রবির জন্মদিন

অশেষ রবীন্দ্রনাথ

Looks like you've blocked notifications!
বিশ্বজিৎ ঘোষ। ফাইল ছবি

পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাবয়িত্রী ও কারয়িত্রী প্রতিভার নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। রবীন্দ্রনাথকে আমি স্রষ্টা এবং কর্মযোগী মানুষ হিসেবেই দেখতে ভালোবাসি। জন্মের পর ১৫৪ বছর অতিক্রান্ত, মৃত্যুর পরও আমরা পেরিয়ে এসেছি পঁচাত্তর বছর, তবু বাংলাভাষী মানুষের কাছে রবীন্দ্রনাথের অব্যাহত প্রভাব দেখে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। তাঁর সাহিত্যকর্মের পরিমাণ বিপুল, লিখেছেন তিন হাজারের অধিক গান, এঁকেছেন দু’ সহস্রাধিক চিত্র, প্রতিষ্ঠা করেছেন মানবকল্যাণমূলক অনেক প্রতিষ্ঠান। দ্বিমাত্রিক এই প্রয়াস এবং উদ্যোগের কথা স্মরণে রেখেই আমি দেখতে চাই, ভাবতে ভালোবাসি রবীন্দ্রনাথকে। যাকে বলব বহুমাত্রিক সাহিত্য প্রতিভা  রবীন্দ্রনাথ তার উজ্জ্বল উদাহরণ। কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, প্রবন্ধ, ছড়া, ব্যক্তিগত রচনা, ভ্রমণসাহিত্য, চিঠিপত্র, সংগীত কোন রূপকল্পে না লিখছেন রবীন্দ্রনাথ? বাংলা কবিতাকে প্রাদেশিকতার সীমানা ছাড়িয়ে তিনি করে তুলেছেন আন্তর্জাতিক, বাংলা ছোটগল্পের নির্মাতা তিনি, বাংলা উপন্যাসে তিনিই প্রথম দিয়েছেন আধুনিকতার স্পর্শ। নাটকের বিষয় ও আঙ্গিক নির্মাণে তাঁর অবদান ঐতিহাসিক। সংগীত, চিত্রকলা, চিঠিপত্র, ভ্রমণসাহিত্য, ভাষাতত্ত্ববিষয়ক প্রবন্ধ, ব্যক্তিগত রচনা সর্বত্রই রবীন্দ্রনাথের ভুবনবিজয়ী হাতের স্পর্শ এখনো আমাকে বিস্ময়ভূত করে রাখে। সৃষ্টি প্রয়াসে তিনি নিজেকেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবেছেন পৌনঃপুনিকভাবে বাঁকবদল করেছেন আপন চিন্তাধারা ও রূপকল্পের।

প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের যা কিছু শ্রেষ্ঠ তা পরমজ্ঞানে আত্তীকরণ করে রবীন্দ্রনাথ নির্মাণ করেছেন বাঙালি সংস্কৃতির চিরায়ত এক রূপ। বাঙালির মুখে তিনি ভাষা জুগিয়েছেন, বুকে দিয়েছেন ভরসা, চোখে পরিয়েছেন স্বপ্নকাজল আর চিত্তে সঞ্চার করেছেন আত্মবিকাশের অফুরান বাণী।

শিল্পস্রষ্টা এই রবীন্দ্রনাথের পাশেই আছেন আরেক রবীন্দ্রনাথ-সেই রবীন্দ্রনাথই এখন আমার কাছে বেশি জরুরি। এখানে তিনি সমাজ সংস্কারক। এই রবীন্দ্রনাথ পল্লী উন্নয়নে উদ্যমী, এই রবীন্দ্রনাথ গ্রামীণ দারিদ্র্যবিমোচনে সদা-সচেষ্ট। এখানে তাঁকে দেখি কৃষি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে, ক্ষুদ্রঋণ ধারণার পথিকৃৎ রূপে, শ্রীনিকেতনে সমাজ-উন্নয়ন চিন্তক হিসেবে, তাঁকে দেখি গ্রামীণ নারীদের কৃত্তিমূলক জ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে, দেখি পরিবেশন-সচেতন একজন দার্শনিক রূপে। গ্রাম-উন্নয়নের জন্য কত কাজই না তিনি করেছেন। সে সব কাজ এত বছর পরেও এতটুকু প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। শিক্ষা-চিন্তক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ এখনো আমার কাছে শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিত্ব। তাঁর কাছেই প্রথম শুনেছি শিক্ষা হচ্ছে প্রযুক্তি। শিক্ষাকে প্রযুক্তি হিসেবে গ্রহণ করে তিনি মানব উন্নয়নের আহ্বান জানিয়েছেন যা আমাদের জন্য এখন অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী চিন্তক। দীর্ঘ আশি বছরের অবিরল সাধনায় তিনি উচ্চারণ করেছেন মানবমুক্তির মাঙ্গলিক বাণী। ব্যুয়র যুদ্ধ, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড থেকে আরম্ভ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্য পর্যায় পর্যন্ত, যখনই বিশ্ব-মানবসমাজের কোনো অংশ অত্যাচারী শাসকের হিংস্র আগ্রাসনের শিকার, যখনই পৃথিবীর কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে শান্তি বিঘ্নিত বিশ্ব-মানবিকতার অপ্রতিম প্রতিনিধি নিয়তজাগর রবীন্দ্রনাথ তখনই প্রতিবাদে মুখর, দ্রোহিতায় শাণিত। আমার রবীন্দ্রনাথ এই প্রতিবাদী রবীন্দ্রনাথ, এই দ্রোহী রবীন্দ্রনাথ। আমার রবীন্দ্রনাথ বিপুল শক্তি ও অনন্ত সম্ভাবনায় সমুদ্রের মতো বিশাল, আকাশের মতো সর্বত্রবিস্তারী, সূর্যের মতোই তাঁর দীপ্তি, উত্তাপ ও ঔজ্জ্বল্য। জীবনের সব সীমাবদ্ধতা ভ্রান্তি নিয়েই আমার রবীন্দ্রনাথ মানুষের চিরকালীন স্রোতে অসামান্য এক নাম।

তিনি অশেষ, তিনি অসীম- তিনি রবীন্দ্রনাথ।

বিশ্বজিৎ ঘোষ : গবেষক ও অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়