সীমান্ত চুক্তি

শেষ হয়েও হলো না শেষ

Looks like you've blocked notifications!
ড. আবদুল লতিফ মাসুম।

‘লেট বেটার দেন নেভার।’ সুদীর্ঘ ৪২ বছরের জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা, অবশেষে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত চুক্তি ভারতীয় পার্লামেন্টে অনুসমর্থিত হয়েছে। প্রথমে রাজ্যসভা এবং পরে লোকসভা—উভয় সংসদে একরকম সর্বস্মতিক্রমে চুক্তিটি সমর্থিত হয়। স্মরণ করা যেতে পারে, দুই প্রতিবেশী দেশের সীমান্ত আরো সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে ১৯৭৪ সালের ২৬ মে বাংলাদেশের তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ওই বছরই বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ চুক্তিটি অনুসমর্থন করলেও ভারত তা করেনি। ফলে দুই দেশের সীমান্ত সমস্যা অমীমাংসিত থেকে যায়। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর চুক্তিটি যাতে বাস্তবায়িত না হতে পারে, সে জন্য কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ফরোয়ার্ড ব্লক-এর কেউ একজন কলকাতা হাইকোর্টে মামলা ঠুকে দেয়। মামলাটি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। ১৯৯০ সালে প্রদত্ত রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলে দেন, চুক্তি বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধনের দরকার নেই। শুধু পার্লামেন্টের অনুমোদন হলেই চলবে। কিন্তু কংগ্রেস সরকার সম্ভবত রাজনৈতিক ঝুঁকি এড়ানোর জন্য সংবিধান সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেয়। আইনগতভাবে ভারতের অবিচ্ছেদ্য কোনো অংশ সমর্পণে সংবিধান সংশোধন দরকার। কিন্তু বিরোধপূর্ণ ছিটমহলগুলো কখনই ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল না। যা হোক, ভারতের কোনো সরকারই চুক্তিটি বাস্তবায়নে অগ্রসর হয়নি। এমনকি শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে মনমোহন সরকারের সখ্য যখন তুঙ্গে, তখনো এটা স্বাক্ষরিত হয়নি। এ জন্য অবশ্য কংগ্রেস সরকারকে এককভাবে দায়ী করা যায় না। আজকের ক্ষমতাসীন বিজেপি তখন চুক্তিটি অনুসমর্থনের বিরোধিতা করে। তাহলে সহজেই বোঝা যায়, এর সঙ্গে রাজনীতির কার্যকারণ সূত্র রয়েছে।

এটা মনে করার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এটা একক কৃতিত্ব। যেকোনো চুক্তি বা পররাষ্ট্র সম্পর্ক একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ার ফসল। আজকে স্বাক্ষরিত ভারত-বাংলাদেশ চুক্তির ভিত্তি রচিত হয় ১৯৫৮ সালে স্বাক্ষরিত নুন-নেহরু চুক্তিতে। ওই সময়ে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের কট্টরপন্থীদের বিরোধিতা সত্ত্বেও চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশের বিগত সব সরকার ওই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সব সময়ই চেষ্টা করে গেছে। ১৯৮২ সালে এরশাদ সরকার এবং ১৯৯২ সালে খালেদা জিয়া সরকার স্থলসীমান্ত চুক্তি অগ্রায়নে চেষ্টা করে। ২০১১ সালে শেখ হাসিনা সরকার মনমোহন সরকারের সঙ্গে এ সম্পর্কিত একটি প্রটোকল সই করে। এটা একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় যে, কথিত একটি হিন্দুত্ববাদী সরকারের আমলে এই চুক্তি চূড়ান্ত হতে যাচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, মোদি সরকার দৃশ্যত তাদের রাজনৈতিক মিত্রতার আড়ালে ভারতের অনুকূলে একটি পারিপার্শ্বিক আবহাওয়া তৈরি করতে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, এই চুক্তি অনুসমর্থনের আগে কংগ্রেসশাসিত আসামের সম্মতি আদায় করা হয়। চুক্তিটি পাস করতে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। সুষমা স্বরাজ বলেন, ‘এই বিল পাস করানো না গেলে প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে গড়ে ওঠা সুসম্পর্ক ধাক্কা খেতে পারে। বাংলাদেশের সহযোগিতার জন্যই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল শান্ত রয়েছে। তা ছাড়া বিলটি পাস হলে আসামের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার কাজ শেষ করা যাবে। এতে করে সীমান্তে অনুপ্রবেশ সমস্যা সমাধানের পথ সহজ হবে।’ বিলটি পাসের আগে রাজ্যসভা ও লোকসভা উভয় ক্ষেত্রেই কট্টরপন্থীরা বাংলাদেশ থেকে অব্যাহত অনুপ্রবেশ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা দাবি করে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, চুক্তিটি বাস্তবায়িত হলেই কেন্দ্রীয় সরকার আসামে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ শুরু করবে। চুক্তিটি স্বাক্ষরে ভারত সরকারের গরজ যে সবটাই ইতিবাচক নয়, তা সুষমা স্বরাজের বিবৃতিতে স্পষ্ট। এত সব রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং মন্তব্য সত্ত্বেও বাংলাদেশের মানুষ সামগ্রিকভাবে চুক্তিটি স্বাগত জানিয়েছে। বিরোধী নেত্রী বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নরেন্দ্র মোদিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। ভারতবিরোধী বলে পরিচিত জামায়াতে ইসলামী চুক্তিকে অভিনন্দিত করেছে। ওদিকে কথিত মৌলবাদীদের অনুমোদন এবং এদিকে মৌলবাদীদের অভিনন্দন প্রমাণ করে যে, অসম সহযোগিতা অসম আদর্শে সহাবস্থান একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা।

চুক্তিটি বাস্তবায়ন দেখতে উভয় দেশেই বিশেষত, ছিটমহলগুলোতে স্বস্তির মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে। তবে উভয় দেশের ছিটমহলবাসীর জমিজমার মালিকানা দ্বন্দ্বও রয়েছে। এর পরও উত্থিত আশাকে আশঙ্কায় পরিণত করার জন্য সাম্প্রদায়িকতার আদলে ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের মহড়াও দৃশ্যমান। ছিটমহল বিনিময়ের আগে সেখানকার আইনশৃঙ্খলা জোরদার করতে বাংলাদেশকে অনুরোধ জানিয়েছে ভারত সরকার। রাজ্যসভা ও লোকসভায় সর্বসম্মতিক্রমে সীমান্ত চুক্তির বিলটি পাস হওয়ায় স্থলসীমান্ত চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে এখন আর বড় কোনো বাধা নেই। তবে ভারতের সংবিধান অনুযায়ী, এই চুক্তির প্রতি ৫০ শতাংশ প্রদেশ বা রাজ্য বিধানসভার অনুমোদন প্রয়োজন। তাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাজ্য বিধানসভাগুলোর অনুমোদন নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করবে। এ প্রক্রিয়া শেষ করতে অন্তত ছয় মাস সময় লাগবে। চুক্তি বাস্তবায়নে আরেকটি তাৎক্ষণিক অসুবিধা বর্ষাকাল। জুন থেকে আগস্ট—এ সময়টা বাংলাদেশে ও ভারতের পূর্বাঞ্চলে বর্ষাকাল। এ ক্ষেত্রে ছোটখাটো আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে আরো কিছু সময় লাগতে পারে। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মনে করেন, ভারতের সংসদে সীমান্ত বিল পাস হওয়ার পর ছিটমহল বিনিময়, অপদখলীয় জমি হস্তান্তর ও ৬ দশমিক ১ কিলোমিটার সীমানা চিহ্নিত করার আনুষ্ঠানিকতা কীভাবে হবে, তা দুই দেশ আলোচনা করে ঠিক করবে। তবে উভয় সরকার এ ব্যাপারে পূর্বপ্রস্তুতি বজায় রেখেছে।

অনুমোদিত ভারত-বাংলাদেশ চুক্তির একটি বড় ব্যর্থতা হলো, বহুল কথিত তিনবিঘার সার্বভৌমত্ব বাংলাদেশকে প্রদান না করা। বলা হচ্ছে, সম্পাদিত চুক্তির প্রভাব তিনবিঘা করিডোরের ক্ষেত্রে কার্যকর হবে না। ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির একটি অংশ ছিল তিনবিঘা করিডোর হস্তান্তরের বিষয়টি। এ চুক্তি অনুযায়ী, ছিটমহল বিনিময় কার্যকর হওয়ার পর তা থেকে সুনির্দিষ্টভাবে আঙ্গরপোতা-দহগ্রাম ও বেরুবাড়ীকে বাইরে রেখে এর জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা হয়। সে ব্যবস্থা অনুসারে বাংলাদেশ ৭ দশমিক ৩৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দক্ষিণ বেরুবাড়ীর সার্বভৌমত্ব ভারতের কাছে হস্তান্তর করবে। আর দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার অবাধ চলাচলের জন্য ভারত ১৭৮ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৫৮ মিটার প্রস্থের তিনবিঘা করিডোরের সার্বভৌমত্ব বাংলাদেশকে হস্তান্তর করবে। বাংলাদেশ মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে বেরুবাড়ী ভারতের কাছে হস্তান্তর করে দেয়। কিন্তু ওই সময়ে ভারত বাংলাদেশকে তিনবিঘা করিডোরের মালিকানা হস্তান্তর করেনি। মাঝখানে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির ব্যতিক্রম ঘটিয়ে বাংলাদেশ দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার অধিবাসীদের কষ্ট লাঘবের জন্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা মেনে নেয়। এ ব্যবস্থাধীনে ২০১১ সালে ভারত ৯৯ বছরের জন্য তিনবিঘা বাংলাদেশকে লিজ দেয়। স্বাভাবিকভাবেই লিজ মানে চিরস্থায়ী অধিকার বা সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা নয়। এখন তিনবিঘা করিডোর চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকলেও ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের সতর্ক নজর থাকে বাংলাদেশিদের ওপর। তাদের কড়া নজরদারিতে স্বাভাবিকভাবে মূল ভূখণ্ডে যাতায়াতে সন্ত্রস্ত থাকে বাংলাদেশিরা। সীমান্ত চুক্তি কার্যকর হওয়ার পর দুই দেশের অবরুদ্ধ ছিটমহলবাসী এক ধরনের অন্তরীণ অবস্থা থেকে মুক্তি পেলেও ওই মুক্তির স্বাদ পুরোপুরি পাবে না লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার ২৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার প্রায় ২০ হাজার মানুষ। ২০১০ সালে তিনবিঘা করিডোরে বাংলাদেশিদের জন্য অবাধ যাতায়াত নিশ্চিত করার জন্য একটি ওভারব্রিজ নির্মাণের অনুরোধ করে বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশবিরোধী শক্তির দাপটে ভারত সরকার সে অনুমতিও দেয়নি। সেখানে বাংলাদেশের সামরিক যাতায়াতও নিষিদ্ধ। সাম্প্রতিক অনুমোদিত চুক্তির ধারাবাহিকতা অনুযায়ী তিনবিঘার ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা জাতীয় স্বার্থে জরুরি। সে লক্ষ্যে উভয় দেশ যদি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তা দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরো জোরদার করবে।

চার দশকের বেশি সময় কেটে যাওয়ার পর মোদি সরকার কর্তৃক মুজিব- ইন্দিরা চুক্তির অনুসমর্থন নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক ঘটনা। নিপাতনে সিদ্ধ এই ঘটনা আবার প্রমাণ করল, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কোনো কথা নেই। মোদি সরকারের এই সদিচ্ছা বাংলাদেশের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়েও সম্প্রসারিত হবে বলে বাংলাদেশের জনগণ আশা করে। তবে কেবল কোনো চুক্তি দুটি দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্র নির্ণয়ে যথেষ্ট নয়। সীমান্তে বাংলাদেশের মানুষকে অব্যাহত হত্যা আর কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আর যা-ই হোক, জনগণের ভালোবাসা অর্জন করা যায় না। কোনো সরকার বা মানচিত্রের রদবদল সম্পর্ককে জোরদার করে না। উভয় দেশের জনগণের অকুণ্ঠ ভালোবাসার জন্য উভয় সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। উভয় দেশের জনগণকে লালিত নেতিবাচক মনোভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। সম্পর্ক কখনই একতরফা হয় না। অবশেষে কবিগুরুর ভাষায় বলা যায়, ‘দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে, এই মহামানবের ভারত সাগরতীরে’।

ড. আবদুল লতিফ মাসুম : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।