বিশ্লেষণ
কেমন হলো সিটি মেয়র নির্বাচন
বহুল প্রত্যাশিত সিটি করপোরেশন নির্বাচন সরকারি ভাষ্য মোতাবেক ‘সুষ্ঠু’ এবং বিরোধীদের দাবি অনুযায়ী ‘ব্যাপক কারচুপি’র মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিতর্কিত ফলাফলে দেখা যায় তিনটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র এবং কাউন্সিলর পদে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা নিরঙ্কুশ জয় লাভ করেছেন। বিএনপিসহ সব দলের প্রার্থীরা নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছেন। রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি নির্বাচনের দিন দুপুরেই সব নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা- নির্বাচনের পরাজয় এড়াতে এবং আন্দোলনের অজুহাত খুঁজতে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে বলে মন্তব্য করেন। প্রধানমন্ত্রী সিটি নির্বাচন সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, জনগণ বিএনপিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তারপরও বিএনপি যে ভোট পেয়েছে তাতে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন। নির্বাচন পরবর্তী আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির নির্বাচনী প্লাটফর্ম ‘আর্দশ ঢাকা আন্দোলন’তিন সিটিতে ‘নজিরবিহীন ভোট ডাকাতি’র আনুপূর্বিক বর্ণনা দেয় ।
দীর্ঘ ১২ বছর পর এবার ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। ২০০২ সালে সর্বশেষ নির্বাচনে বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা মেয়র নির্বাচিত হন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার জাতীয় নির্বাচন করলেও মেয়র নির্বাচন করেনি। ফলে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হওয়া অবধি খোকা মেয়র পদে বহাল থাকেন। আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচন না দিয়ে প্রশাসক নিয়োগ করে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বিগত নির্বাচনে বিএনপি জয় লাভ করায় সরকার বিপাকে ছিল। চট্টগ্রাম মেয়রের মেয়াদ আরো তিন মাস বাকি থাকলেও ঢাকার নির্বাচনের সাথে চট্টগ্রামকেও জুড়ে দেওয়া হয়। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর ভাষ্য মোতাবেক ‘অধিকতর সেবা নিশ্চিত করার জন্য’এবং বিরোধীদের ভাষায় ‘নিশ্চিত পরাজয়ের সম্ভাবনাকে হ্রাস করার জন্য’ঢাকা মহানগরী ভাগ করা হয়। তিন মাসের অবরোধ আন্দোলন অবশেষে বিএনপি যখন অনেকটা বির্পযস্ত তখন আন্দোলন মোকাবিলার কথিত কৌশল হিসেবে সিটি করপোরেশন নির্বাচন ঘোষণা করা হয়। এই তিনটি নির্বাচনকে ‘মন্দের ভালো’ হিসেবে জনগণ গ্রহণ করলেও কোনো কোনো রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের মতে গণতন্ত্রের জানালা খুলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও অবশেষে গণমাধ্যমের মন্তব্য অনুযায়ী ‘জিতেছে আওয়ামী লীগ আর হেরেছে গণতন্ত্র’।
অন্যদিকে গণমাধ্যমের এই মন্তব্যের বিপরীতে শাসক দল আওয়ামী লীগের অবস্থান বেশ শক্ত। নবনির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলাররা গনভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে গেলে তিনি সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে দাবি করে জালিয়াতির অভিযোগকারীদের ভোটের হারের দিকে দৃষ্টি দিতে বলেন। তিন সিটি করপোরেশনে ৪৪ ভাগ ভোট পড়ার চিত্র তুলে ধরে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, কারচুপি হলে এত কম ভোট হবে কেন? এ সময় কিছু কিছু অনিয়ম ছাড়া সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে দাবি করে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনকে যারা প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়, তাদের অসৎ উদ্দেশ্য আছে।মঙ্গলবার তিন সিটিতে ব্যাপক ভোট জালিয়াতির অভিযোগ তুলে বিএনপি সমর্থিত প্রর্থীদের ভোট বর্জনের পর তা তদন্তে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। এছাড়া বিএনপির ভোট বর্জনকে দুঃখজনক মন্তব্য করে নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত করে দেখা হবে বলেও জানান তিনি।
বিএনপির ভোট বর্জনের ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক সাংবাদিক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব আলম হানিফ বলেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন বর্জনের কারণ হিসেবে তারা যে অভিযোগ করছে, এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। ভোট বর্জন ও কারচুপির অভিযোগ বিএনপির পক্ষে নতুন কিছু নয়। এটা তাদের পূর্বপরিকল্পিত। কারণ তারা জানত বিগত দিনে যেভাবে মানুষ হত্যা করেছে তাতে জনগণের সর্মথন পাবে না। অপর এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ নেতা, নির্বাচন সমন্বয়ক ড. আবদুর রাজ্জাক অভিযোগ করেন, ‘বিএনপি কিছু কিছু কেন্দ্র কর্মী সংকটের কারণে এজেন্ট দিতে পারেনি। সে দোষ তো আমাদের না। তাই বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে।’
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) নির্বাচনোত্তর এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি ছিল ব্যাপক। ভোটাররা উৎসাহ আর উদ্দীপনার মধ্যে ভোট দিয়েছেন। কমিশনের তড়িৎ হস্তক্ষেপে বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি।কাজী রকিব আরো বলেন,‘আমি ও আমার সহকর্মীরা বেশ কিছু কেন্দ্র পরিদর্শন করেছি। ভোটারদের সঙ্গে কথা বলেছি। কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। কোথাও কোনো অনিয়ম চোখে পড়েনি।‘ তিনি নিশ্চিত করেন যে সেনাবাহিনী ডাকার মতো ঘটনা কোথাও ঘটেনি। একই ধারাবাহিকতায় ঢাকা উত্তরের আওয়ামী লীগ প্রার্থী আনিসুল হক মন্তব্য করেন মেজর কোনো ফাউল হয়নি।
বিরোধী দলের বক্তব্য ঠিক এর উল্টোটি। নির্বাচনের দিন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের এক শীর্ষ নেতা মওদুদ আহমেদ সরকারি দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের পোলিং এজেন্টদের বের করে দিয়ে কেন্দ্র দখলে নেওয়ার অভিযোগ উত্থাপন করে নির্বাচন বর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। তিনি দাবি করেন, নির্বাচনে ৫ শতাংশ ভোটও পড়েনি। তিনি বলেন, বিএনপি সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আগেই সংশয় প্রকাশ করেছিল। আর্দশ ঢাকা আন্দোলনের প্রধান অধ্যাপক এমাজউদ্দীন বলেন, এত নিকৃষ্ট, ঘৃন্য ও জঘন্য নির্বাচন তিনি জীবনে দেখেননি। সংবাদ সম্মেলনে আফরোজা আব্বাসও তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন।
উভয়পক্ষের বক্তব্য পাল্টা বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে গণমাধ্যমের দিকে তাকানো যাক। পত্রপত্রিকায় প্রকশিত প্রতিবেদনে জানানো হয় রাজধানীতে কেন্দ্র দখলের খবর। অনেক কেন্দ্রেই না কি প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি বিএনপি প্রার্থীদের পোলিং এজেন্টদের। যেসব কেন্দ্রে বিএনপির পোলিং এজেন্টরা প্রবেশের চেষ্টা করেছে তাদের মারধর করে বের করে দেওয়া হয়েছে। কাউকে তুলে দেওয়া হয়েছে পুলিশের হাতে। পোলিং এজেন্টদের বের করে দেওয়ার পর সাধারণ ভোটাররাও যাতে ভোটকেন্দ্রে আসতে না পারে, সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ভোটকেন্দ্রে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয় সাংবাদিক এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের। টেলিভিশন চ্যানেলের ক্যামেরাগুলো ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁদের লাঞ্ছিত করা হয়, ক্যামেরা ভেঙে ফেলা হয়। অসংখ্য সংবাদ চিত্রে দেখা যায় এই উৎসবের ছবি!
সমালোচনায় বিদেশিরাও শামিল হয়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে জাতিসংঘ মহাসচিব পুনর্নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট মন্তব্য করেন,‘যে কোনোভাবে জিতলেই তা জয় হয় না।’ ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে ভোট জালিয়াতি, ভয়ভীতি প্রর্দশন এবং সহিংসতার যেসব ঘটনা ঘটেছে বলে প্রতক্ষ্যদর্শীদের কাছ থেকে ব্যাপক ও বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন পাওয়া গেছে।’ মার্কিন দূতাবাস বিএনপির নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তে হতাশা প্রকাশ করে। ঢাকাস্থ ব্রিটিশ হাইকমিশনার ও অনূরূপ অভিমত ব্যক্ত করেন। ভোটের দিন সুইডেনের রাষ্ট্রদূত কবি নজরুল কলেজ কেন্দ্রে দুই আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর সংঘর্ষে আটকা পড়েন। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, দেশে তো বটেই বিদেশেও এই প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন আমাদের সম্মান ও মর্যাদার হানি ঘটিয়েছে।
নির্বাচনে হারজিত স্বাভাবিক। যা অস্বাভাবিক তাহলো নির্বাচন ব্যবস্থা নামক রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিকতার স্থায়ী ক্ষতিসাধন। সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন যর্থাথই বলেছেন,‘ক্ষতি হলো নির্বাচন কমিশনের, ক্ষতি হলো রাজনীতির, সর্বোপরি ক্ষতি হলো রাষ্ট্রের।’ তৃতীয় বিশ্বের গণতান্ত্রিক মাত্রায় ওয়ানডে ডেমোক্রেসি বা একদিনের গণতন্ত্রও বুঝি বাংলাদেশের মানুষের জন্য তিরোহিত।
ড. আবদুল লতিফ মাসুম : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়