ফুটবল

জাদুকর এক ফুটবলকন্যার গল্প!

Looks like you've blocked notifications!

একে তো গ্রামের মেয়ে। আবার সে করতে চায় খেলাধুলা! যে সে খেলা নয়, ফুটবল! ছেলেদের সঙ্গে রীতিমতো পাল্লা দিয়েই ফুটবল খেলে সে। গ্রামবাসীর টিপ্পনী শুনে মা-বাবা মেয়েকে বকা দেন। শাসন করেন। পাড়ার উঠতি ছেলেদের ছি-ছি তাতে কমে না।

কিন্তু মেয়েও দমে যাওয়ার পাত্রী নয়। লুকিয়ে ঠিকই খেলতে চলে যায় মাঠে। আবার সে ছেলেদের সঙ্গেই ফুটবলে মেতে ওঠে। শুধু মেয়েদের সঙ্গে খেলবে, অত মেয়ে পাবে কই? তা ছাড়া ছেলেদের সঙ্গে দ্রুতগতির ফুটবল খেলতেই বেশি স্বচ্ছন্দ সে।

নিরুপায় মা-বাবা মেয়ের মাঠে যাওয়ার ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। একদিন খেলার মাঠ থেকে ফুটবলটি এনে চুলায় পুড়িয়ে ফেলেন তাঁরা। এ ঘটনার পর অভিমানে মেয়েটি খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়। ঘরে কপাট মেরে শুয়ে থাকে। এ অবস্থায় মা-বাবা বাধ্য হয়ে মেয়েকে বাড়ির উঠানেই ফুটবল খেলার ব্যবস্থা করে দেন।

গরিব বাবা আবার বল কিনে দেন। উঠানে জমে ওঠে ফুটবল। ছোট্ট উঠানের মাঠে মেয়ের পায়ের জাদু দেখে তিনি ভুলেই যান যে এ তার মেয়ে। দৃশ্যগুলো দেখে বাবা আপ্লুত হন। তাঁর চোখে জল গড়ায়। গ্রামের লোকজনও মেয়েটির নৈপুণ্যভরা উঠান-ফুটবল দেখে প্রতিযোগিতামূলক খেলায় অংশ নিতে বলে।

এরপরই আসে ২০১০ সাল। মেয়েটি নিজের স্কুল থেকে উপজেলা পর্যায়ে ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। প্রথম ম্যাচেই সবার নজর কাড়ে সে। নিজের নৈপুণ্যে তার স্কুলটি উপজেলায় চ্যাম্পিয়ন হয়। সে হয় সেরা খেলোয়াড়।

উপজেলা সদরের সেরা প্রতিষ্ঠান সূতি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল (ভিএম) মডেল পাইলট হাইস্কুলের শরীর চর্চা শিক্ষক গোলাম রায়হান বাপন আসল হীরা চিনতে ভুল করেন না। বাপন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল লতিফকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করান। মেয়েটির পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে সেই স্কুলে বিনা বেতনে পড়ানোর ব্যবস্থা করেন। পড়া বড় বিষয় নয়, মূল টার্গেট মেয়েটির ভেতর থেকে ফুটবল জাদু বের করে আনা।

এর পরই শুরু হয় মেয়েটির বড় মাঠে অবাধ ফুটবল চর্চার অভিযান। একে একে সেই মেয়েটির নেতৃত্বে জাতীয় স্কুল ও মাদ্রাসা ফুটবল প্রতিযোগিতা ২০১১, ২০১২ ও ২০১৩ সালে তিনবারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয় তার স্কুল।

পরবর্তী সময়ে জাতীয় পর্যায়ে অনূর্ধ্ব-১৫ নারী ফুটবল দল গঠন করা হলে সে অধিনায়ক নির্বাচিত হয়। একই সঙ্গে সূতি ভিএম মডেল হাইস্কুলের আরো দুই ফুটবলার জাতীয় দলে স্থান পায়। ময়মনসিংহের কলসিন্ধুরের মেয়েদের নিয়ে গঠিত হয় এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবল দল। নেতৃত্বের ভার পড়ে সেই মেয়েটির কাঁধে।

তারপর সব ইতিহাস। যে ইতিহাস এখন সবাই জানে।

সেই মেয়েটির নাম কৃষ্ণা। কৃষ্ণা রানী সরকার। টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার প্রত্যন্ত পাথালিয়া গ্রামে ওদের বাড়ি। বাবা বাসুদেব সরকার, মা ঝুমু সরকার। গোপালপুর উপজেলার সদর থেকে সাত কিলোমিটার পশ্চিমে পাথালিয়া গ্রাম। গ্রামের সামনে বিস্তীর্ণ ডগাবিলে বর্ষায় উথালপাতাল ঢেউ খেলে। সেই বিলের পাশ দিয়ে চলে গেছে মুশুদ্দি-ঝাওয়াইল সড়ক। সেই সড়কের শতাব্দীপ্রাচীন বটগাছ বাঁয়ে রেখে ১০০ গজ সামনে এগুলেই চারচালা টিনের বাড়ি। তাতে দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট। সেই বাড়িটিই কৃষ্ণাদের।

এ বাড়িকে ঘিরেই এলাকাবাসীর এখন রাজ্যের কৌতূহল আর উচ্ছ্বাস। এ বাড়ির মেয়ে কৃষ্ণা নারী ফুটবলে বিশ্বজয় করেছে। প্রতিদিন খবরের কাগজে ছবি ছাপা হয়। টেলিভিশনের পর্দায় তার হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখা যায়। কৃষ্ণার এ সাফল্যে সেই টিপ্পনী কাটা ছেলেরা আর ছি-ছি করে না। পড়শীরা আর মেয়েকে ফুটবলে মানা করে না। কারণ, তাদের সেই কৃষ্ণা আজ রীতিমতো তারকা।

কৃষ্ণাদের দল এখন রীতিমতো খবর। সদ্য অনুষ্ঠিত এএফসি কাপ বাছাইপর্বে তারাই ইরানকে ৩-০ গোলে, চায়নিজ তাইপেকে ৪-২ গোলে, সিঙ্গাপুরকে ৫-০, কিরগিস্তানকে ১০-০ ও আরব আমিরাতকে ৪-০ গোলে হারিয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়।

খেলায় কৃষ্ণার দল সব মিলিয়ে ২৬ বার প্রতিপক্ষের জালে বল পাঠায়। এর মধ্যে অধিনায়ক ও স্ট্রাইকার কৃষ্ণা একাই করে আটটি।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে চীনে অনুষ্ঠিত হবে অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপ নারী ফুটবল। মূল খেলায় কৃষ্ণারাসহ আটটি দল অংশ নেবে। গত বছরের চার সেমিফাইনালিস্ট উত্তর কোরিয়া, জাপান, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াসহ স্বাগতিক চীনের সঙ্গে খেলবে বাছাইপর্বের চ্যাম্পিয়নরা।

বিশ্বকাপকে লক্ষ্য রেখে বাফুফে বছরব্যাপী কৃষ্ণাদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছে। শক্তিশালী পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে কতটা লড়াই করতে পারে অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে আসা হতদরিদ্র পরিবারের কিশোরী ফুটবলাররা, সেটা দেখতেই মুখিয়ে আছে গোটা বাংলাদেশ। কৃষ্ণাদের জন্য আরো বড় অর্জন সামনে অপেক্ষা করছে, এমনটিই এখন দেশবাসীর প্রার্থনা।

আমি কৃষ্ণাদের প্রতিবেশী গ্রামের বাসিন্দা। এ নিয়ে আমার গর্বের শেষ নেই।

লেখক : সাংবাদিক। বার্তা সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।