এক্সট্রা কাভার

মানজারের ছবি ও খুলনার ক্রিকেট দীনতা

Looks like you've blocked notifications!

সাম্প্রতিক সময়ে ক্রিকেট মাঠকে অনেক বেশি লাশ টানতে হচ্ছে! ফিল হিউজের পর কলকাতার এক তরুণ ক্রিকেটার অঙ্কিত কেশরি মাঠে আঘাত পেয়ে হাসপাতালে গিয়ে লাশ। হিউজের শোক লম্বা সময় ধরে বয়ে বেড়াচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার অনেক ক্রিকেটার। বিশ্বকাপ জেতার পরও মাইকেল ক্লার্ক বলেছিলেন, ‘বিশ্বকাপ খেললাম আমরা ১৬ জনে। ১৫ জন সশরীরে। একজনের উপস্থিতি ছিল অশরীরী! ওকে মনে রেখেই খেলেছি।’ ও মানে ফিল হিউজ। সেটা নতুন করে বলার দরকার পড়ে না। তবে নতুন করে একটা কথাই বলতে হচ্ছে, মাইকেল ক্লার্ক, মিচেল স্টার্ক, ডেভিড ওয়ার্নারদের কাছে ফিল হিউজ এখনো অনেক বড় অনুপ্রেরণা। প্রয়াত টিমমেটকে তাঁদের পক্ষে ভুলে থাকা কঠিন।

পাশের বাড়ি কলকাতায় ভারতীয় অনূর্ধ্ব-১৯ দলের সাবেক ক্রিকেটার অঙ্কিত কেশরির মৃত্যুও ছুঁয়ে গেছে ওয়ার্ন থেকে স্টার্ক, গৌতম গম্ভীর থেকে বিরাট কোহলিকে। হিউজ, কেশরির মৃত্যুরও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয়তো এসেছে তাঁদের লাশ হাসপাতালের বেডে রেখে। কিন্তু আসলে মৃত্যুতে আলিঙ্গন করেছেন তাঁরা ক্রিকেট মাঠেই। তবে খুলনা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের প্রেসবক্সের পাশে ছোট একটা স্ট্যান্ডের সঙ্গে যাঁর একটা পোর্ট্রেট ঝোলানো রয়েছে এবং স্ট্যান্ডের নামকরণ যাঁর নামে, তিনিও ক্রিকেট থেকে বিদায় নিয়েছেন বড্ড অকালে। খুব অল্প বয়সে। মৃত্যু তাঁর সড়ক দুর্ঘটনায়।

হ্যাঁ, ক্রিকেট খেলে মোটরসাইকেলে করে ফিরে আসার সময় সড়ক দুর্ঘটনায় ২০০৭ সালে মারা যান জাতীয় দলের ক্রিকেটার মানজারুল রানা। বাঁহাতি এই ক্রিকেটারের শোক আর স্মৃতি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে খুলনার শেখ আবু নাসের স্টেডিয়াম। খুলনার ছেলে ছিলেন রানা। স্টেডিয়াম থেকে খুব বেশি দূরে নয় তাঁর বাড়ি। খুলনায় যখন ক্রিকেটের আয়োজন, তখনই তাঁর বাড়িতে শোকের মাত্রাটা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। রানাকে হারানো ছিল তাঁর পরিবারের কাছে স্বজন হারানোর শোক আর দুঃখ। কিন্তু রানার মৃত্যুতে খুলনার ক্রিকেটও অনেকটা নিঃস্ব হয়ে গেছে, সেটা ভালোভাবেই টের পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশ দলে যে খুলনার কোনো ক্রিকেটার নেই এখন!

মানজার রানার ছবির দিকে তাকাতে তাকাতে পাকিস্তান দলের জিম্বাবুইয়ান ব্যাটিং কোচ গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ার খানিকটা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লেন। ‘মানজার কি এখানকার ক্রিকেটার ছিল? ভেরি স্যাড, ও রকম বয়সে একজন ক্রিকেটার পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল! জিম্বাবুয়ে তো ওকে দেখেছিলাম। আর এখানে দেখছি ওর ছবি!’ মানজারের ছবি অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক এবং ভারতের সাবেক কোচ গ্রেগ চ্যাপেলের একটা কথাকেই মনে করিয়ে দিল, ‘জীবনে সব বিপর্যয় সামাল দেওয়া যায় শুধু মৃত্যু ছাড়া।’ কিন্তু খুলনা কি তার ক্রিকেটীয় বিপর্যয় সামাল দিতে পারছে?

মনে হয় না। শহর খুলনার দিকে তাকালে মনে হচ্ছে, চারদিকে ক্রিকেটীয় উৎসবের আমেজ। কত রং-বেরঙের তোরণ! অবশ্য সেই তোরণগুলো যেন মনে হয় ক্রিকেটীয় সংস্কৃতির সঙ্গে একটু বেমানান! সেই তোরণে ক্রিকেটের চেয়ে ক্রিকেটকর্তাদের তোষণের নীতিকেই একটু বেশি অনুসরণ করা হয়েছে। তবে সেটা তো আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক সংস্কৃতির বৃহত্তর ক্যানভাসের একটা ক্ষুদ্র ক্রিকেটীয় আঁচড় ছাড়া অন্য কিছু নয়। কিন্তু খুলনার বুকে বড় দাগ কেটেছে শোক নয়, বিহ্বলতা নয়, এক ধরনের ক্রিকেটীয় বিপন্নতা! তা না হলে গত কয়েক বছরে এই শহর, এই জেলা থেকে কোনো ক্রিকেটার উঠে এলো না কেন জাতীয় দলে? অমিত মজুমদার নামের বাঁহাতি এক তরুণ সম্ভাবনার আশা জাগিয়ে থেমে গেলেন অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে খেলেই। এখন তো প্রায় হারিয়ে গেছেন! তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল অবশ্য বলছে, রানার মৃত্যু ওকে এমনভাবে নাড়া দিয়েছিল যে খুব মুষড়ে পড়েছিল। তার পর থেকে আর স্বাভাবিক খেলাটাই খেলতে পারেনি।

হয়তো বা তাই। হয়তো বা অন্য কিছু। তবে আরো একটা অকালমৃত্যু খুলনার ক্রিকেটকে ধাক্কা দিয়ে গেছে। যেটা খুব বেশি সামলে উঠতে পেরেছে খুলনা, তা মনে হয় না। জাতীয় দলের সাবেক আরেক ক্রিকেটার শেখ সালাউদ্দিন, ক্রিকেটারের চেয়ে পরবর্তী সময়ে যিনি বেশি পরিচিত পেয়েছিলেন কোচ হিসেবে; তরুণ ক্রিকেটার গড়ার কারিগর হিসেবে। তিনিও একদিন ঘুমের মাঝে শেষ নিঃশ্বাস ছাড়লেন! খুলনার তরুণ ক্রিকেটাররা যেন খানিকটা অভিভাবকহীন হয়ে পড়ল। যে কারণে খুলনা জেলার ক্রিকেটীয় দীনতা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। এমন অভিমত খুলনার ক্রিকেট মহলে অনেকের।

শহর খুলনা, জেলা খুলনা যখন ক্রিকেটার তুলতে পারছে না, ঠিক সময় খুলনার পাশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ক্রিকেটার উঠে আসছে! বড় শহর খুলনার পাশে নড়াইল, মাগুরা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা নিতান্তই ছোট ছোট শহর। অথচ সেসব শহর থেকে উঠে আসছে বড় বড় ক্রিকেটার! সাতক্ষীরার সৌম্য সরকার, মুস্তাফিজরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রেখেই জানান দিচ্ছেন, তাঁরা আগামী দিনের তারকা। বাগেরহাটের রুবেল বিশ্বকাপে পেয়ে গেছেন বড় তারকার তকমা। যে কারণে বিজ্ঞাপনের বাজারে হুমকি দিয়ে বলতে পারেন, ‘ডাইরেক্ট ভাইঙ্গে দেব!’ নড়াইলের মাশরাফি কিংবা মাগুরার সাকিবের কথা নতুন করে বলার কোনো মানে হয় না।

তবে একটা কথা বলতেই হচ্ছে, শিল্পনগরী খুলনা অনেক আগেই হারিয়েছে তার শিল্পকারখানার ঐতিহ্য। ক্রিকেটশিল্পেও যে খুলনা প্রায় নিঃস্ব! খুলনা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে মানজার রানার ছবি শুধু তাঁর স্মৃতিকে মনে করিয়ে দিচ্ছে না, খুলনার ক্রিকেট দীনতাকেও মনে করিয়ে দিচ্ছে!
লেখক : ক্রীড়া সাংবাদিক