নতুন রস
হরতালের আত্মকথা
সবার দুঃখ-কষ্টের কথা লেখা হলেও আমার কষ্টের কথা কেউ লেখে না, কেউ বলে না। আমাকে ডাক দিলে সাংবাদিক ভাইবোনেরা আগাম প্রস্তুতি নেয় আমি কতটা দেশ জাতি ও মানুষের ক্ষতি করলাম তা লেখার জন্য । ফটো সাংবাদিক ও টিভি ক্যামেরাম্যানরা ওত পেতে ক্যামরা তাক করে বসে থাকে আমার ডাকে কতটি গাড়ি ভাঙচুর হলো, কতটা গাড়ি পুড়ল আর কজন মানুষ রাজপথে প্রাণ দিল, অগ্নিদগ্ধ হলো কিম্বা গুলিবিদ্ধ হলো তার ছবি তোলার জন্য। আমাকে সফল করতে রাজপথে নেমে কতজন পুলিশি পিটুনি খেল, কতজন গ্রেপ্তার হলো কোনো কিছুই বাদ যায় না সাংবাদিক ভাইদের লেখনি থেকে। সবার দুঃখ কষ্টের কথা লেখা হলেও আমার কষ্টের কথা কেউ লেখে না, কেউ বলে না । আমার ভিতরে কত যে কষ্ট কত যে যন্ত্রণা রয়েছে তা কেউ বোঝে না। কেউ জানতেও চায় না সে সব যন্ত্রণার কথা। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি নিজের কষ্টের ঢোল নিজেই বাজাব। অন্যের হাতে দিতে চাই না, দিলে আমার ঢোলটি যদি ফাঁটিয়ে ফেলে! শুনুন আমার কষ্টের মর্মস্পর্ষী কথাগুলো।
ব্রিটিশ শাসনামলে আমার নাম ছিল ‘বন্দ’। ব্রিটিশ বেনিয়াদের পাক-ভারত উপমহাদেশ থেকে তাড়ানোর জন্য তখন আমাকে ডাক দিতেন গান্ধিজী এবং তার অনুসারীরা। তখন আমার কী যে আনন্দ হতো তা বলে বুঝাতে পারব না। আমাকে ডাকলে গোটা ভারতবর্ষ অচল হয়ে যেত। আমার সম্মান এবং মর্যাদা ছিল অন্যরকম। অত্যাচারি নীলকর শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার করতে আমাকে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হতো। সে সময় আমাকে ডাকা হতো দেশ-জাতি ও মানুষের স্বাধীনতা ও সুখ শান্তির জন্য। সে সময় আমাকে ডাকতেন দেশবরেণ্য দেশপ্রেমিক নেতারা । তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন,গান্ধিজী, জওহরলাল নেহেরু,নেতাজী সুভাষ বোসু, মাওলানা আকরাম খান, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকসহ আরো অনেকে। যাঁরা ছিলেন দেশ-জাতি ও মানুষের আশীর্বাদ । নেতাদের দেশপ্রেম আর আমার কারণে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ব্রিটিশ বেনিয়ারা ভারত ছাড়তে বাধ্য হয়। পাক-ভারত উপমহাদেশ ভাগ হয়ে যায় দুটি খণ্ডে। জন্ম হয় ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি দেশের। পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব-পাকিস্তান মিলে সৃষ্টি হয় পাকিস্তান। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচি। চিন্তা ভাবনা করতে থাকি অবসরে যাওয়ার। কিন্তু না ।
১৯৪৮ সাল থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ব্রিটিশ বেনিয়াদের মতো পূর্ব-পাকিস্তানে শোষণ-নির্যাতন চালানো শুরু করে। এ দেশের সম্পদ লুটপাট করে নিয়ে যেতে লাগল পশ্চিম পাকিস্তানে। প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে বসানো হলো উর্দুভাষী পাকিস্তানিদের। শোষণ-বঞ্চণার শিকার হতে লাগল পূর্ব-পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষ। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাষানী তুখোড় ছাত্র নেতা শেখ মুজিবর রহমান পাক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। সংগঠিত করতে লাগলেন দেশের জনগণকে। স্বৈরশাসকের ভিত কাঁপাতে আবার প্রয়োজন পড়ল আমাকে। বদলে ফেলা হলো আমার নাম। ‘বন্দ’ থেকে হয়ে গেলাম ‘হরতাল’। ১৯৫২ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নুরুল আমীন বাঙালির ঐতিহ্য বাংলা ভাষাকে ধ্বংস করার এক নীল নকশা হিসেবে ঘোষণা দিলেন ‘ উর্দু উইলবি স্টেট ল্যাঙগুয়েজ অব পাকিস্তান’ গভর্নর নুরুল আমীনের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে রোষে ফেঁটে পড়ল বাঙালিরা। সিদ্ধান্ত হলো ২১ ফেব্রুয়ারি আমাকে ডাকার। আনন্দের বন্যা বয়ে গেল আমার মাঝে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি । সারা দেশ উত্তাল । ভাষা আন্দোলনের নামে রাজধানীর রাজপথ মুখরিত হলো পাক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে। কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতা ভোর থেকে রাজপথ দখল করে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে লাগল। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ মুহুর্মুহু স্লোগান দিয়ে প্রকম্পিতি করেছিল রাজপথ । ভিত কেঁপে উঠে স্বৈরশাসকের। অবস্থা বেগতিক দেখে নিরীহ ছাত্রনেতাদের ওপর গুলি চালায় পাক-স্বৈরশাসক। সে দিন রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল সালাম, জব্বার, রফিকসহ বেশ কয়েকজন ছাত্র নেতার রক্তে। স্বাধীনতার ভিত রচিত হয়েছিল মূলত বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি । দেশের স্বাধীনতা আনতে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান কতবার জেলে গেছেন তার হিসাব আমার কাছে নেই তবে বলতে পারি যতবার তিনি জেলে গেছেন ততবারই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আমাকে ডাকা হয়েছে।
বাংলাকে ভালোবেসে নিজের জীবনকে উৎস্বর্গ করার জন্য দেশবাসী শেখ মুজিবকে উপাধি দিয়েছিল ‘বঙ্গবন্ধ’। স্বৈরচারের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু আমাকে ডাক দিলে স্বতঃস্ফূর্ত পালিত হতাম আমি। আমিই ছিলাম রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রধান হাতিয়ার। আমার কথা শুনলে ভয়ে কেঁপে উঠত পাক-স্বৈরশাসক। আমি আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠতাম। আমার কারণে জেল থেকে বঙ্গবন্ধুকে বারবার ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল পাক-স্বৈরশাসক। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন , জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ডাকে একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলন সবখানেই ছিলাম আমি। রাজনৈতিক দল ও নেতাদের কাছে আমার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
নব্বইয়ের স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আমার অবদান কমছিল না। আমার কারণে লৌহমানব খ্যাত এরশাদ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন । আমার জন্য ১৯৯৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটার বিহীন নিবার্চন বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিলেন খালেদা জিয়া। সে সময় আমাকে লাগাতার ডাক দেওয়া হয়েছিল।
আমি খুব খুশি হয়েছিলাম ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু তনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনা কুষ্টিয়ার কুমারখালীর জনসভায় যখন ভাষণ দিলেন এই বলে যে, ‘আমরা ক্ষমতায় না থাকলেও আর কোনো দিন হরতালের ডাক দিব না।’ সে দিন আমি যে কত খুশি হয়েছিলাম তা বলে বুঝাতে পারব না। আমাকে ডাকলে সুযোগ সন্ধানীরা সুযোগ পায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় নিরীহ মানুষ। অচল হয়ে যায় দেশের অর্থনীতির চাকা। দেশ স্বাধীনের পর আমাকে ডেকে দেশের যে ক্ষতি করা হয়েছে তা কল্পনারও বাইরে। আমার মনে হয় আমাকে না ডাকলে বাংলাদেশ এত দিন উন্নত বিশ্বের কাতারে গিয়ে দাঁড়াত। যাইহোক যা বলছিলাম।
জননেত্রীর ঘোষণায় আমি আশস্ত হয়েছিলাম এই ভেবে যে এবার বোধ হয় আমাকে বাতিল করার জন্য জাতীয় সংসদে তিনি বিল উত্থাপন করবেন, কিন্তু না। জননেত্রী কথা রাখলেন না। এরপর পটপরিবর্তন হলো ক্ষমতার । স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমতার হালুয়া-রুটি দিয়ে সমঝোতার মাধ্যমে ক্ষমতায় এলো জামায়াত-বিএনপি জোট। স্বাধীন বাংলার পতাকা শোভা পেল স্বাধীনতাবিরোধীদের গাড়িতে। কষ্ট পেলেও আমার করার কিছুই ছিল না । বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ বিভিন্ন কর্মসুচি নিয়ে মাঠে নেমে ব্যর্থ হয়ে আবারও ডাক দিল আমাকে। সুযোগ পেয়ে বিটিভি জননেত্রী শেখ হাসিনার কুমারখালীর সেই ভাষণ ‘আমরা ক্ষমতায় না থাকলেও আর কোনো দিন হরতালের ডাক দিব না।’ বারবার প্রচার করতে লাগল। আমি লজ্জা পেলেও উনারা ভ্রুক্ষেপ করলেন না। বারবার ডাকলেন আমাকে। জ্বালাও পোড়াও, নারী আন্দোলনকারীদের রাজপথে পুলিশি নির্যাতন, আর নিরীহ মানুষ খুন দেখতে দেখতে আমি হাফিয়ে উঠলাম। আবারও ক্ষমতার পট পরিবর্তন হলো ।
ক্ষমতায় এলো স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন আওয়ামী লীগ। বিরোধী দল বিএনপি-জামায়াত মিলে ভোট চুরির অভিযোগে বারবার ডাক দিল আমাকে। আমাকে ডাকার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে লাগল দেশ। আমাকে কেন আইন করে বাতিল করা হলো না এই ভেবে দুঃখ পেতাম। কিন্তু কে শোনে কার কথা। কারণ ক্ষমতা থেকে কাওকে টেনে হিছড়ে নামাতে হলে তো আমাকেই প্রয়োজন । রাজনৈতিক দলগুলোর সহিংস ঘটনার কারণে সৃষ্টি হলো ১/১১ -এর মতো একটি অধ্যায়। রাজনৈতিক নেতাদের ভুলের মাশুল দিতে হলো দেশের জনসাধারণকে।
২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারী সংবিধান সমুন্নত রাখতে ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করল বর্তমান সরকার। বিরোধী দল উঠে পড়ে লাগল ওই নির্বাচন বাতিল করার জন্য। শুরু হলো আন্দোলন। প্রথমে ডাকা হলো আমার ছোট ভাই ‘অবরোধ’কে । তাতে যখন কোনো কাজ হলো না তখন অবরোধের সাথে ডাকা হলো আমাকে। এবার আমাকে চাঙা করার জন্য তৈরি করা হলো প্রেট্রোলবোমা । যা আগে কখনো শুনিনি। যানবাহনে পেট্রোলবোমা ছুঁড়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হলো শত শত গাড়ি। আগুনে পুড়ে নিহত হলো শিশু নারীসহ শতাধিক মানুষ । আহত হলো কয়েক হাজার। ক্ষতি হলো লাখ হাজার কোটি টাকা।
এরপরও আমাকে বাতিল করার কোনো উদ্যোগ নেই। আমি সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাই তখন; যখন যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবির আমাকে ডাক দেয়। এই স্বাধীন দেশে ওরা কেন আমাকে ডাকবে? ওরা আমাকে ডাকার কারণে দেশের মানুষ কেন বলির পাঠা হবে। এ সব ভেবে মাঝে মধ্যে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করে। কিন্তু পারি না। তবে মাঝে মধ্যে আশ্বস্ত হই এই ভেবে যে, আমার কারণে প্রভাবশালী মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী জেলে, তসলিমা নাসরিন পরবাসে। আমাকে ডাকলে পুলিশ ভাইদের ইনকাম বেড়ে যায়, কিন্তু এর পরও আমার শান্তি নেই। কারণ এখন আমাকে আর কেউ মানছে না। আগে আমাকে ডেকে মাঠে থাকতেন নেতা-কর্মীরা । স্লোগান দিতেন ‘গাড়ির চাকা ঘুরবে না-দোকান পাট খুলবে না’। আমি পালিত হতাম স্বতস্ফূর্তভাবে। এখন আমাকে ডাকা হয় গোপনে থেকে টেলিভিশনে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে। রাজপথে থাকে না নেতা-কর্মীরা। শুনি আমাকে ডেকে ঘরে বসে ভুনা খিচুড়ি-গোস্ত খায়। দিন আনি দিন খাই- এ ধরনের মানুষের কি যে কষ্ট হয় ওরা তা বুঝতে চায় না। একদল চায় ক্ষমতায় থাকতে, আরেক দল চায় ক্ষমতা থেকে নামাতে। নেতা-কর্মীরা এখন পুলিশের প্যাদানির ভয়ে থাকে গা-ঢাকা দিয়ে। গাড়িচালকরা পান চিবুতে চিবুতে আমাকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে রাজপথ ধরে চলে যায় গন্তব্যে। লজ্জায় আমার মাথা কাটা যায়। আমার ইজ্জত-সম্মান বলে কিছুই বাকি নেই আর । কেউ আর আমাকে মানছে না। মানবেই বা কেন? দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য যদি আমাকে ডাকা হতো তা হলে সবাই আমাকে মানত । এখন আমাকে ডাকা হচ্ছে ক্ষমতায় যাওয়া জন্য। যে কারণে কেউ আমাকে মানছে না। আমি চরম লজ্জিত,অপমানিত, আমি ক্লান্ত পরিশ্রান্ত,। লেজে-গোবরে অবস্থা আমার। আমি সবার কাছে মাফ চাই। প্লিজ আমাকে ডেকে আর দেশের মানুষের সর্বনাশ করবেন না।
ভেবে দেখুন আমার কারণে দেশের কতটা ক্ষতি হয়েছে। আজ আর আমার কোনো মর্যাদা নেই। তাই দেশবাসীর কাছে আমার শেষ আবেদন আমার ইজ্জত থাকতে থাকতে আমাকে আইন করে বন্ধ করার জন্য সবাই মিলে আর একবার আমাকে অর্থাৎ ‘হরতালের ডাক’ দিন।
শামসুল আলম স্বপন : সম্পাদক, বিজয়নিউজ২৪ডটকম