ঢাকা : সহস্র হাটবাজারের সমষ্টি?

Looks like you've blocked notifications!

বাসা আর বাড়ি- এ দু'টোর তফাৎ কী?  আমার এক বন্ধু কৃষক নেতা মরহুম আনিসুর রহমান মামুন তফাতটা বুঝিয়েছিলেন এ ভাবে,  বাড়ি হচ্ছে অপরিকল্পিত বাসস্থান। চৈত্র মাসে কৃষকের হয়তো কাজ নেই, এই সুযোগে কয়েক ভাই মিলে বাড়ির কোথাও খাদ করে মাটি কেটে রাখল, যাতে বর্ষাকালে প্রয়োজনে কাজে লাগাতে পারে। সময় না পেলে হয়তো এ মাটি কাটাই হতো না। আবার কাজে না লাগলে ওই মাটি ঢিপি হয়েই থাকবে বছরের পর বছর। বাড়ির ছোট ছেলে তার বন্ধুর বাড়ি থেকে নিয়ে এলো একটি দোপাটি ফুল গাছ। মা জায়গা দেখিয়ে দিয়ে বললেন, এখানেই লাগিয়ে দে, আর সকাল-বিকাল পানি দিস। এ ভাবেই বাড়িতে হয়ে গেল একটি ফুল বাগানও। কিন্তু বাসা তা নয়, এর সব কিছুই পরিকল্পিত। কোথায় এক চিলতে উঠোন, কোথায় বাগান, কোথায় আবর্জনা ফেলা হবে- সব কিছুই পরিকল্পিত। 

বাসা আর বাড়িতে যেমন শহর আর গ্রামেও তেমনি তফাৎ আছে, যা খুব সহজেই চোখে পড়ে। শহর মানেই ক্ষমতাশালী মানুষের বাসস্থান, বিদেশি অতিথিদের আনাগোনা, বড় বড় ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস-আদালত ইত্যাদি। তাই শহরের কথা মনে হলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে অট্টালিকা, ঝকঝকে চওড়া রাস্তা, বিদুৎ, গ্যাস, পানির সুবিধা, নির্দিষ্ট দূরত্বে বাজার চেইনশপ, বাসস্ট্যান্ড, চিকিৎসাসেবা, উচ্চ শিক্ষার সুযোগ ইত্যাদি ইত্যাদি। আর গ্রাম মানেই নিভৃত পল্লী। 

কে কোথায় বাড়ি তুলছে, পুকুর খনন করছে দেখার কেউ নেই। নেই রাস্তাঘাটের সুবিধা। আলপথ কারো বাড়ির কোনাকাঞ্চি দিয়ে উঠে গেছে গ্রামের মধ্যে। বিজলি বাতি সেখানে থাকা না থাকা সমান। ভালো শিক্ষা-চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। একটি প্যারাসিটামল আনতে গ্রামের মানুষকে ছুটতে হয় গ্রাম থেকে দূরের হাটে-বাজারে। কোনো মেহমান এলে ১০০ গ্রাম চা-পাতি, দুই প্যাকেট বিস্কুট আনতেও একই অবস্থা। যেহেতু গ্রামের সাথে নিভৃত শব্দটি জড়িয়ে গেছে, তাই কোলাহলের ভয়ে গ্রামের মানুষ সাধারণত গ্রামের মধ্যে হাট-বাজার বসায় না। গ্রাম থেকে দূরে কয়েক গ্রামের মাঝ খানে কোনো জায়গায় এক বা দুইদিন হাট বসে। আর প্রতিদিনই যেখানে কেনাকাটা হয় তাকে বাজার বলে। এই বাজারগুলোর আবার আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। কোনোটা সকালে কোনোটা বিকেলে বসে। কোনো কোনো বাজারে একটি বা দুটি পণ্য কেনাবেচা হয়। যেমন দুধের বাজারে দুধ, ঘাসের বাজারে ঘাস। এখন কোনো কোনো বাজারে শহরের মতোই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কেনাকাটা চলে, সেখানে মাছ-তরকারি থেকে টিন, ফ্রিজ, টেলিভিশন পর্যন্ত প্রায় সব ধরনের জিনিসপত্র কেনাবেচা হয়। 

উপরের বর্ণনা অনূযায়ী দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ঢাকাকে আমরা কী বলব? গ্রাম, হাট-বাজার না শহর?  এটাকে গ্রাম বলা যাবে না কারণ- এটা নিভৃত নয়। এখানে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বসবাস করেন। বিদুৎ, গ্যাস, পানির সুবিধা দেশের অন্যান্য যেকোনো এলাকার চেয়ে এখানে বেশি। সারা দেশের প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় যে সচিবালয় থেকে তার অবস্থানও এখানেই। বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয়ও এই ঢাকাতেই অবস্থিত। প্রধান প্রধান বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে ঢাকাতেই। রাষ্ট্রীয় অতিথিসহ বিদেশিরাও প্রধানত এখানেই আতিথ্য গ্রহণ করছেন। এখানকার নাগরিকদের সুবিধার্থে গঠন করা হয়েছে দুই-দুটি সিটি করপোরেশন, যার শত শত কর্মকর্তা-কর্মচারী নাগরিকদের সুবিধার্থে কাজ করে যাচ্ছে দিনরাত। 

কিন্তু এত কিছুর পরও ঢাকার যেকোনো জায়গায় দাঁড়ালেই মনে হয় যে, গ্রামের হাট-বাজারকেই যেন তুলে এনেছি এই ঢাকায়। চেইন শপের সামনেই ফুটপাতে বসেছে আলু-পটলের দোকান। দুই দোকানের মাঝখানের রাস্তা যেন হয়ে উঠেছে গ্রামের হাটের গলি। ভ্যান, রিকশা, চায়ের দোকান সৃষ্টি করেছে আরেক গলি যা শহরের চওড়া রাস্তাকে করে ফেলেছে আরো সংকুচিত। আর এ অবস্থা ঢাকার কোনো বিশেষ এলাকার নয়, পুরো ঢাকারই। ফলে গ্রামের হাট-বাজারে যেমন লম্বা লম্বা পা ফেলে হাট-বাজারের গলি পার হতে হয় এখানেও তাই। এ কারণে খুব সহজেই যে কেউ বলতে পারেন যে, ঢাকা এখনো শহর হয়ে উঠতে পারেনি, হয়ে আছে গ্রাম থেকে উঠে আসা সহস্রাধিক হাটের সমষ্টি। গ্রামের হাটবাজার বসার একটা নিয়ম আছে, আছে সময়। কিন্তু ঢাকার এ হাটবাজারগুলো বসার কোনো নিয়ম নেই।  হাটের জন্য নির্দিষ্ট স্থানেও যেমন বসছে, তেমনি যেখানে আবাসিক এলাকা- যেখানে দোকানপাট, হোটেল-রেস্তোরাঁ, অফিস-আদালত থাকার কথা নয়, সেখানেও বসছে মাছের বাজার, তরকারির হাট। এটা যে কর্তা ব্যক্তিরা জানেন না তা কিন্তু নয়।

বিপদে পড়লে মনে পড়ে, বিপদ কেটে গেলেই বেমালুম ভুলে যান তারা। হলি আর্টিজান দুর্ঘটনার পর মনে হয়েছিল আবাসিক এলাকায় দোকান, অফিস হওয়া উচিত নয়।

আর কর্তা ব্যক্তিদের সিদ্ধান্ত নিয়ে ভুলে যাওয়ার কারণেই প্রতিনিয়ত ঢাকায় যোগ হচ্ছে আরো আরো হাটবাজার। শহর আর হয়ে উঠতে পারছে না। 

লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা ।