আন্দোলন আর বিপ্লবী নেই : অরুন্ধতী রায়
লেখক-মানবাধিকারকর্মী অরুন্ধতী রায় দুদিন আগে ভারতের সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এতে তিনি কথা বলেছেন জাতপ্রথা, ভূমি সমস্যা ও প্রগতিবাদী বা বিপ্লবী আন্দোলন নিয়ে।
অরুন্ধতী মনে করেন, ভারতীয় সমাজে জাতিপ্রথা যে ভূমিকা পালন করছে, বামপন্থীদের এখন তার বুদ্ধিবৃত্তিক পুনর্মূল্যায়ন করা দরকার। শুধু নেতৃত্বের পরিবর্তন করে বামদের ভাগ্যে কোনো নাটকীয় পরিবর্তন আসবে না।
ডানপন্থী হিন্দু রাজনীতিতে বামদের গ্রহণযোগ্য বিরোধী দল হিসেবে উঠে আসার ব্যাপারে আশাবাদী নন অরুন্ধতী।
‘জাতি ইস্যু মোকাবিলায় বামরা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। জাতকে শ্রেণী বলে বামরা নিজেরাই নিজেদের পরাস্ত করেছে এবং নিজেদের অপ্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। এ ক্ষেত্রে বোম্বের কারখানা শ্রমিকদের অধিকার ইস্যুতে ১৯২০-এর দশকের ভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য শ্রীপদ অমৃত ডাঙ্গে ও ড. আম্বেদকরের দ্বন্দ্বটা গুরুত্বপূর্ণ। আম্বেদকর সঠিকভাবেই চিহ্নিত করেছিলেন, শ্রমিকদের মধ্যেও সমতা নেই। কারণ দলিতরা কেবল নিম্ন মজুরির কাজ পায়। ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির যাত্রা শুরুর পর থেকে ঘটনা এটাই,’ মন্তব্য অরুন্ধতীর।
‘জাতের বিরুদ্ধে লড়াইটা বেশ জটিল’ মনে করেন প্রখ্যাত এই লেখক। তাঁর মতে, ‘দার্শনিকভাবে বলতে গেলে, অধীনস্ত জাতগুলোকেও তাদের পরিচয়ে গর্ববোধ করতে হবে এবং জাতিগত শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সেই গর্বকে কাজে লাগাতে হবে। কিন্তু তখনই মূল বিষয়টা চলে আসে, যেখানে এর বিরুদ্ধে সেই বিপ্লবী অবস্থানই ব্যবহৃত হয় একধরনের বিচ্ছিন্নতা তৈরি করতে এবং এটি সুবিধাভোগীদের অবস্থানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।’
নতুন নয়
অরুন্ধতীর মতে, হিন্দু ডানপন্থীদের ঘর বাপসি প্রচারণা, যেখানে ধর্মান্তরিত মুসলিম ও খ্রিস্টানদের ‘ফেরত নেওয়া’ হয়। এর মাধ্যমে অধঃস্তন জাতকে ‘বড় বাড়িতে আনা হয়, কিন্তু রাখা হয় চাকরের ঘরে’। তিনি বলেন, ঘর বাপসি কর্মসূচি নতুন কিছু নয়। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে অশুদ্ধদের শুদ্ধ করে, ধর্মান্তরিতদের হিন্দু দুনিয়ায় আনার মধ্য দিয়ে আর্য সমাজ ও শুদ্ধি আন্দোলন এটি শুরু করেছিল।’
অরুন্ধতী মনে করেন, সাম্রাজ্যের রাজনীতি প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের রাজনীতিতে রূপান্তরের মুহূর্তে এটা ছিল জনসাধারণকে প্রভাবিত করার জন্য হিন্দু ডানপন্থীদের সুচতুর পাল্টা পদক্ষেপ।
‘তখন পর্যন্ত কেউ অধঃস্তন জাতগুলোর ইসলাম, খ্রিস্টান বা শিখধর্ম গ্রহণের বিষয়টিকে পাত্তা দেয়নি। তারপর, হঠাৎ সেই জনসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। এই ইতিহাসে, যেখানে আর্য সমাজের মতো গোষ্ঠী যুক্ত হয়েছিল, গান্ধীও এ ধারার উত্তরাধিকারী ছিলেন – তখন অস্পৃশ্যতার ব্যাপারে অনেক কথা হতো, কিন্তু জাতপ্রথা নিয়ে কোনো কথাবার্তা হতো না। জমি, সম্পদ, নির্দিষ্ট কাজের অধিকার নিয়ে কথা হতো না। এসবই ছিল জাত ব্যবস্থার সত্যিকারের ভিত্তি। এখন তারা এটাকে পুনরুজ্জীবিত করেছে, কারণ এটা কেবল দলিত সম্প্রদায়ের ব্যাপার নয়, আদিবাসীরাও এ নিয়ে লড়ছে,’ বলেন অরুন্ধতী।
মূলধারার বুদ্ধিজীবীরা যেখানে বিশ্বায়ন ও অতি-পুঁজিবাদিতাকে জাতপ্রথা ও অন্যান্য বৈষম্যের সমাধান মনে করছেন, সেখানে অরুন্ধতী রায় সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘পুঁজিবাদিতাকে আলিঙ্গনের মাধ্যমে জাতপ্রথার কাঠামো ভেঙে পড়বে না, বরং আরো শক্তিশালী করবে।’
বিষাক্ত মিশ্রণ
‘প্রকৃত ঘটনা হলো, এটা উল্লেখযোগ্য হারে ঘটেনি। টমাস পিকেটি তাঁর ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি বইয়ে দেখিয়েছেন, যাঁরা উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পদ পেয়েছেন, পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে তাঁদের সাফল্য অর্জনের সুযোগ সবচেয়ে বেশি। এটাই জাতপ্রথাকে পুঁজিবাদের মা-তে পরিণত করে, কারণ জাতপ্রথা বংশানুক্রমিক অধিকারেরই ব্যাপার, যা ঈশ্বরের ইচ্ছায় নির্ধারিত। জাতপ্রতা ও পুঁজিবাদ এক বিষাক্ত মিশ্রণে মিলিত হয়েছে। বেসরকারীকরণ দলিতদের সামান্য নিরাপদ অবস্থানটুকু, যা সংরক্ষণের কারণে প্রচলিত ব্যবস্থায় রয়েছে, তা-ও ধ্বংস করে দেবে,’ উল্লেখ করেন অরুন্ধতী রায়।
ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির উত্থাপন করা ভূমি অধিগ্রহণ বিলের কঠোর সমালোচনা করেন অরুন্ধতী রায়। এর ফলে অধিক কর্মসংস্থানের দাবিও তিনি উড়িয়ে দেন। বলেন, ‘নতুন অর্থনীতির মৌলিক পদক্ষেপ হলে করপোরেট কর্তৃক ভূমি দখল। তা হতে পারে আইটি, কয়লা কিংবা ইস্পাত কোম্পানি, প্রথম কাজ হলো ভূমি, জলাশয় নিয়ে নেওয়া এবং নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা।
এটাকে মানতে বলা হচ্ছে এই যুক্তিতে যে এতে কর্মসংস্থান বাড়বে; আসলে তা রূপকথা। পরিসংখ্যান বলে, আমরা কেবল বেকার বাড়তেই দেখছি।’
অরুন্ধতী বিষাদ নিয়ে বলেন, ষাটের দশক ও সত্তরের দশকের তুলনা করলে এখনকার ভূমি ঘিরে চলা বিতর্ককে আর বিপ্লবী বলা যায় না।
“যখন নকশাল আন্দোলন শুরু হয় এবং জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে বিক্ষোভ চলছিল, তখন ইন্দিরা গান্ধীর এক সমালোচক বলেছিলেন, তারা কী বলছে? তারা সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা বলছে, জমির পুনর্বণ্টনের কথা বলছে, কৃষকের কাছে জমি দেওয়া এবং এ রকম আরো অনেক কথা বলছে। আর এখন, এমনকি সবচেয়ে ‘বিপ্লবী’ আন্দোলনও কেবলে আদিবাসীদের জমি তাদের হাতেই ছেড়ে দেওয়ার দাবি করছে,” বলেন অরুন্ধতী।