প্রতিক্রিয়া

জিতেছে আসলে কে?

Looks like you've blocked notifications!
অধ্যাপক ড. মো. শরিফ উদ্দিন

রাজনীতিতে আপাত-স্থিতিশীলতার নিয়ামক হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল সিটি নির্বাচন। দীর্ঘ অচলাবস্থার পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছিল নির্বাচনকে ঘিরে। সিটি নির্বাচন নিয়ে রাজনীতির মাঠে ঘটে গেছে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নানা খেলা। দুই পক্ষের মধ্যে ‘সমঝোতা’ হয়েছে বলেও ধারণা ছিল রাজনীতি-বিশ্লেষকদের। কিন্তু ভোটের মাঠের নৈরাজ্য সব জল্পনা-কল্পনাকে উড়িয়ে দিয়েছে। একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়তো অস্বাভাবিক পরিস্থিতিকেই দূরে ঠেলে দিত। তা আর হলো কই? দেশের সাধারণ মানুষের উৎকণ্ঠা, আবারো কি অস্থিতিশীলতায় পড়তে যাচ্ছে ১৬ কোটি মানুষ?

গত মঙ্গলবার দেশের ইতিহাসে বিস্ময়কর এক নির্বাচন হয়ে গেল। দীর্ঘদিন পর ভোট। মানুষের উচ্ছ্বাস ছিল। ছিল উৎসবের একটি আবহও। কিন্তু ভোটগ্রহণের দিন সকাল থেকেই কেন্দ্রগুলোতে যে বিশৃঙ্খলার পরিবেশ তৈরি করা হলো, তা ছিল চরম বাড়াবাড়ি। এ ছিল ‘একতরফা’ একটি পরিবেশ। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ঢাকার দুই সিটি আর চট্টগ্রাম—তিন সিটিতে একই পদ্ধতিতে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়। তবে এর ভীত কিন্তু রচিত হয়েছিল বেশ আগেই। নির্বাচনী প্রসঙ্গ শুরু হওয়ার পরই। কেবল বিএনপি-জামায়াত নয়, বিরোধী পক্ষকেই প্রার্থী হিসেবে সহ্য করতে পারেনি সরকারি দলের নেতাকর্মীরা। গ্রেফতার, মামলা-হামলা দিয়ে এসব প্রার্থীকে ব্যস্ত রাখা হয়েছে শেষ পর্যন্ত।

ব্যক্তি উদ্যোগে ভোটে দাঁড়ানো প্রার্থীরাও প্রচার চালাতে পারেননি। ভোটকেন্দ্রে প্রতিপক্ষ প্রার্থী, নেতাকর্মী, ভোটারদের উপস্থিতি প্রতিরোধে সর্বাত্মক বেপরোয়া কর্মকাণ্ড দেখা গেছে। কাজেই এ নির্বাচন সংকট আরো বাড়িয়ে দেবে—সন্দেহ নেই।

এই সিটি নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধার মোড়কে শেষ পেরেকটিও মারা হলো। বর্তমান নির্বাচন কমিশন বেশ আগে থেকেই বিতর্কিত। স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন ও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে আবারো জটিল সন্দেহ আর অবিশ্বাস তৈরি হলো। প্রচলিত এ ব্যবস্থার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হলো দেশের কোটি তরুণ সমাজ। জাতির জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির সোপান তৈরি করল নির্বাচন কমিশনের এমন আচরণ।

অবস্থাদৃষ্টে বিরাজমান পরিস্থিতিতে এটাই স্পষ্ট প্রতীয়মান, তিন সিটিতে তড়িঘড়ি করে নির্বাচন আয়োজনে সরকারের ত্বরিত কর্মকাণ্ডে নাগরিক স্বার্থ প্রাধান্য পায়নি। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার বরং ক্ষমতার পাটাতন শক্ত করার প্রয়াস চালিয়েছে।

এই নির্বাচনে গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর হামলার দৃশ্যও ছিল বিস্ময়কর। কেন্দ্রে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়েছে। সাংবাদিকদের ক্যামেরা ছিনতাই করা হয়েছে। মারধর করা হয়েছে। ক্যামেরা থেকে ছবি ডিলিট করে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের পর কূটনীতিকদের তৎপরতাও বেশ চোখে পড়ার মতো। নির্বাচন-সংক্রান্ত বিএনপির অভিযোগ নিয়ে সুষ্ঠু তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। উদ্বেগ জানিয়েছেন মার্কিন ও ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতও।

সব মিলিয়ে গণতন্ত্রের জন্য খারাপ আরেকটি অধ্যায় সূচিত হলো। দেশের স্থিতিশীলতা বহুদূর—এ নির্বাচনের মাধ্যমে সেটাই আবারো প্রমাণিত হলো। বিতর্কিত এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জিতেছে আওয়ামী লীগ, হারেনি বিএনপি; হেরেছে গণতন্ত্র, হারল বাংলাদেশ।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়