শ্রদ্ধা

প্রিয় মাটিতে চিরনিদ্রায় কবি

Looks like you've blocked notifications!

২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ মাঠে দুপুর থেকেই শুরু হয় জনসমাগম। বেলা গড়িয়ে যাওয়ার সাথে সমাগম আরো বাড়তে থাকে। অনেকের হাতেই ফুল। অনেকের হাতে ব্যানার। কুড়িগ্রাম-রংপুর-লালমনির হাটসহ বিভিন্ন স্থান থেকে আগত সৈয়দ শামসুল হকের ভক্তরা এসেছে। সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক অসংখ্য সংগঠনের পক্ষে অনেকেই এসেছে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। মাইকে এস এম আব্রাহাম লিংকন ঘোষণা করছেন আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই সব্যসাচী লেখকের মরহেদ নিয়ে হেলিকপ্টারটি এসে পৌঁছাবে।

উৎসুক জনতা তখন আকাশমুখী। এর কিছুক্ষণের মধ্যে হেলিকপ্টার চলে আসে। মাইকে তখন   আব্রাহাম লিংকন ঘোষণা করছেন আপনারা সবাই স্যালুট করেন। সবাই তখন হাত কপাল পর্যন্ত তুলে আকাশের দিকে তাকানো। সবার চোখেমুখে তখন গভীরতর আবেগ। কবির নিথর দেহে শেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেলিত জনতা। হেলিকপ্টার নামতেই একবার কবিকে দেখতে হাজার হাজার মানুষ সে দিকেই এগিয়ে যায়। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর আবেগ জড়িত কণ্ঠে বলছিলেন- ‘কুড়িগ্রামের সন্তানকে কুড়িগ্রামে নিয়ে আসা হয়েছে।’ তাঁর কণ্ঠে বিষাদের স্পষ্ট ছাপ লক্ষ করা যাচ্ছিল। সৈয়দ শামসুল হকের ছেলে দ্বিতীয় সৈয়দ হক সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সহযোগিতার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফুলে ফুলে ভরে যায় আমাদের প্রিয় হক ভাইয়ের মরদেহ বহন করা কফিনটি। যখন দোয়া পর্ব চলছিল তখন দ্বিতীয় সৈয়দ হক বাবার কবরের পাশেই এসে দাঁড়িয়ে দোয়া-প্রার্থনা করেন।

সৈয়দ শামসুল হকের দাফন কুড়িগ্রামে হওয়ায় কুড়িগ্রামবাসী শোকাতুর হলেও এই শোকে এক প্রকার গর্ববোধ রয়েছে। সৈয়দ শামসুল হক কুড়িগ্রামে সমাহিত হতে চেয়েছেন এবং সমাহিত হলেন এর মধ্য দিয়ে তাঁর শেষ চিহ্ন তো কুড়িগ্রামে থাকল। অনেকেই বলছিলেন সৈয়দ হক আমাদের ছেড়ে যাননি। তিনি আমাদের সঙ্গেই আছেন। কাল যখন হেলিকপ্টারটি কুড়িগ্রামে অবতরণ করে তখন মাঠে উপস্থিত জনতা ছিল শোকে মূহ্যমান। সৈয়দ শামসুল হকের লেখার যে পরিধি সেই পরিধি এবং বহুমাহিত্রকতা বিচার করলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর পর অন্যতম সাহিত্যিক বলা যায় তাঁকে।

সৈয়দ শামসুল হককে দাফনের পর জন মানুষের ভিড় কমতে শুরু করলে আনোয়ারা সৈয়দ হক, দ্বিতীয় সৈয়দ হক স্ত্রী-সন্তানসহ এসে দাঁড়ালেন কবরের পাশে। হাত তুলে তাঁরা প্রার্থনা করেন। সৈয়দ শামসুল হককে কুড়িগ্রামে সমাহিত করতে পারায় আনোয়ারা সৈয়দ হক সন্তুষ্টি প্রকাশ করছিলেন।

সৈয়দ শামসুল হক জীবদ্দশায় কুড়িগ্রামকে ঘিরে লেখার বলয় নির্মাণ করেছিলেন। মারা যাওয়ার পরও কুড়িগ্রামে থাকলেন। এর মধ্য দিয়ে সৈয়দ শামসুল হক কুড়িগ্রামে অধিক পঠিত হবে। শুধু পঠন-পাঠন নয় কুড়িগ্রামের চিন্তাগত সংস্কৃতিতেও আসবে পরিবর্তন। কবির জন্ম-মৃত্যু দিবস এখন সবচেয়ে ঘটা করে করা হবে কুড়িগ্রামে। সৈয়দ শামসুল হকের নামে হয়তো সেখানে একটি পাঠাগার হবে, একটি জাদুঘর হবে। প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে অসংখ্য ভক্ত-পাঠক আসতে থাকবে। কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজেরও দায়িত্ব বেড়ে গেল অনেকখানি। এখন কত দ্রুত সৈয়দ শামসুল হকের কবরটিসহ পার্শ্ববর্তী এলাকাটি দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তুলতে হবে। একজন আর্কিটেক্টকে দিয়ে স্থাপনা সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজটিও করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সৈয়দ শামসুল হকের চিকিৎসার ব্যয়ভার নিজেই গ্রহণ করেছেন। অসুস্থ কবিকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে দীর্ঘ সময় সঙ্গ দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি সব প্রোটোকল ভেঙে কবিকে শেষ শ্রদ্ধা জানতে গিয়েছিলেন। আমরা মনে করি খুব দ্রুত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় কবির কবর একটি দৃষ্টিনন্দন অবয়ব লাভ করবে। রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী কবির প্রতি যে শ্রদ্ধা-ভালোবাসা দেখিয়েছেন তাও বিরল।

জেলার প্রতি একজন মানুষর কতটা ভালোবাস থাকলে মৃত্যর পরও সেখানেই থাকতে চান তার সুন্দরতম দৃষ্টান্ত সৈয়দ শামসুল হক। এই তো কয়েকদিন আগেও এসেছিলেন কুড়িগ্রামে। কবির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এসএম আব্রাহাম লিংকনকে কবি অসুস্থ অবস্থাতেও বলেছিলেন কবি এবারে আকাশ পথে সৈয়দপুর হয়ে আসবেন। তার জন্য একটি ভালো গাড়ি যেন রাখা হয়। সেই কবি এলেন। আকাশ পথেইে এলেন। কিন্তু এই আকাশ পথ সৈয়দপুর বিমানবন্দর নয় নামলেন চিরস্থায়ী ঠিকানার খুব কাছে। যেখান থেকে চারজন কাঁধে নিয়ে এলেন। কবি আমাদের কাঁদালেন শোকে। কবি থাকুন চিরনিদ্রায়। চিরসুখে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ ,বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর