বাংলাদেশ

প্রকৃতি

বৈচিত্র্যময় প্রতিবেশের সমাবেশ

Looks like you've blocked notifications!
মুশফিক আহমদ

বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা আমাদের ছোট্ট এই দেশটি একটি ব-দ্বীপ। পদ্মা-গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র নদীব্যবস্থার কল্যাণে বয়ে আসা পলিমাটির সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে এ দেশের উর্বর ভূমি। প্রতিবছর এই নদীগুলো হিমালয় থেকে প্রচুর পরিমাণে পলিমাটি নিয়ে এসে আমাদের দেশকে পৃথিবীর অন্যতম উর্বর দেশে পরিণত করেছে।

এই নদীগুলো আবার দক্ষিণে গিয়ে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে মিশেছে। মূলত সমতলভূমির দেশ হওয়ায় এটি ভাটির দেশ হিসেবেও পরিচিত, যা সমুদ্রসীমা থেকে মাত্র ১২ মিটার উঁচু। তবে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কিছু কিছু এলাকায় ছোট-বড় পাহাড় আছে। ভৌগোলিকভাবে আমাদের দেশটির অবস্থান ক্রান্তীয় অঞ্চলে হওয়ায় এখানে বছরের বেশির ভাগ সময় উচ্চ তাপমাত্রা ও বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি থাকে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণও সময়ভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে।

হিমালয় পাদদেশের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত হওয়ায় বর্ষাকালে মৌসুমি বায়ু পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে বয়ে থাকে এবং এর ফলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট অঞ্চলে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়। বর্ষাকালে দেশের মোট বৃষ্টিপাতের শতকরা ৮০ ভাগ হয়ে থাকে। এই আবহাওয়াগত কারণেই আমাদের দেশ বেশ কিছু বৈচিত্র্যময় আর অনন্য প্রতিবেশব্যবস্থার ধারক। এখানে স্থানভিত্তিক উদ্ভিদ, প্রাণী ও অণুজীবের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবেশব্যবস্থা বা ইকোসিস্টেম।

বাংলাদেশে হাওর, বাঁওড়ের মতো অনন্য কিছু জলজ প্রতিবেশব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে চিরসবুজ বন, শালবন বা ম্যানগ্রোভ বনের মতো নান্দনিক প্রতিবেশব্যবস্থা দেখতে পাওয়া যায়। ভিন্নধর্মী এ প্রতিবেশব্যবস্থাগুলো এ দেশের জীববৈচিত্র্যের ভাণ্ডারকে সম্বৃদ্ধ করেছে। আমাদের দেশ স্থলজ, জলজ, সামুদ্রিক, পাহাড়ি, দ্বীপসমন্বিত বহু প্রাকৃতিক সম্পদের আধার। এখানকার অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদ হলো পানিসম্পদ, যার বড় অংশই নদী।

বাংলাদেশের প্রাণের স্পন্দন এই নদীগুলো আমাদের ভূ-প্রকৃতি ও মানুষের জীবন দুটোরই প্রতিনিধিত্ব করে। ছোট-বড় প্রায় ৭০০টি নদীর অধিকাংশের উৎপত্তিস্থল উত্তরের হিমালয় এবং এদের শেষ ঠিকানা হলো দক্ষিণের বঙ্গোপসাগর। এই সুবিশাল বঙ্গোপসাগরের নীল জলরাশি শুধু সৌন্দর্যের উৎসই নয়, বরং এর অফুরন্ত সম্পদ প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক দুদিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ।

সমুদ্রের সঙ্গে দ্বীপের সখ্য সারা জীবন ধরেই। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে রয়েছে বেশ কিছু দ্বীপ। এই দ্বীপাঞ্চলগুলো এ দেশের প্রতিবেশব্যবস্থায় এনেছে ভিন্নমাত্রা। বঙ্গোপসাগরের ফানেল বা চোঙ আকৃতির অগভীর প্রণালিতে উপকূলীয় এ ধরনের প্রচুর দ্বীপ গঠিত হয়েছে। কখনো কখনো প্রকৃতির খেয়ালে আবার হারিয়েও গেছে। সেন্টমার্টিন, সোনাদিয়া, নিঝুম দ্বীপ, হাতিয়া, চর কুকরীমুকরী ইত্যাদি এ দেশের উল্লেখযোগ্য দ্বীপাঞ্চল। এই দ্বীপগুলোর সবই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ এবং বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রাণী, বিশেষ করে পরিযায়ী পাখিদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বাসস্থান। দ্বীপগুলোর মধ্যে সেন্টমার্টিন দ্বীপ বা নারিকেল জিঞ্জিরা দেশে-বিদেশে সবচেয়ে বেশি মনোযোগের কেন্দ্রে আছে। কারণ, প্রকৃতির নিজ হাতে গড়া, অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত এই দ্বীপ বাংলাদেশের একমাত্র প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ। নাফ নদীর মুখে অবস্থিত বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে ওঠা এই সেন্টমার্টিন দ্বীপই বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের অংশ।

আমাদের দেশটিকে সবুজ ও মনোরম করে তোলার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান হলো বন-বনানীর। এখানকার আবহাওয়া বনভূমি গড়ে ওঠার জন্য বেশ উপযোগী। এ দেশে চিরসবুজ বন, আংশিক চিরসবুজ বন, আর্দ্র পত্রঝরা বন বা শালবন এবং ম্যানগ্রোভ বন রয়েছে। স্তরভিত্তিক উদ্ভিদের চিরসবুজ বনের বৈচিত্র্যতা ও সৌন্দর্যের ছটা এ দেশকে করেছে দীপ্তিময়। বনের সবুজ গাছগাছালি আর শত শত পাখি প্রজাতি ও অন্যান্য বন্যপ্রাণী এই প্রতিবেশব্যবস্থার বড় ব্যঞ্জনা। চিরসবুজ বন ছাড়া অন্য যে বনটি এ দেশের প্রকৃতির বৈচিত্র্যময়তা তুলে ধরেছে, সেটি শালবন বা পত্রঝরা বন।

একসময় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়, অখণ্ড বনভূমি ছিল এই শালবন। গাজীপুর থেকে টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও উত্তরবঙ্গ হয়ে ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বর্তমানে এই বন দেশের বিভিন্ন জেলায় খণ্ড খণ্ডভাবে বিস্তৃত আছে। তবে বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যতিক্রমী ও অনন্যসাধারণ বন হলো ম্যানগ্রোভ বন। সুন্দরবন হচ্ছে আমাদের প্রধান ম্যানগ্রোভ বন। বাংলাদেশ ও ভারতের অংশ মিলিয়ে এটি পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। প্রকৃতির আশ্চর্য সুন্দর এই বনের মাটি ও পানির লবণাক্ততা এবং নিয়মিত জোয়ার-ভাটার প্রভাবে এটি ভিন্ন ধরনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে তার প্রতিবেশব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। এই বড় বনগুলোর পাশাপাশি এ দেশে আরো বিশেষ কিছু ধরনের বন আছে, যেমন—উপকূলীয় বন, সমুদ্রসৈকত বন, জলাভূমির বন, গ্রামীণ বন ইত্যাদি।

আমাদের দেশে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে বেশ কিছু পাহাড় দেখা যায়। পাহাড়গুলো তাদের আশপাশের গাছপালা, বন্যপ্রাণী, নদী, ঝর্ণা, গুহা মিলে একটি স্বতন্ত্র প্রতিবেশব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। এ ছাড়া আমাদের দেশের উত্তরাঞ্চলে রয়েছে শুষ্ক সমতলভূমি ও লালচে মাটি। এ অঞ্চলে কম বৃষ্টিপাত, উচ্চ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা স্থানীয় জীববৈচিত্র্যকে করেছে ভিন্ন। উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর, রংপুর, পাবনা, রাজশাহী, বগুড়া ও নওগাঁ অঞ্চল বরেন্দ্রভূমি নামে পরিচিত। এখানে বনভূমির পরিমাণ অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় কম, তবে বরেন্দ্রভূমির মাটিতে খনিজ সম্পদের পরিমাণ বেশি, যেমন—কয়লা, পিট, সাদা ক্লে, চুনাপাথর প্রভৃতি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়।

আমাদের এই প্রতিবেশব্যবস্থাগুলো ও এর প্রাকৃতিক সম্পদ আমাদের প্রকৃতিকে করেছে ঋদ্ধ। সুপ্রাচীনকাল থেকে এই পরিবেশ ও প্রতিবেশের মাঝেই আমাদের জন্ম, বেড়ে ওঠা ও বেঁচে থাকা। ভিন্নধর্মী প্রতিবেশের উদ্ভিদরাজি ও প্রাণিকুলের সঙ্গে আমাদের নিত্যদিনের সখ্য। যদিও হাজার বছরের পথচলা ও শত প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে আসা বহুমুখী ও বৈচিত্র্যময় নানা প্রতিবেশব্যবস্থা এখন কিছুটা বিপর্যয়ের মুখে।

জলবায়ু পরিবর্তন ও অন্যান্য নানাবিধ কারণে এ দেশের বর্ণিল প্রকৃতি বর্তমানে তার সবুজ রং হারিয়ে অনেকটা বিবর্ণ। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট নানা কারণে আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশের সোনালি সময় হুমকির মুখে। তাই প্রকৃতির প্রতি আমাদের সবার সংযতসদয় আচরণ ও একে রক্ষায় উপযুক্ত সংরক্ষণ পদ্ধতি গ্রহণ বাংলার অপরূপ প্রকৃতি ও প্রতিবেশব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে পারে। প্রকৃতির প্রতি আরো যত্নবান হলেই আমাদের মাঝে এই অনন্য প্রতিবেশব্যবস্থাগুলো নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য ধারণ করে টিকে থাকবে যুগ-যুগান্তর।

মুশফিক আহমদ : প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক গবেষক।