বাংলাদেশ, আল-কায়েদা ও যুক্তরাষ্ট্র

Looks like you've blocked notifications!

কিছু দিন আগে (২ মে, শনিবার) হুট করেই জিহাদিস্ট ফোরাম নামের একটি মনিটরিং ওয়েবসাইটে ভিডিও প্রকাশের মাধ্যমে বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায় হত্যার দায় স্বীকার করে আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখার প্রধান আসিম উমর। অভিজিৎ ছাড়াও ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু, রাজীব হায়দার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এ কে এম শফিউল ইসলাম হত্যার দায়ও স্বীকার করেছে সংগঠনটি। আর এই তথ্য নিশ্চিত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের অনলাইনভিত্তিক জঙ্গিবিরোধী আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান দ্য সার্চ ফর ইন্টারন্যাশনাল টেররিস্ট এনটিটিস (এসআইটিই)।

এর পরই তোলপাড় শুরু। ব্যাপক বিচার-বিশ্লেষণ চলছে, সঙ্গে বের হয়ে আসছে বহু তথ্য। বিভিন্ন সূত্র থেকে দাবি করা হচ্ছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সঙ্গে আল-কায়েদার যোগসূত্র আছে। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দাবি করেছে তাদের কাছে এমন কোনো তথ্য নেই। আরেকটু পেছনে তাকালে দেখা যাবে ২১ এপ্রিল আশুলিয়ায় ভয়াবহ ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ডাকাতদের গুলি ও ছুরিকাঘাতে ব্যাংক ম্যানেজার, ব্যবসায়ী ও পথচারীসহ ঘটনাস্থলে সাতজন ও পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজন মারা যান। গণপিটুনিতে মারা যায় এক ডাকাত। এখন আবার তথ্য এসেছে- এই ডাকাত দলের সদস্যরা হলো আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য।

তার মানে দুই-দুইয়ে চার মেলানো খুব সহজ হয়ে গেল বোধ হয়। শুধু হিসেব মিলছে না অন্য জায়গা। সেটা হলো আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কেন ঘটনাগুলোর মূলে পৌঁছাতে পারছেন না? তাদের কাছে নিশ্চয় তথ্য রয়েছে। এমনকি ওয়াশিকুরের হত্যাকারীদের হাতেনাতে পেয়েও তেমন কোনো অগ্রগতির চিত্র আমরা দেখতে পাইনি।

যাইহোক, ২ মে যখন আল-কায়েদার ভারতীয় শাখার পক্ষ থেকে এসব হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করা হয় তার ঠিক দুই দিন আগে অর্থাৎ ৩০ এপ্রিল ওয়াশিংটনের ক্যাপিটাল হিলের রেবার্ন ভবনে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল সম্পর্কিত সাব-কমিটির একটি শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে একমাত্র বাংলাদেশি প্রবন্ধ উপস্থাপক ছিলেন  যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আলী রিয়াজ।

ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটাল হিলে ‘বাংলাদেশ’স ফ্র্যাকচার : পলিটিক্যাল অ্যান্ড রিলিজিয়াস এক্সট্রিমিজম’ শীর্ষক ওই শুনানিতে বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে অধ্যাপক আলী রিয়াজ ছাড়া আরো চারজন বক্তা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

অর্থাৎ বেশ কয়েকটি ঘটনা একসঙ্গে ঘটে গেল। এত অল্প সময়ে বাংলাদেশ বারবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়েছে।

ওই শুনানির প্রথম বক্তা ছিলেন লিসা কার্টিস। যেখানে তিনি বর্তমান সরকারের সমালোচনা করেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চিত্র তুলে ধরে সমালোচনা করেছেন। সঙ্গে এশিয়া ফাউন্ডেশনের তথ্যসূত্র তুলে ধরে বলেছেন, ৭৭% বাংলাদেশি মনে করেন নির্বাচন একটি নির্দলীয় সরকারের আওতায় হওয়া উচিত। তবে তার প্রবন্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি ছিল নির্বাচনকে ঘিরে যে রাজনৈতিক সহিংসতার মাধ্যমে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে তার মধ্যে দিয়ে জেগে উঠতে পারে জঙ্গিবাদ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে ইসালামী জঙ্গিরা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে উল্টে দিতে পারে।’

প্রবন্ধের শেষে তিনি বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের অনেক পথ বাতলে দিয়েছেন। যা দেখে বিস্ময় জাগে। তার প্রবন্ধের কোথাও নেই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংলাপের আমন্ত্রণ জানিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ফোন করেছিলেন। যে কাঙ্ক্ষিত ফোনে কোনও লাভ হয়। অথচ লিসা কার্টিস তার প্রবন্ধে শক্তিশালী কয়েকটি দেশের নাম উল্লেখ করে বলেছেন, তাদের উচিত শেখ হাসিনাকে সংলাপের জন্য ‘কনভিন্স’ করা। এমনকি এক জায়গায় তিনি বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের উচিত শেখ হাসিনা সরকারকে চাপ দেওয়া যেন বিএনপির হাজার নেতা-কর্মীদের মুক্তি দেয় অথবা চলমান বিচার প্রক্রিয়া স্বাধীনভাবে চলতে দেওয়া।’ এসবের মধ্যে তিনি অবশ্য বলেছেন, পেট্রলবোমার মাধ্যমে মানুষ হত্যার বিচার হওয়া উচিত।

তাঁর প্রবন্ধে তিনি জামায়াতের সমালোচনা করেছেন এবং ইঙ্গিতও ছিল জামায়াত নিষিদ্ধের বিষয়ে। অন্যদিকে দ্বিতীয় বক্তা হিসেবে অধ্যাপক আলী রিয়াজ বাংলাদেশের পুরো প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন।

অসাধারণভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং রাজনৈতিক সহিংসতার চিত্র কীভাবে বদলে গেল সেটাও তুলে ধরেছেন। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন দুটি বিষয়ে। যার মধ্যে একটি হলো- বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং দ্বিতীয়টি হলো- গুম। ২০১০ সাল থেকে বিস্ময়করভাবে গুম হওয়ার সংখ্যা বেড়ে গেছে বলেও অধ্যাপক রিয়াজ দাবি করেছেন। জামায়াত ইসলামীর বিরুদ্ধে আলী রিয়াজও অবস্থান নিয়েছেন। এমনকি বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে আগে বিএনপির বক্তব্য থাকলেও শাস্তি প্রদানের সময় থেকে বিএনপির নীরব ভূমিকার কথাও তুলে ধরেছেন অধ্যাপক রিয়াজ।

এভাবেই সব বক্তাই জামায়াতের রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। জঙ্গিবাদ বিস্তার ঠেকানোর স্বার্থে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণার জন্য বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ দেওয়া উচিত বলে উল্লেখ করেছেন আরেক বক্তা জে কানসারা। এমনকি তিনি জামায়াত-শিবিরকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে অনুরোধ করেন এবং এই দলের নেতা-কর্মীদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষেধের বিষয়টিও তুলে ধরেন।

সাদামাটা চোখে দেখলে আলোচনা সব কিছু ভালোই ছিল। কিন্তু হিসেবে কোথাও যেন একটি গরমিল আছে! কয়েক মাস আগেও তো নিউইয়র্ক টাইমস তাদের সম্পাদকীয়তে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আমাদের আদালতকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল।কাদের মোল্লা এবং কামারুজ্জামানের ফাঁসির সময়ও দেখা গেছে তাদের দেশের পত্রিকাগুলো যুদ্ধাপরাধীদের ‘ইসলামিক গুরু’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। তাই খটকা ঠেকছে। হুট করেই তাদের জামায়াতের প্রতি ‘দরদ’ কি কমে গেল? আবার সেই আলোচনার দুই দিন পরই আল-কায়েদার বক্তব্য! সবকিছুই কেন যেন ‘প্রশ্নবোধক’ চিহ্নের অবতারণা করে।

প্রশ্নটা হলো জামায়াতের সঙ্গে ‘বন্ধুত্বসূলভ’ আচরণ বাদ দিয়ে কেন তারা জামায়াতের বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করল? তাদের কী স্বার্থ এখানে? যুক্তরাষ্ট্র এমন এক দেশ, যে দেশ স্বার্থ ছাড়া কিছুই বোঝে না। সারা বিশ্বের অস্থিরতা এবং অরাজকতার পেছনে এই দেশটির ‘কালো হাত’ রয়েছে এমনটাই শোনা যায়। যে ওসামা বিন লাদেন তাদের তৈরি বলে সব জায়গা চাউর আছে সেই লাদেনই শেষে তাদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। ৯/১১ ঘটনার পর সারা বিশ্বেই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও জঙ্গিবাদ ইস্যু সামনে চলে আসে। আর এই জঙ্গিবাদ শব্দটিকে মাইকে বাজিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তালেবান উৎখাতের অজুহাতে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে চালায় রক্তের বন্যা। ওসামা বিন লাদেনকে উৎখাত করা গেছে কিন্তু সত্যিকার অর্থে তালেবানকে নিয়ন্ত্রণ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ যুক্তরাষ্ট্র। তা ছাড়া ইরাকেও হামলা চালায় এই দেশটি। অজুহাত ছিল তালেবানদের মদদ দিচ্ছেন সাদ্দাম। অথচ সবার জানা- তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল ‘তেল’। বহু বছর ধরে চলমান ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘর্ষের গল্পও তো আমরা জানি। এভাবেই জঙ্গিবাদের মাইক বাজিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র।

সম্প্রতি অভিজিৎসহ অন্যদের হত্যা সংক্রান্ত আল-কায়েদার হুট করে এমন দায় স্বীকার অন্য কিছুর ইঙ্গিত করছে না তো? বিষয়টা এমন না তো- কাউকে বাঁচাতেই বা কাউকে সুযোগ করে দিতেই আল-কায়েদা অভিজিৎ হত্যার দায় স্বীকার করেছে? হুট করে আবার জামায়াত প্রসঙ্গে মার্কিনিদের অবস্থান পরিবর্তনেরই বা কারণ কী? দুয়ে দুয়ে চার বা পাঁচ অনেক কিছুই তো হতে পারে, তাই না! 

শেরিফ আল সায়ার : লেখক ও গবেষক