আওয়ামী লীগের সম্মেলন

নির্বাচনের হিসাবনিকাশ

Looks like you've blocked notifications!

আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনকে ঘিরে নানা গুঞ্জন আর গুজবের কানাঘুষার অবসান ঘটিয়ে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন ওবায়দুল কাদের। সভাপতির পদ সম্পর্কে অবশ্য সম্মেলনের আগে থেকেই নতুন নেতৃত্ব খুঁজে নেওয়ার জন্য দলের সভানেত্রী বারবার আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন। তবে তাঁর বিকল্প এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগে তৈরি হয়নি তা শুধু স্তুতির জন্য নয়, দলের নেতাকর্মীরা সেটা মনে-প্রাণেই বিশ্বাস করে। তাই সভাপতি যে বঙ্গবন্ধুকন্যা হবেন তা নিয়ে কারো দ্বিধা থাকার কোনো সুযোগ নেই।

আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে তাই শেষ পর্যন্ত বড় চমক হিসেবে ধরা হচ্ছিল সাধারণ সম্পাদকের পদটি কে অলঙ্কৃত করছেন। দলের দুঃসময়ের অন্যতম কাণ্ডারি সৈয়দ আশরাফকে ঘিরে বরাবরই রহস্য ঘিরে থেকেছে, যাঁকে নিয়ে দলের নেতাকর্মী থেকে সাধারণ মানুষ, মিডিয়া সবারই দারুণ আগ্রহ। তিনি কথা বলেন কম, মিডিয়া থেকে দূরে থেকেছেন আরো বেশি, কিন্তু দলের প্রতি কিংবা সাংগাঠনিক কাজের প্রতি তার দায়িত্বজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাহস পায়নি তাঁর নিন্দুকেরাও। কিছুদিন থেকেই কানাঘুষা চলছিল এবারে সাধারণ সম্পাদক থাকছেন না সৈয়দ আশরাফ। তাঁর জায়গায় আসছেন সাবেক ছাত্রনেতা ওবায়দুল কাদের। খোদ ওবায়দুল কাদেরই এমন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন সম্মেলনের আগেই।

যদিও বিষয়টি হজম করতে পারেনি সাধারণ মানুষ। সবার মনেই দোলাচল ছিল সৈয়দ আশরাফের বিকল্প কি আর কেউ হতে পারে? কিংবা ১/১১-এর সময় থেকে যেভাবে দলকে আকড়ে থেকে অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় আজকের সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী দল হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন আওয়ামী লীগকে, শুধু তাই নয়, যখন আওয়ামী লীগের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আগামী নির্বাচনে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে নিয়ে আসা সেই সময় সৈয়দ আশরাফের এই গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরে যাওয়া খুব বেশি সাহসী পদক্ষেপ হয়ে গেল কি না? তবে দিনে দিনে রাজনীতিতে ক্যারিশমেটিক হয়ে ওঠা বঙ্গবন্ধুকন্যা অনেক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই কাজটি করেছেন, সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি। আগে নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের প্রসঙ্গটাতে একটু আসি।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদপ্রাপ্তিকে নিজের ‘পরিশ্রমের পুরস্কার’ এবং রাজনীতিবিদ হিসেবে ‘জীবনের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি’ হিসেবে দেখছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী এবং সাবেক ছাত্রনেতা ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কাছ থেকে তাঁর নামের প্রস্তাব আসাই ছিল এবারের সম্মেলনের বড় চমক। কাদের বলেন, সদ্য বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সাত বছরের অভিজ্ঞতা ও সুচিন্তিত দায়িত্ব পালন তাঁকে এই দায়িত্বে ‘অনুপ্রেরণা জোগাবে’। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বিরূপ সময়ে ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করা ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমি আমার পরিশ্রমের পুরস্কার পেয়েছি। আমি আমার রাজনীতির জীবনের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি পেয়েছি। শেখ হাসিনা সর্বোচ্চ স্বীকৃতি আমাকে দিয়েছেন।’ আর সৈয়দ আশরাফ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের রাজনীতির মোটিভ এটাই যে আমাদের মধ্যে কোনো বিষয়ে মতান্তর হতে পারে, তবে মনান্তর হবে না।’

ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাঁর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে আগামী দিনে তিনটি এজেন্ডা নিয়ে আওয়ামী লীগকে এগিয়ে নেওয়ার কথা বলেন। প্রথম এজেন্ডা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জঙ্গিবাদকে পরাজিত করা, পরাভূত করা, পরাহত করা। দ্বিতীয় এজেন্ডা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা পরবর্তী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার যে ডাক দিয়েছেন, সে অনুযায়ী শক্তিশালী ‘টিমওয়ার্ক’ গড়ে তোলা, তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত গণসংযোগ দৃঢ় করা। জনগণের কাছে। আরো ‘গ্রহণযোগ্য’ হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ‘আচরণ পরিবর্তন’ করার কথাও বলেন নতুন সাধারণ সম্পাদক। তৃতীয় এজেন্ডা আওয়ামী লীগের ভিশন ২০২১ বাস্তবায়ন।

ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ওবায়দুল কাদের দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। তিনি ২০০২ সালের সম্মেলনে দলের ১ নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০০৯ ও ২০১২ সালে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। নোয়াখালী অঞ্চল থেকে নির্বাচিত এই সংসদ সদস্য বর্তমানে সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন। নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদকের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মেয়াদ আরো থাকলেও নির্বাচনের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েই ভাবা হচ্ছে তার ইঙ্গিত প্রধানমন্ত্রী এবং দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনার সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যেই পরিষ্কার হয়ে উঠে। তিনি দেশের উন্নয়ন ও পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে আওয়ামী লীগকে তৃতীয় দফা নির্বাচনে জয়ের লক্ষ্যে দলীয় নেতাকর্মীদের প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি দলের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেন তৃতীয় দফা নির্বাচনে জয়লাভ করতে হলে জনগণের দোরগোড়ায় যেতে হবে। উন্নয়নের কথা বলতে হবে। ব্যাপক প্রচার করতে হবে। জনগণকে বোঝাতে হবে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হবে।

এসব বিষয় ছাড়াও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালনের কাজ আরো সহজ হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। মন্ত্রণালয়ের কাজের কারণেই এখন তাঁর তৃণমূলে পৌঁছে সরকারের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দলের সমস্যা মেটানো সহজ হবে। এদিকে দলের নেতাকর্মীর কাছে শেখ হাসিনা তাদের আস্থা-বিশ্বাসের জায়গায় পুরনো হলেও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নতুন করে দায়িত্ব পালন করতে এসেছেন ওবায়দুল কাদের। তাই নতুন সাধারণ সম্পাদকের কাছে তাদের দাবি, তিনি শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করে দলকে আরো সুসংগঠিত করবেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে আবারও দলের বিজয় নিয়ে আসবেন। সভানেত্রীর বক্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে, আগামী নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন উঠুক—আওয়ামী লীগ সেটা চাইছে না। এখন থেকেই তাই মাঠের রাজনীতিতে জোর দিয়ে আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে দলটির ২০তম জাতীয় সম্মেলনে। তাঁর বক্তব্যেই আছে, ‘আমি কখনোই চাইব না, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠুক।’

মেয়াদের মধ্যভাগ পার হওয়ার পর গণতন্ত্রের ঘাটতি পূরণের বিষয়টিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। তারা চাইছে সুবিধাজনক অবস্থানে থেকেই নিজেদের শেকড় আরো পাকাপোক্ত করতে। কারণ, এখন বিদেশিদের কাছে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। দেশের বৃহত্তম বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে কোনঠাসা করে দিতে পেরেছে সরকার। বিএনপির রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলামীও প্রায় নিষিদ্ধ । সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি থাকা না থাকা এখন সমান। বাম দলগুলো অনৈক্য ও বিভ্রান্তির জালে ঘুরপাক খাচ্ছে এবং তাদের ওপর জনগণের আস্থাও তলানিতে ঠেকেছে।

রোববারের দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতামত হচ্ছে, উন্নয়ন, বৈদেশিক অনুদান ও ঋণপ্রাপ্তির চমক দেখানোর পর নিজের ওপর সরকারের আস্থা অনেকটাই বেড়েছে। এখন সরকারি দল আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের ঘাটতি দূর করতে চায়। মধ্যবর্তী, আগাম বা জাতীয়—যে নির্বাচনই হোক, সেটি করে গত নির্বাচনের বদনাম মুছে ফেলতে চায়। এদিকে বিএনপিকে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। তবে দলটি বেশ অগোছালো অবস্থায় রয়েছে। সরকার যেহেতু দেখেছে বিরোধী দল দুর্বল, তখনই সেই সময়টিকে মোক্ষম মনে করে নির্বাচন দিয়ে থাকে আর সেই পথেই হাঁটছে আওয়ামী লীগ। এদিকে প্রায় আট বছর ক্ষমতায় থাকায় দলের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বিত্তবান ও প্রভাবশালী নেতার সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে অভ্যন্তরীণ কোন্দলও। নানা সমস্যা জর্জরিত তৃণমূলের বেশির ভাগ কমিটি। যদিও সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নেতৃত্বেই দলের অনেক জেলায় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তারপরও অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিয়ন্ত্রণ করতে পারাটা এখন নতুন সাধারণ সম্পাদকের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটি গঠিত হয়েছে ২০১৯ সালের নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে। কিন্তু নির্বাচনটি কীভাবে হবে, নির্বাচন কমিশন কীভাবে গঠিত হবে, সে সম্পর্কে দলের ঘোষণাপত্র কিংবা শীর্ষ নেতাদের বক্তৃতায় স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। অথচ আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হওয়ার পর এ ধরনের একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের পুরো দায় তাই ক্ষমতাসীনদের ওপরই। আওয়ামী লীগের নতুন নেতৃত্ব এই চ্যালেঞ্জ কীভাবে গ্রহণ করেন সেটাই এখন দেখার বিষয়।

সব শেষ হয়েও কেন যেন শেষ হচ্ছে না। কারণ সৈয়দ আশরাফের প্রতি দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিশ্বাস এবং নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে কারো কোনো সন্দেহ নেই। নেত্রী তাঁর বক্তব্যেও সেই কথা জানিয়েছেন বারবার। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করেই সৈয়দ আশরাফকে এই পদ থেকে সরিয়ে নিলেন কারণ আগামী নির্বাচনে জয়ী হওয়ার ছক তিনি এখনই কাটছেন। বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ২০১৮ সালের এপ্রিলে, সেই বিষয়টিও নিশ্চয় নেত্রীর মাথায় রয়েছে।

লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ