সোজাকথা

রিশা, খুনি, শিক্ষক ও কিছু প্রশ্ন

Looks like you've blocked notifications!

স্কুলছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিশার হত্যাকারী ওবায়দুলকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় স্বস্তি পেয়েছি। হত্যার সাত দিনের মাথায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই সমাজে একটি মেয়ে ইভ টিজিংয়ের শিকার হলে কিংবা কেউ তাকে আঘাত করলে দোষ হয় মেয়েটিরই। সমাজ তাকে চরিত্রহীন আখ্যা দেয় কোনো আগপিছু চিন্তা না করেই। এই উদাহরণ আমরা দেখেছি সীমা যখন বখাটেদের অত্যাচারে আত্মহত্যা করল, তখন। এতদূরেই বা যাই কেন, তনুকে তো চরিত্রহীন বাজে মেয়ে প্রমাণের কত চেষ্টা চলছে। আর যারা তাকে ধর্ষণ করে নৃশংসভাবে হত্যা করল, রাষ্ট্রযন্ত্র সেই বীরপুরুষদের আড়াল করে রাখল! হায়রে মেয়ে! আমরা নাকি সভ্যভব্য!

উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের সুরাইয়া আক্তার রিশার ঘটনাটি অনেক বেশি ভয়ংকর মনে হয়েছে আমার কাছে, কেননা একটি ছোট্ট মেয়ে পাখির মতো উড়ে বেড়াবে, মা-বাবার কাছে বায়না ধরবে পোশাকের জন্য কিংবা বেড়াতে যাওয়ার জন্য। ওর পাখির মতো উড়ে বেড়ানো দেখে রাস্তার যেকোনো নরাধমের মনে কোনো বাজে চিন্তা উঁকি দেয়, তার দায় এভাবে মেটাতে হবে পাখির মতো মিষ্টি মেয়েটাকে? রিশা মায়ের সঙ্গে দর্জির দোকানে গিয়েছিল। সেখানে মানুষবেশী জানোয়ারটা মেয়েটির মায়ের ফোন নম্বর নিয়ে তাকে উত্ত্যক্ত করা শুরু করে। এমনকি তাকে অনুসরণ করে স্কুল পর্যন্ত চলে যায়। ওবায়দুল নামের সেই নরাধমের মতো পশু আমাদের চারপাশে বাড়ছে। আমাদের মেয়েগুলো কি আর হৈচৈ করে স্কুল থেকে দলে দলে বের হবে না? বন্ধুরা মিলে গলা খুলে হাসতেও পারবে না? ওদের কি এখন আমরা সারাক্ষণ চার দেয়ালে বন্দি করে রাখব! এমনিতেই সারা দেশে যে হারে ইভ টিজিং এবং নৃশংসতা বেড়েছে, তাতে মেয়েরা এখন খুব কমই সুযোগ পায় স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ানোর। মেয়েকে স্কুলে দিয়ে এসেও শান্তিতে থাকতে পারেন না মা-বাবা। কিছুদিন আগে মোহাম্মদপুরে স্কুল প্রাঙ্গণের ভেতরেই ছোট্ট মেয়ের নির্যাতিত হওয়ার খবর আমরা পেয়েছি। কোথায় নিরাপদে থাকবে আমাদের সন্তানরা! ঘরে-বাইরে চারপাশে চেনা-অচেনা মানুষগুলোর মধ্যেই বিকৃত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না করলে আরো খারাপ সময়ের মুখোমুখি হতে হবে আমাদের।

রিশার হত্যাকারী ধরা পড়েছে। আশা করি, বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় আরো দশটা ঘটনার নিচে চাপা পড়ে যাবে না এই নরপিশাচের শাস্তি কার্যক্রম। কিন্তু রিশার মৃত্যু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, আমরা কতটা ইতরবিশেষ হয়ে উঠেছি দিনকে দিন। রিশা পরীক্ষা শেষে স্কুলের গেটলাগোয়া ওভারব্রিজ দিয়ে পার হওয়ার সময় নরপিশাচটার হাতে ছুরিকাহত হয়। মেয়েটি দৌড়ে স্কুলের কম্পাউন্ডে যায়। এ সময় কোনো শিক্ষক তার পাশে এসে দাঁড়াল না? এমনকি রিশার অভিভাবক এবং উপস্থিত শিক্ষার্থীদের কাছে আমরা জানতে পেরেছি, স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপালের কাছে খবরটি গেলে তিনি পুলিশ কেস বলে একবারও ঘর থেকে বের হয়ে এসে মেয়েটির পাশে দাঁড়াননি। এমনকি স্কুল কম্পাউন্ডে অনেক গাড়ি থাকলেও মহামতি শিক্ষক (!) অনুমতি দেননি মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। স্কুলের ছোট বাচ্চাগুলোই তাদের আহত বন্ধুকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে রিকশায় করে। এত দীর্ঘ সময় রক্তক্ষরণ না হলেও হয়তো বাঁচানো যেত রিশাকে। এভাবে অসময়ে চলে যেতে হতো না মেয়েটিকে। আহারে, ফুলের মতো বাচ্চা মেয়েটি কোনো অপরাধ না করেও সমাজের কী ভয়ংকর নির্মমতা দেখে চলে গেল এই পৃথিবী ছেড়ে!

মা-বাবা যাঁদের কাছে অনেক ভরসা নিয়ে ছেলেমেয়ে তুলে দেন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য, সেই শিক্ষকরাই মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে বসে আছেন। অভিভাবক যখন তাঁদের প্রিয় সন্তানকে অনেক ভরসা নিয়ে শিক্ষকের হাত তুলে দেন, তাঁদের নিশ্চয়ই এটাও দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় শিক্ষার্থীদের ভালো-মন্দ দেখাশোনার। তাঁদের এমন নির্লিপ্ত আচরণ কী শিক্ষা দেবে শিক্ষার্থীদের? দিনে দিনে শিক্ষকদের কীর্তিকলাপ আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাদের কাছে পাঠাচ্ছি আমাদের সন্তানদের?

রিশা যেদিন ঢাকায় স্কুল প্রাঙ্গণে তার শিক্ষকদের নির্মমতার মুখোমুখি হচ্ছে, সেই একই দিনে চাঁদপুরে রিশার সমবয়সী সাথী আক্তার শিক্ষকদের আচরণের কারণে আত্মহত্যা করে।

সাথী চাঁদপুর সদর উপজেলার বাগাদী ইউনিয়নের শেখবাড়ী গ্রামে বাগাদী গনি উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। মাসিক বেতন ও নিম্নমাধ্যমিক সমাপনীর (জেএসসি) মডেল টেস্ট পরীক্ষার ফি-বাবদ প্রতি শিক্ষার্থীকে ২৮০ টাকা করে দিতে বলা হয়। গত রোববার সাথী স্কুলে গিয়ে শিক্ষিকা ফাতেমা বেগমের কাছে ২৬০ টাকা দেয়। যারা ২০ টাকা কম দেয়, তাদের সবাইকে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে রোদের মধ্যে কান ধরিয়ে ওঠবস করিয়ে শাস্তি দেন সহকারী শিক্ষিকা ফাতেমা বেগম ও সহকারী শিক্ষক শংকর। সাথী সোমবার পরীক্ষা দেওয়ার জন্য স্কুলে গেলে শিক্ষকরা তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন। পরে সাথী তাঁর বাড়িতে গিয়ে মায়ের কাছে কান্নাকাটি করে। টাকা জোগাড় করতে সাথীর মা চায়না বেগম অন্য বাড়িতে যান। এ সময় ঘরের আড়ার সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে সাথী। সাথীর আত্মহত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে এলাকার লোকজন উত্তেজিত হয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের বিচারের দাবিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভাংচুর চালায়। বিষয়টি চাঁদপুর মডেল থানা পুলিশকে অবহিত করা হয়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

এলাকার কয়েকজন সংবাদমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেন, এর আগেও এই বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিষ্ঠুর আচরণের কারণে আরো কয়েক শিক্ষার্থী ফাঁস দিয়ে ও বিষপানে আত্মহত্যা করে। সপ্তাহ দুয়েক আগে পরীক্ষার ফির টাকার জন্য নানুপুর গ্রামের এক ছাত্রী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। এ ছাড়া গত বছর একই বিষয় নিয়ে শিক্ষকরা অপমান করায় অভিমান করে দুই ছাত্রী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। চাঁদপুরের এ ঘটনা অহরহ দেশের আনাচে-কানাচে অসংখ্য শিক্ষার্থীর সঙ্গে ঘটছে। প্রতিদিনই আমরা খবরের কাগজে শিক্ষকদের এমন লজ্জাজনক আচরণের খবর পাই। কোনোদিক দিয়েই পিছিয়ে নেই শিক্ষকরা। পরিমলের মতো শিক্ষকরাও আছেন, যাদের কাছে পৈশাচিকতার সম্মুখীন হচ্ছে আমাদের সন্তানরা। কোন সমাজে আমরা বাস করছি? কারা আমাদের আইডল? এই শিক্ষকরা কী শেখাবেন আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের? মানুষ গড়ার কারিগর বলব এদের আমরা?

রিশার হত্যাকারীকে ধরা হয়েছে। আমরা আশা করব, খুব সময়ের মধ্যেই খুনি ওবায়দুল দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাবে। মঙ্গলবার কাকরাইলে রাস্তা অবরোধ করে রিশার বন্ধুদের আন্দোলনে গিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী। তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন, রিশা হত্যার বিচার হবে। তবে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আমার একটা আবেদন, রিশার স্কুল কর্তৃপক্ষ যেন পার না পেয়ে যায়। তাদেরও তাদের কৃতকর্মের জবাবদিহি করতে হবে এবং নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে তাদের সেই দিনের অবস্থান কী ছিল, সেটা পরিষ্কার করা হোক শিক্ষার্থীদের কাছে। তা না হলে রিশার বন্ধুরা বড় হবে তাদের শিক্ষকদের প্রতি চরম ঘৃণা নিয়ে। শিক্ষামন্ত্রী, দয়া করে আপনি অন্ধ হবেন না। আপনার শিক্ষকদের আগে মানুষ করুন। তাঁরা আগে মনুষ্যত্বের পরীক্ষায় পাস করে আসুন। এমন শিক্ষকদের কাছে শিক্ষিত হওয়ার চেয়ে আমাদের সন্তান অশিক্ষিতই থাকুক। আর ওবায়দুলের মতো পাপীষ্ঠদের নোংরা মানসিকতার মানুষদের এই সমাজ থেকে দূর করতে হবে আমাদেরই। আমাদের সন্তানদের আরো সচেতন করে গড়ে তুলতে হবে। রিশার বন্ধুরা যেভাবে এ কয়দিন রাস্তায় নেমেছিল, তাতে আবারও আশা জাগে, ওরাই পারবে সমাজের এই অন্ধকার দূর করতে।

লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ।