নেপালে আমরা যে পাপ করলাম : শোভা দে

Looks like you've blocked notifications!

শোভা দে ভারতের প্রতিষ্ঠিত একজন লেখক ও কলামিস্ট। জনসংস্কৃতি বিষয়ে তাঁর মতামত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়। নেপালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে ভারতীয় গণমাধ্যমের ‘ভূমিকা’র আদ্যোপান্ত তিনি বিচার করেছেন তীক্ষ্ণভাবে। শোভা দের এই লেখা প্রকাশিত হয়েছে গতকাল সোমবার ৪ মে এনডিটিভির অনলাইন সংস্করণে।

‘দেশি মিডিয়া—হায় হায়! মুর্দাবাদ...মুর্দাবাদ...’

ওহে ভারতীয় গণমাধ্যম—এটা জরুরি আওয়াজ! নেপাল কি বলছে মন লাগিয়ে শুনুন...আর দয়া করে আপনাদের আক্রমণাত্মক ভঙ্গিটা বদলান।

‘শকুনের দল, তোমাদের নিশ্চয়ই মড়ার হাড় জোগাড় করা শেষ হয়েছে। এবারে বাড়ি ফিরে যাও।’ নেপালে এ সময় ভারতীয়দের কার্যক্রম নিয়ে যেসব টুইট হয়েছে, তার মধ্যে এটি ভদ্রতম। সামান্য সময়ে এটি সামাজিক মাধ্যমে ঝড় তুলেছে। ‘#গোহোমইন্ডিয়া’ হ্যাশট্যাগটি যৌক্তিক কারণেই প্রচারণা পেয়েছে। এর মুখোমুখি হতে হবে এবং স্বীকার করতে হবে যে আমরা পুরো বিষয়টি খুব বিশ্রী করে ফেলেছি। অবশ্যই প্রতিটি সাংবাদিকই এখানে দায়ী নন, তবে অধিকাংশকেই এর দায় নিতে হবে! কেন এমন করলাম আমরা? যখনই আমাদের প্রতিবেশী কেউ আমাদের দোষ দেয়, আমরা তেড়েফুঁড়ে তাদের আক্রমণ করে বসি, অস্বীকার করে বসি। আমরা এটা প্রতিবার করি, বারবারই করি। এটা কি আমাদের ঔদ্ধত্য? আমরা কি এতটাই খলচরিত্রের? আমাদের কি একটুও যায়-আসে না কিছুতেই? নাকি কোনো ট্র্যাজেডির খবর করতে গেলে আমরা আদতেই ক্রূঢ়, অসহনশীল আর দুর্বোধ্য আচরণ করি—এমনকি আমাদের নিজেদের ক্ষেত্রেও?

নেপালের মানুষজন বিষয়টাকে অন্যভাবে দেখছে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে আমাদের অতীতকে দো-আঁশলা বলতে পারেন। এখানে দ্বিধাবিভক্তভাবে জড়িয়ে আছে ভালোবাসা-ঘৃণার মিশেলে জটিল এক সম্পর্ক। দশকের পর দশক ধরে এমন হাল। ঘাড়ে হাত রাখা বড়ভাইসুলভ আমাদের আচরণ সব সময়ই প্রশ্নবিদ্ধ। এপ্রিলের ভূমিকম্প ট্র্যাজেডির পর দুই দেশের এই ভঙ্গুর বন্ধুত্বের মাত্রার চূড়ান্ত দিকটা পরখ হয়ে গেছে। দুর্ভাগ্যবশত, প্রেসওয়ালারা হয়ে গেছে বলির পাঁঠা—নেপালিদের ঘুষি মারার জন্য দশাসই এক বালির বস্তা। এ রকম দুর্যোগের সময় ঠিক যেমন ‘পরিমিত’ আচরণ করা দরকার, তা আমাদের দিয়ে হয়নি। এমনটা অবশ্য আমরা নিজেদের ক্ষেত্রেও করি। তবে সে তো আমাদের ‘অন্দর কি বাত’! সে নিয়ে আমাদের পরে মাথা ঘামালেও চলবে। নেপালের মানুষজন এখন ডুবন্ত... এবং তারা এখন উন্মত্ত স্বাভাবিকভাবেই। অবর্ণনীয় এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ হজম করতে হয়েছে তাদের। মৃতদেহের সংখ্যা হয়তো ১০ হাজার ছাড়াবে, এখনো চলছে উদ্ধারকাজ।

আরো মাসখানেক ধরে এ কাজ চলবে। দেশটাকে আবারো গড়ে তোলা সরকারের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ। শত বছরের এক ঐতিহ্যকে আবার কীভাবে গড়ে তোলা হবে? শেষকৃত্য চলতেই থাকবে, আগুন জ্বলতেই থাকবে; অজস্র পরিবারের যারা টিকে আছে, তারা স্বজনদের কান্নাভেজা চোখে চিরবিদায় জানাবে। এ সময় নেপালের মানুষজনের একটা বিষয় খুবই জরুরি এবং প্রাপ্য সম্মান, মর্যাদা আর একান্ত নির্জনে তাদের শোকার্ত সময়টুকু কাটানো। এটা কি খুব বেশি কিছু চাওয়া?

সুতরাং, মিডিয়াওয়ালাদের এখন ‘প্যাক-আপ’ করার সময়। আমাদের চর্ব্য-চোষ্যপুষ্ট টেলিভিশন রিপোর্টারদের এখন ছোঁকছোঁক করতে থাকা ক্যামেরার লেন্স গুটিয়ে বাড়ি ফেরা দরকার জরুরি ভিত্তিতে। স্থানীয় লোকজনের রাগের সীমা পেরোনোর আগেই সেটা করা দরকার।

‘ভূমিকম্পটা কেমন লেগেছিল...এখন আপনার মনের অবস্থা কেমন?’ এক মা তার শিশুসন্তানের মৃতদেহ আঁকড়ে ধরে বিলাপ করে কাঁদছিলেন, তাকে করা হয়েছে এ রকম অসহ্য, গায়ে জ্বালা ধরানো প্রশ্ন! এমন ভয়ংকর আর অপদার্থের মতো আচরণ কী প্রমাণ করছে? আপনারাই বলুন!

যাহোক...বেশ কিছু ব্যাপার আছে এখানে। তবে এ রকম পরিস্থিতিতে এমন ভয়াবহ ‘অপরাধ’ হওয়ার কারণ, পেশাদারি প্রশিক্ষণের অভাব। বিষয়টা হলো কী, ভারতে যে কেউই টেলিভিশন চ্যানেলের রিপোর্টার হতে পারে, যে কেউ! আপনার দরকার হলো ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর মতো আত্মবিশ্বাস (পড়ুন অতি আত্মবিশ্বাস) এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে আমতা আমতা না করা। ‘গ্রাউন্ড জিরোতে পৌঁছানো প্রথম চ্যানেল’ হওয়ার প্রতিযোগিতা আর সবকিছুকেই বাতিল করে দিয়েছে। পেশাদারিত্ব ধুলোয় মিলিয়ে গেছে। নবিশমার্কা আচরণ তার চরম বাজে রূপ দেখিয়ে ফেলেছে।

আরেকটা টুইট, ‘আপনাদের গণমাধ্যম-কম্প বন্ধ করুন।’ অথচ আমাদের এই কুৎসিত কাভারেজের মাধ্যমে মানুষের যে ক্ষোভ বা আক্রোশ তৈরি হয়েছে, তা কি আমরা ‘কাভার’ করতে পেরেছি? না, পারিনি। কীভাবে পারব বলুন? আমরা তো যুদ্ধে ব্যস্ত, কঠিন যুদ্ধে। এই যুদ্ধের নাম ‘টিআরপির যুদ্ধ’!

এখন বলুন দেখি, ভারতীয় স্বেচ্ছাসেবকদের ভালো কাজগুলো চুলোয় দিয়ে ভারতকে এখন নেপালের নাম্বার ওয়ান গণশত্রু বানানোয় কৃতিত্ব কার? এটা বাহবা পাওয়া, সাফল্য নিজের ভাগে নেওয়া বা লাইমলাইটে আসার কথা বলে নয়...এমন একটা মানবিক বিপর্যয়ে সবারই এগিয়ে আসা উচিত। এ দুঃখ-কষ্ট-দুর্দশায় তাদের পাশে দাঁড়ানোটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। সুহৃদ প্রতিবেশীর ক্ষেত্রে এমন আচরণই কাম্য এবং এ আচরণ হবে এক সেকেন্ডও না ভেবে। এই উদ্যোগের জন্য কোনো প্রচার ফলানোর মানে হয় না। আর আমরা কী করলাম? নিজেদের বাহবা করে আর নিজেদের পিঠ চাপড়ে নিজেরাই কূল পেলাম না! আমরা সবকিছু নষ্ট করে দিলাম। আর নেপালও আমাদের দোষী সাব্যস্ত করল!

ভারতীয় গণমাধ্যম কি ক্ষমা চাইবে? কেন চাইবে না? যাদের সাহায্য করতে গিয়ে আমরা আঘাত করেছি, তাদের জন্য তো এটুকু আমরা করতেই পারি! নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য পুরো পৃথিবীর কাছ থেকে নেপালের সহায়তা প্রয়োজন। ভারতের অফিশিয়াল রেসপন্স ছিল চমৎকার। কিন্তু ভারতীয় মিডিয়াই নেপালের মানুষকে খুঁচিয়েছে।

সামাজিক মাধ্যমের এই প্রতিক্রিয়া থেকে আমরা কয়েকটা বিষয় শিখতে পারি। আমাদের এই অপরিপক্ব টেলিভিশন রিপোর্টারদের জন্য দরকার মানবিক বিপর্যয় ‘কভার’ করার জন্য একটি ‘দ্রুত প্রশিক্ষণ কর্মশালা’। কিছু নিয়মকানুন থাকবে, যা অবশ্যই মেনে চলতে হবে। কারো দুঃখকে পুঁজি করে ব্যবসা ফলানোর অধিকার কারো থাকবে না। ক্যামেরা অবশ্যই শেষকৃত্য আর শোকাবহ পরিস্থিতি থেকে একশ হাত দূরে থাকবে এবং শোক প্রকাশ করবে, জানাবে যথোপযুক্ত সম্মান। এই চাওয়াটুকু কি খুব বেশি?

প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় নিজস্ব নীতিমালা কী হবে, তা নিয়ে একটা সময়োপযোগী আলাপ-আলোচনা করা ভারতীয় গণমাধ্যমের জন্য জরুরি হয়ে উঠেছে। ন্যূনতম ভদ্রতাবোধ দেখাতে ব্যর্থ হলে এসব টিআরপি যুদ্ধে জয়টা ওজনে অনেক বেশি হালকা আর মূল্যহীন হয়ে ওঠে।