সালমান খান

অবশেষে তারকার পতন : রানা আইয়ুব

Looks like you've blocked notifications!
রানা আইয়ুব

রানা আইয়ুব একজন পুরস্কার বিজয়ী অনুসন্ধানী সাংবাদিক এবং রাজনীতি-বিষয়ক লেখক। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে একটি বইয়ের কাজ করছেন তিনি। বইটি এ বছরের শেষ নাগাদ বের হবে। আজ সালমান খানের পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় তাঁর এই লেখাটি এনডিটিভির অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছে।

প্রায় এক দশক আগে সালমান খান এক বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যার সমস্ত আয় ‘বিয়িং হিউম্যান’ নামের একটি ফান্ডে জমা হতো। এই উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন একটি বিশেষ সময়ে। ২০০২ সালের ঘটনা। ফুটপাথে শুয়ে থাকা কিছু ঘুমন্ত লোকের ওপর তাঁর এসইউভি (সালমানের গাড়ি) চেপে বসল, তার কয়েকদিন বাদেই এই উদ্যোগ।

আদালত আজ রায় দিয়েছেন, সালমান সে সময় মদ্যপ ছিলেন। মুম্বাই এলাকায় তাঁর আবাসের আশপাশেই ঘটেছিল এই গাড়িচাপার ঘটনা। কিছু রিপোর্টের বক্তব্য মতে, কিছু ভিকটিম তাকে গাড়ি ‘স্লো’ করতে বলেছিল, কিন্তু তাতে আমল দেননি তিনি। ‘বিয়িং হিউম্যান’ তত্ত্বের আওতায় নিশ্চয়ই বিষয়টা তাঁর আমলে নেওয়া উচিত ছিল!

একই সময়ে এই অভিনেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে তিনি আন্ডারওয়ার্ল্ডের সাথে জড়িত এবং যে নারীটির সাথে ঘোরাফেরা করছেন (সেই সময়) তাঁকেও নির্যাতন করেছেন শারীরিকভাবে। এই দুর্ঘটনার বহুদিন পরে তিনি তাঁর সাবেক প্রেমিকার ছবির শুট ভণ্ডুল করে দেন, এমনকি নাকাল করেন সেই ছবির অভিনেতাকেও। তাঁর সহশিল্পীরা গণমাধ্যমকে বলেন, তিনি ছিলেন এক ‘বখে যাওয়া ছেলে’, তবে তাঁর বুকের মাঝে আছে ‘এক টুকরো রত্ন’! স্বাভাবিকভাবেই তাঁর গুণগ্রাহী অনেক, কারণ তিনি তাঁর কলাকুশলীদের দরকারে দেদার বিলিয়েছেন অজস্র অর্থকড়ি। তাঁর হৃদয় স্বর্ণখচিত, এমনই বলেন তাঁর সমর্থকরা। ‘সালমান ভাই’ বলতে অজ্ঞান তাঁর সমর্থকরা।

বান্দ্রায় সালমানের আবাস গ্যালাক্সি অ্যাপার্টমেন্টে। ‘ভাই’ যদি ব্যালকনিতে একটু চেহারা দেখান, এই ধরুন ‘গণেশ উৎসব’ কিংবা ‘ঈদ’-এর মতো উৎসবে, তাহলেই ভক্তদের সমুদ্র বয়ে যাবে সেখানে। তাঁর নারীভক্তরা প্ল্যাকার্ড নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করবেন, অপেক্ষায় রইবে অজস্র গোলাপ ফুল। পেশি ফুলোনো পুরুষভক্তরা প্রায়ই বাইরে দাঁড়িয়ে তাঁর সাথে একটি ছবি তোলার জন্য এন্তেজার করেন।

২০০৪ সালে সালমানকে পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হলো আর তিনি জামিনে ছাড়া পেলেন। তিনি একটি মুসলিম টুপি পরে টিভিতে একখানা সাক্ষাৎকার দিলেন, উপস্থাপককে বললেন, ইসলামে ‘অ্যালকোহল’ হারাম এবং তিনি অ্যালকোহল অর্থাৎ মদ্যপান পরিত্যাগের মাধ্যমে ‘গুড’ মুসলিম হয়ে ওঠার চেষ্টা করবেন।

এসব ছাপিয়ে কিন্তু কেউই সালমানের ‘আসল’ কিংবা ‘ভুল’ মদ্যপানের ঘটনার যাচাই করতে চাইবেন না যথাযথভাবে। কিন্তু বিষয়গুলো আসলে গুলিয়ে ফেলার মতো নয় কি? আজ আদালতে তাঁর আইনজীবীরা বলেছেন, লম্বা সময় জেল হলে সালমান তাঁর ‘চ্যারিটি’ কার্যক্রম ঠিকঠাক চালাতে পারবেন না। এমন কিছু রিপোর্টও হয়েছে যে, দানকার্যকে উদ্দেশ্য করে আইনজীবীরা যখন সালমানের স্বল্প সাজার আবেদন করছেন, সালমান তাঁদের দিকে তখন কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন।

আমি যখন লিখছি, এমন সময় ইন্ডাস্ট্রিতে সালমানের কিছু বন্ধু বলছেন যে সেলিব্রিটি হওয়ার খেসারত দিতে হয়েছে সালমানকে। তাঁদের জিজ্ঞেস করুন, ওই ঘটনায় নিহত ব্যক্তিটির নাম, প্রায় সবাইকেই বেগ পেতে হবে নির্ঘাত।

সালমানের শুভানুধ্যায়ীরা কি আরেকটি প্রশ্নের উত্তর দেবেন, ড্রাইভার যখন নিজের থেকে ‘দাবি’ করলেন যে সালমান নন বরং তিনি নিজেই স্টিয়ারিং হুইলের পেছনে ছিলেন, সালমানের এই ‘মানবতাবোধ’ তখন কোথায় ছিল? পুনশ্চ, ড্রাইভারের এই বক্তব্যটি আদালত খারিজ করে দিয়েছেন।

আজ সালমান খান অনিচ্ছাকৃত হত্যা, মদ্যপ অবস্থায় দায়িত্বহীন ড্রাইভিংয়ের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। তাঁর বন্ধুরা আইনি কাঠামোর দুর্বলতা এবং সেলিব্রিটিদের ওপর চড়াও হওয়া নিয়ে শোরগোল তুলবেন। আসলে তাই যদি হতো, তাহলে সালমান নিশ্চয়ই আজ থেকে ১৩ বছর আগেই দোষী সাব্যস্ত হতেন, সাজা পেয়ে যেতেন!

আপনার ভাবনায় কি ওই রাস্তার লোকগুলোর জন্য, আহত লোকগুলো, মৃত লোকটির পরিবারের মানুষদের জন্য একটুকু জায়গা আছে? যাদের দিনের কষ্টার্জিত আয় থেকে আরো কষ্টে কয়েকটা রুপি বাঁচিয়ে ১৩টি বছর ধরে আদালতে গিয়ে হাজিরা দিতে হয়েছে, সাক্ষ্য দিতে হয়েছে?

সালমান যদি ‘বিয়িং হিউম্যান’-এর এত বড় উদাহরণ হতেন, তাহলে তিনি এই লোকগুলোর কাছে ক্ষমা চাইতে পারতেন। বড় বড় আর হাই প্রোফাইল আইনজীবীদের না ডেকে (যাঁরা সামনে নতুন কোনো যুক্তি নিয়ে হয়তো আবারও হাজির হবেন) নিজের অপরাধের মুখোমুখি হতেন।

দিনকয়েক আমি আর আমার কয়েকজন বন্ধু নতুন মারাঠি ছবি ‘কোর্ট’-এর দারুণ প্রশংসা করেছি। এ ছবিতে এক দরিদ্র এবং ক্ষমতাহীন ব্যক্তি আদালতের সাথে একরকম লড়াইয়ে নামেন। ইন্ডাস্ট্রিতে আমার অনেক বন্ধু বলেছেন, আমাদের দেশ থেকে এ ছবি অস্কারে যাওয়া উচিত। আমার বন্ধুরা আশা করি এ আবেগটা বুঝবেন, বুঝবেন যে ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণী আদালতের এই রায়ে গর্বিত। বিচার দেরিতে হয়েছে কিন্তু বিচারে ভুল হয়নি- এটাই ‘বিয়িং হিউম্যান’!