দিল্লির নির্বাচন যে কারণে নতুন ধারা তৈরি করতে পারে

Looks like you've blocked notifications!
শশী থারুর। ফাইল ছবি

কাল (শনিবার) দিল্লিতে ভোট হতে যাচ্ছে। এর আগে রাজধানীতে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর  নির্বাচনী প্রচারণা একুশ শতকে ভারতের রাজনীতির ভবিষ্যৎ বোঝার ক্ষেত্রে দিক নির্দেশক হয়ে থাকবে।

গত কয়েক বছর ধরে বলে আসছি, আমাদের রাজনীতি ধর্ম, বর্ণ, ভাষা কিংবা উপ-বর্ণবাদী ধারা থেকে বের হয়ে সেক্যুলার ধারায় ফিরছে। এক সময়ে রুটি, কাপড় নিশ্চিতের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেক্যুলার ধারার যে রাজনীতি শুরু হয়েছিল, বর্তমানে  তা বিদ্যুৎ সরবরাহ, সড়ক নির্মাণ কিংবা পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার দিকে ধাবিত হয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধারা আবর্তিত হবে কম মূল্যে  নাগরিক সুবিধা কিংবা বিনা মূল্যে ওয়াইফাই সুবিধা নিশ্চিতকে কেন্দ্র করে।

নরেন্দ্র মোদির লোকসভা নির্বাচনের প্রচারণা সফলতার মুখ দেখে ভোটারদের টানতে তাঁর প্রথাগত হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতিশ্রুতিতে। মোদির এ সফলতা ভারতের রাজনৈতিক ধারার পরিবর্তন নিয়ে আমার গবেষণাকেই বৈধতা দেয়।

তবে আমাদের রাজনীতিতে বৈপরীত্য সবসময়ই ছিল। চন্দ্রবাবু নাইডু (অন্ধ্র প্রদেশের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী) যেখানে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের মাধ্যমে লোক আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন, সেখানে চন্দ্রশেখর রাও (তেলেঙ্গানা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী) উগ্র স্বদেশিকতাকেই পুঁজি করেছেন। মোদি যেখানে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে উন্নয়নের কথা ভাবছেন, সেখানে অমিত শাহ (বিজেপির সভাপতি) ভোটারদের নিয়মতান্ত্রিক মেরুকরণের মাধ্যমে ধর্মীয় ধারায় এগিয়ে চলছেন।  নিতীশ কুমার ও লালু প্রসাদ যাদব (বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রীদ্বয়) জাত-পাতহীন রাজনীতির যে ধারা   চালু করেছিলেন তাতে ভাটা ফেলেছেন বর্ণকেন্দ্রিক রাজনীতির দুই চর্চাকারী মায়াবতী  ও মুলায়ম সিং যাদব (উত্তর প্রদেশের সাবেক দুই মুখ্যমন্ত্রী)।  তাঁরা দুজন প্রমাণ করেছেন, বর্ণ পরিচয়ের রাজনীতি এখনো টিকে আছে এবং তা ভারতের উত্তরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ অংশে ভালোভাবেই আছে। উত্তর প্রদেশ ও বিহারের বিশাল অংশে লোকজন নিজ জাতেই ভোট দেন।

ভারতের রাজনীতির এ পরিবর্তন সমাজবিজ্ঞানীদের অনুমিত একটি নির্দিষ্ট ধারায় হচ্ছে না। এটি হচ্ছে অনিয়মিতভাবে। এ ধারাবাহিকতায় দিল্লির অবস্থান কোথায়?

এটি বোঝার নির্ধারক হতে পারে দিল্লির নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রধান তিন দলের নির্বাচনী ইশতেহার। বিজেপি, আম আদমি পার্টি (এএপি) ও কংগ্রেসের ইশতেহারে চারটি বিষয় সাধারণ। এগুলো হলো-দুর্নীতির প্রতি জিরো টলারেন্স, বিদ্যুতের দাম কমানো, নারীদের নিরাপত্তা এবং আবাসিক এলাকা ও বাসে ক্লোজড সার্কিট টেলিভিশন (সিসিটিভি) ক্যামেরা স্থাপন।

বিজেপি ও এএপি পানির দাম কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হিসেবে এএপি বাড়ি প্রতি মাসিক সর্বোচ্চ ২০ হাজার লিটার পানি বিনা মূল্যে সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কংগ্রেস তাদের ১৫ বছরের শাসনকালেও এ ধরনের বাস্তবতা বিবর্জিত প্রতিশ্রুতি দেয়নি। তবে কংগ্রেস বলেছে, তারা বসত বাড়িতে বিনা মূল্যে স্যুয়ারেজ লাইনের সংযোগ দেবে।

বিদ্যুৎ একটি সাধারণ প্রতিশ্রুতি। এএপির বিদ্যুতের দাম কমানোর প্রতিশ্রুতির বিপরীতে বিজেপি ও কংগ্রেস বিদ্যুৎ সরবরাহকারী কোম্পানি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সরকারি নথিভুক্ত নয় এমন কলোনিতে থাকা বাসিন্দাদের বসবাসকে বৈধতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিজেপি ও কংগ্রেস, যেটি ছিল গত নির্বাচনে এএপির প্রচারণার অন্যতম হাতিয়ার।

ক্ষমতায় যাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে জন লোকপাল বিল পাস করার ঘোষণা দিয়েছে এএপি। এটি তাদের পুরোনো প্রতিশ্রুতি, ৪৯ দিনের শাসনকালে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবে যা সম্ভব হয়নি। সংগঠনটি একই সঙ্গে গ্রামসভা শক্তিশালী করার আশ্বাস দিয়েছে যা বাস্তবায়ন হলে গ্রামের লোকজন অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। কেজরিওয়ালের এএপি দিল্লিকে ফ্রি ওয়াইফোন জোন করার আশ্বাস দিয়েছে যা বিলাসী হলেও অগ্রসরমান চিন্তা।

কংগ্রেসের পাশাপাশি এএপি রাজধানীতে স্কুল ও কলেজ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষাঋণ দেওয়ারও ঘোষণা দিয়েছে এএপি। কংগ্রেস  ও এএপি দিল্লিকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে এ ব্যাপারে বিজেপির অবস্থান এতটা স্পষ্ট নয়। বিজেপি নয়, এএপি দিল্লিকে উৎপাদনের কেন্দ্র বানানোর ঘোষণা দিয়েছে। ভাবা যায় না, এ ধরনের উদ্যোগ আমাদের শ্বাস নেওয়ার অযোগ্য বাতাসে আরও কী জোগান দেবে।

এসব প্রতিশ্রুতিই কি সামগ্রিক বিষয়ের কথা বলে? অনেক ক্ষেত্রে এগুলো নিছক প্রথা। এটা স্বার্থ আদায়ে ব্যবহার করা হয় যা নির্বাচনের পরই উপেক্ষিত থাকে । ইশতেহারে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণকারীদের রাজনৈতিক কৌশলই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। সে অনুযায়ী কাজ ততটা হয় না।

দিল্লির নির্বাচনী সভাগুলোতে প্রার্থীদের বক্তৃতার সঙ্গে ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতির মিল পাওয়া গেছে। সাংবাদিক ও জরিপকারী সংগঠনের করা বিভিন্ন জরিপ থেকে জানা গেছে, এসব প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন দেখতেই ভোট দেবে দিল্লিবাসী। তবে উদযাপনের সময় এখনো আসেনি। কারণ দিল্লি নির্বাচন পরিচয়কেন্দ্রিক রাজনীতির উত্থান দেখিয়েছে। এ উত্থান গতানুগতিক ধর্ম, বর্ণ, ভাষা কিংবা উপ-বর্ণকেন্দ্রিক ধারায় সীমাবদ্ধ না থেকে তুলনামূলকভাবে শ্রেণীকেন্দ্রিক ধারায় ধাবিত হয়েছে।

বিজেপি হিন্দুত্ববাদী মানসিকতার ভোটারদের টানার চেষ্টা করছে। কংগ্রেস চেষ্টা করছে ভারতের উত্তর প্রদেশের পূর্বাঞ্চল ও দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে আসা লোকদের দলে ভিড়ানোর। কিন্তু এ দুই ধারার ভোটার দিল্লির খুব কম সংসদীয় আসনেই আছে। বৃহত্তর আবেদন তৈরি করবে ‘সাধারণ লোকজন’, ভারতের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে  এক সময় যাদের দলে ভিড়ানোর বৃথা চেষ্টা করেছিলেন কমিউনিস্টরা। সাদামাটা প্যান্ট, সোয়েটার ও মাফলার পরা (যা গতানুগতিক সাদা খদ্দর পরা রাজনীতিকদের পোশাক থেকে ভিন্ন) অরবিন্দ কেজরিওয়াল সুবিধাভোগী শ্রেণীর বিপরীতে সেই উপেক্ষিত লোকজনের পক্ষে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। তাই সুতির শাড়ি ও রাবারের চপ্পল পরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী) তাঁর (কেজরিওয়াল) পক্ষে দাঁড়ালে অবাক হওয়ার কিছু থাকে না।

এই যুদ্ধে (দিল্লির নির্বাচন) প্রতিষ্ঠিত পুরোনো ধারার ধারক-বাহক বিজেপি-কংগ্রেসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে এএপি। সংগঠনটি বার্তা দিচ্ছে, ক্ষমতায় গেলে প্রান্তিক মানুষের আরও নিচু হওয়ার ঝুঁকি কমাবে।

 

শশী থারুর ভারতের সাবেক ক্ষমতাসীন দল কংগ্রেসের রাজনীতিক। তিনি কেরালা রাজ্যের থিরুভানাথাপুরাম থেকে দুই বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কংগ্রেস সরকারের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। দিল্লির নির্বাচন নিয়ে তাঁর লেখা নিবন্ধটি গতকাল শুক্রবার এনডিটিভির মতামত কলামে ছাপা হয়।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন আজহারুল ইসলাম