাজারো সমস্যা আকীর্ণ এই জনপদ। এই মহানগরীর জন্য যে অবকাঠামো যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং সেবাসমূহ নিশ্চিতকরণের যে প্রক্রিয়া, তা এখানে অনুপস্থিত। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে এই ঢাকা। অপরিচ্ছন্ন এর জনপথ তাই বিশ্বের অবাসযোগ্য নগরীর খাতায় দ্বিতীয় স্থানে এর নাম।

সাম্প্রতিককালে ঢাকা মহানগরীর খুব বড় ধরনের সমস্যার একটি যানজট বা জ্যাম। এটি নগরজীবনকে স্থবির করে তুলেছে। সরকার সাধ্যমতো চেষ্টা করছে বটে, তাতে সমন্বয়ের অভাব পরিলক্ষিত। মেয়র পদপ্রার্থী আনিসুল হক বললেন, ‘মহানগরীর ২৮টি কাজের জন্য সরকারের ৫৬টি সংস্থায় ধরনা ধরতে হয়। সে কারণে অন্যান্য মহানগরীর মতো ঢাকাকে কেন্দ্র করে মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্ট বা নগর সরকারের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে। প্রস্তাবিত নগর সরকারের একটি পার্লামেন্টও থাকবে। প্রস্তাবনা অনুযায়ী দুটি উপায়ে এটি গঠন করা যেতে পারে। প্রথম প্রস্তাবটি বর্তমান ব্যবস্থার অনুরূপ। দ্বিতীয় প্রস্তাব অনুযায়ী কাউন্সিলরদের ভোটে মেয়র নির্বাচিত হবেন। ঢাকার ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব, দ্রুত নগরায়ণ এবং দ্রুত কার্যকারিতার জন্য নগর বিশেষজ্ঞরা এই সেদিন এক গোলটেবিল বৈঠকে নগর সরকার গঠনের সুপারিশ করেছেন।

একটি মজার বিষয় লক্ষণীয় যে, সকল প্রার্থী ‘ইয়া বড়া বড়া’ আকাশচুম্বী নির্বাচনী ইশতেহার দিচ্ছেন, যা বাস্তবায়ন অসম্ভব। অন্তত তাঁদের কাজের পরিসরে। সবচেয়ে যে বিষয়টি গুরুত্ব পাওয়ার কথা, অর্থাৎ নগরীর সুশাসন, তা কীভাবে হবে, জনগণ কীভাবে ঘুষ-দুর্নীতি, দীর্ঘসূত্রতা, হয়রানি থেকে রেহাই পাবে তেমন কোনো জোরালো প্রস্তাবনা মেনিফেস্টোতে দেখা যায়নি। নগরীর জলাবদ্ধতা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, বিদ্যুৎ বিতরণ, গ্যাস ও পানি সরবরাহ নিরাপদ এবং নিশ্চিত করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি, প্রকৌশলসম্মত এবং পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

সমাগত এই নির্বাচন দেরিতে হলেও ইতোমধ্যে জনারণ্যে বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছে। মানুষের এই উৎসাহ-উদ্দীপনাকে গণতন্ত্রায়নের মাধ্যমে এগিয়ে নিতে পারলে তা একটি সুন্দর-সমৃদ্ধ মহানগরী উপহার দিতে পারবে। এই সিটি করপোরেশন নির্বাচন প্রকারান্তরে রাজনৈতিক দলের মধ্যে জমে থাকা সন্দেহ, অবিশ্বাস, অসহযোগিতার বৈরী মনোভব দূরীকরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের আশাবাদ। বিশ্বায়নের এই যুগে আমরা পিছিয়ে থাকতে পারি না, তাই আমাদের বিশ্বনগর ব্যবস্থা এবং স্থানীয় জনগনের আশা-আকাঙ্ক্ষার সমন্বয় ঘটাতে হবে। আমাদের স্লোগান হোক ‘থিংক গ্লোবালি অ্যাক্ট লোকালি’।