তারকার জন্মদিন

যান্ত্রিক নগরে এক নগর বাউল

Looks like you've blocked notifications!

১৯৯৫ সাল। আমি তখন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। এখনকার মতো এত রকমের বিনোদন মাধ্যম না থাকলেও বিনোদিত হতে সমস্যা হতো না। মঙ্গলবার বিকেল ৩টায় বিটিভিতে ‘মিস্টার বিন’, রোববারে বিটিভির প্যাকেজ নাটক। এ ছাড়া বাংলায় ডাবিং করা ‘আলিফ লায়লা’, ‘টিপু সুলতান’ ছিল প্রধান বিনোদন। ততদিনে মনের খোরাক মেটানোর এক বিশাল জগতে প্রবেশ করে ফেলেছি। যদিও তখন আমার জন্য তা ছিল নিষিদ্ধ। ‘আউট বই’, পাঠ্যপুস্তকের বাইরের কোনো সাহিত্যের বই এ নামেই ডাকতেন অভিভাবকরা।

খেলার মাঠে ক্রিকেট কিংবা ফুটবল, স্কুলে বা বাসায় লুকিয়ে লুকিয়ে পড়া কিশোর উপন্যাস ‘তিন গোয়েন্দা’ আর বিটিভির অনুষ্ঠানই ছিল বিনোদনের ভাণ্ডার। এরই মধ্যে হঠাৎ পরিচয় হয় ‘তাঁর’ সঙ্গে। গৃহশিক্ষক একদিন ভুল করে বাসায় ফেলে গেলেন একটি অডিও ক্যাসেট। সেটা পেয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে থাকি। ক্যাসেটটার নাম ‘নগর বাউল’। 

সে বছরই মুক্তি পেয়েছিল অ্যালবামটি। ক্যাসেটের কভারে চারজন মানুষের ছবি। মেঝেতে বসা মানুষটিকে সহজেই বাকিদের থেকে আলাদা করে চোখে পড়ে। এখনো স্পষ্ট মনে আছে, কভারের ছবিতে মেঝেতে বসা মানুষটি কালো টি-শার্টের ওপর লাল চেকশার্ট পরেছিলেন। বুনো কোঁকড়ানো ঝাঁকড়া চুল। তাকিয়ে থাকার ভঙ্গিতে ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাবটি স্পষ্ট। 

বাবার টু-ইন-ওয়ানে ক্যাসেটটি বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠল গীতিকার দেহলভীর লেখা গান, 

‘নাগ নাগিনীর খেলা, স্বর্পরাজ্যের খেলা, 
বিষধর তোলে ফেনা, ছোবলে বিষের জ্বালা…।’ 
 আমি নড়েচড়ে বসলাম। আমার সামনে নতুন আরেকটি দিগন্ত উন্মোচিত হলো। গানের, বিশেষ করে ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডের গানের সঙ্গে পরিচয় হলো এই অ্যালবামের মাধ্যমে।

ক্যাসেটের ফিতা টেনে প্রথম থেকে দিলাম, আবার শুনলাম। কি কথা, কি সুর, কি কণ্ঠ! জাদু করে ফেলল মনে হলো। সেই শুরু! ফিতা ক্যাসেটের যুগের সব ফিলিংস, নগর বাউল ও জেমসের একক গানের ক্যাসেট আমার সংগ্রহে ছিল। মা বকতেন, ‘গান বন্ধ কর।’ বাবার নির্দেশ আরো উদ্ভট, ‘ওই সব গান টু-ইন-ওয়ানে বাজাবি না। এটা নষ্ট হবে। আমি খবর শুনতে পারব না।’ 

কৈশোরে যে গানের নেশা মাথায় ঢুকিয়ে দিল ফিলিংস, তা থেকে বেরোতে পারলাম না। নিজের পছন্দের গানগুলো শান্তিতে শোনার জন্য কিনে ফেললাম ওয়াকম্যান। কিন্তু এভাবে গানের নেশায় পড়ার কারণ কী? কারণ, ওই একজনই। ‘নগর বাউল’ অ্যালবামের কভারে লাল চেকশার্ট পরে মেঝেতে বসে থাকা সেই মানুষটি। কারণ, ফারুক মাহফুজ আনাম জেমস। আমার কাছে জেমস ছোটবেলার সেই হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো, যে তাঁর সুরে বিমোহিত করে রেখেছেন এখনো। 

তরুণদের মধ্যে জিন্স আর পাঞ্জাবি পরার ক্রেজ নিয়ে আসেন জেমস। ১৯৯৮ সালের ‘লেইস ফিতা লেইস’ অ্যালবামের কভারের ফটোশুটের জন্যই সম্ভবত প্রথম জিন্স প্যান্টের সঙ্গে পাঞ্জাবি আর গলায় গামছা ব্যবহার করেছিলেন জেমস। তাঁর সেই স্টাইল জনপ্রিয় হতে সময় লাগেনি। হু-হু করে লাখো তরুণ তখন পাঞ্জাবির সঙ্গে জিন্স প্যান্ট পরা শুরু করে দিল। আমি তো আরো এককাঠি সরেশ। পুরোপুরি জেমসের পাঞ্জাবি পরার স্টাইলকেই অনুসরণ করতাম। পাঞ্জাবির হাতা একেবারে বাহুর ওপর পর্যন্ত গুটিয়ে রাখতাম। আর বুকের সব বোতাম থাকত খোলা। এই স্টাইল ফলো করতে গিয়ে বকা, এমনকি মারও খেয়েছি বাবার হাতে। 

জেমসের প্রথম কনসার্ট দেখার কথা এখনো মনে পড়ে। ১৯৯৭ সাল। ক্লাস সিক্সে পড়ি। আমার গৃহশিক্ষক তখন পড়তেন সরকারি তিতুমীর কলেজে। জেমসের কনসার্ট হবে। আমি গোঁ ধরে বসলাম, কনসার্টে যাবো। গৃহশিক্ষক সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন আমাকে। স্টেজের খুব কাছাকাছিই ছিলাম। সেই প্রথম কাছ থেকে দেখা। আজো ভুলতে পারি না। কি স্টাইল, কি ব্যক্তিত্ব। 
নব্বইয়ের দশক ছিল মূলত কনসার্ট ও ব্যান্ড কালচারের জন্য স্বর্ণযুগ। প্রতি সপ্তাহেই কোথাও না কোথাও কনসার্ট লেগেই থাকত। জেমসের পিছু নিতে গিয়েই চেনা হয় ঢাকার আর্মি স্টেডিয়াম, ঢাকা কলেজ, টিএসসি, ধানমণ্ডি উইমেন্স কমপ্লেক্স, কলাবাগান মাঠ, আবাহনী মাঠ। জেমসের কনসার্টের লোভে রাজধানী তাড়িয়ে বেড়ানো সেই দুরন্ত কৈশোর। 

বলিউডে গেলেন জেমস। সেখানেও প্লেব্যাক করে কাঁপিয়ে দিলেন। আন্তর্জাতিক রকস্টারে পরিণত হলেন। কিন্তু তাঁর উদাসী আচরণ, খেয়ালিপনা, আত্মমগ্নতা—ঠিক আগের মতই আছে। পত্রিকা, টিভি কোথাও তিনি সরব নন। গান ছাড়া তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায় না। 

টিভিতে এখন ‘লাইভ কনসার্ট’ হয়। সেখানেও জেমস দেখিয়েছেন তাঁর নিজস্বতা। কখনো অপেরা গায়িকা, কখনো তানপুরা বা কখনো হারমোনিয়ামের সঙ্গে নিজের গানগুলো নতুনভাবে উপস্থাপন করেছেন। কোথায় তাঁর উপস্থিতি বা প্রভাব এতটুকু ম্লান হয়নি। 

একজন রকস্টার থেকে তরুণ প্রজন্মের কাছে ‘গুরু’তে পরিণত হয়েছেন তিনি। তাঁর পাগল ভক্তরা তাঁকে ভালোবেসে ডাকেন ‘গুরু’ জেমস। জেমসের এই আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা আজকের মিডিয়া বা ব্র্যান্ড প্রমোশনের মতো আরোপিত ছিল না। তাঁর সঙ্গে ভক্তদের যোগাযোগ ছিল সরাসরি, যার মাধ্যম ছিল শুধু গান। 

জেমসের গানেই পাওয়া যায় গানের প্রতি সেই ভালোবাসা, 

‘সুরের টানেই আমার নেশা
সুরের মাঝেই আমার দিশা
একটা গিটার সঙ্গী-সাথি,
সুরের ভুবনে…সুরের সাগর দিচ্ছি পাড়ি
সুরের নায়েই ঘর আর বাড়ি
ইচ্ছে হলেই কাঁদি-হাসি
সুরেরই মায়ায়…।’ 

গান গাওয়ার আহ্বানও ছিল তাঁর গানে…

‘গান হোক চিৎকারে, গান হোক চুপিচুপি 
গান হোক চুপি চুপি...গান গাও, গান গাও 
হেঁড়ে গলায় ভুল সুরে...’

আজ ২ অক্টোবর, জেমসের জন্মদিন। জন্মদিনের শুভেচ্ছা গুরু। তাঁর গান দিয়েই ভালোবাসা জানাচ্ছি তারুণ্যের এই রকদেবতার প্রতি…
‘বাগান উজাড় করে
নিঃসঙ্গ একটি ফুল
আজো জেগো আছে একা
শুধু তোমার জন্য’

লেখক : সাংবাদিক