সাগরে ভাসছে বাংলাদেশের মানবসম্পদ

Looks like you've blocked notifications!
অধ্যাপক ড. মো. শরিফ উদ্দিন।

দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীকে মানবসম্পদ হিসেবে অভিহিত করা হয়, অথচ সাগরবক্ষে অর্ধমৃত আদমসন্তানদের নির্বাক চোখ জানান দেয় আমাদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা কতটুকু তলানিতে ঠেকেছে। জলযানে সাগরপথে মানবপাচারের এই করুণগাঁথা নতুন নয় আমাদের কাছে, দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতায় এখন অনেকটাই গা সওয়া পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে।

সাম্প্রতিক সময়ের খবরের কাগজের প্রধান সংবাদের মর্যাদা নিয়েছে বিপন্ন মানুষদের এই ঘটনাবলি। দেশ ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও গুরুত্বের স্থান এখন মানবপাচারের খবর। সম্প্রতি বিবিসির এক প্রতিবেদনে সর্বহারা এসব মানুষের যে যন্ত্রণার ছবি তুলে ধরা হয়েছে, তা দেশ-জাতি-কাল-ধর্ম-সীমানার ঊর্ধ্বে সব মানুষকেই পীড়িত করে।

মানবপাচারের ঘটনায় প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের ধর্মীয় উগ্রপন্থা, নাগরিকদের প্রতি পাষাণ, সুদূর কিংবা নিষ্ঠুর আচরণ বহুলাংশে দায়ী। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এখন সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্যই বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব নারী-পুরুষ ও শিশু যাদের একটি দেশ থেকেও নেই, হারিয়েছেন নিজেদের সংসার এবং সম্ভ্রম।

উপকূলীয় এলাকা দিয়ে পাচার হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন এখন বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ, যাদের শেষ সহায়-সম্বল বিক্রি করে মানুষ ব্যবসায়ীদের হাতে বিক্রীত অর্থসহ সঁপে দিয়েছেন নিজেদের। একটু উন্নত জীবন, অর্থ এবং স্বজনদের নিয়ে খানিক ভালো থাকার আশায়, সাক্ষাৎ মৃত্যুর দুয়ারে নিজেদের হাজির করেছেন।

রাষ্ট্র ও সরকার এখানে নির্বিকার ভঙ্গিতে দর্শকের ভূমিকা নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, দায়ও অস্বীকার করেছে চাতুর্য এবং সাহসিকতার সঙ্গে। মন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়গুলো বিবৃতি, পাল্টা বিবৃতি, সংবাদ সম্মেলনে এসব মানবপাচার নিজেদের কর্মের পরিধিভুক্ত নয় বলে ঘোষণা দিয়েছে, অন্য মন্ত্রণালয়ের ওপর মৃদু ভঙ্গিতে আঙুল তুলেছেন।

দেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের তাহলে করণীয় কী? আমরা এখন কোথায় যাই, এই দুর্যোগে তবে সবাই মিলে গণপ্রার্থনা আয়োজন ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা রইল না বুঝি! বুধবারের দৈনিক প্রথম আলো লিখেছে, ‘১০০ বাংলাদেশিসহ তিন শতাধিক নারী-পুরুষ নিয়ে ভেসে চলা চালকবিহীন নৌকাটির দুদিন ধরে আর খোঁজ মিলছে না।’ 

মানবপাচারের ঘটনা নতুন না হলেও এটি নতুন মাত্রা পায় ২০০৯ সাল থেকে সৌদি আরবে এবং ২০১২ সাল থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে শ্রমবাজার বন্ধ হওয়ার পর। এ ছাড়া বাংলাদেশের জন্য বেশ কয়েকটি দেশের শ্রমবাজার ঘোষিত কিংবা অঘোষিতভাবে বন্ধ রয়েছে। মালয়েশিয়ায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় তিন বছরে মাত্র সাত হাজার শ্রমিক পাঠানো হয়েছে।

বৈধভাবে যেহেতু পথ বন্ধ, সেহেতু পাচারকারীদের দেখানো প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে অবৈধভাবে নদী ও আকাশপথে বাংলাদেশের শ্রমিকরা বিদেশে যেতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন, এটি বুঝতে বেগ পেতে হয় না। অথচ এটি সেই সময় যখন ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের কর্তাব্যক্তিরা দেশকে মালয়েশিয়ার আদলে গড়ার  স্বপ্নে আমাদের বিভোর করছেন। আধুনিক মালয়েশিয়ার যখন পত্তন হচ্ছিল, কে জানি সে দেশের গণমানুষ সাগরপথে রুটি-রুজির আশায় কোনো দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন অবৈধভাবে।

এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে, মানুষের জীবনযন্ত্রণা এখন চরমে পৌঁছেছে। আর এসব সুযোগ নিচ্ছেন মানব পাচারকারীরা। সরকারের উদাসীনতা ও শ্রম অভিবাসনে পরিকল্পনার অভার এবং অরাজকতাই বর্তমানে এ ভয়াবহ অবস্থাকে আরো উসকে দিচ্ছে।

সরকারের সুস্পষ্ট কোনো পদক্ষেপ না থাকা, জাতীয় জীবনের নিত্যনতুন বিপর্যয় এবং বেশি রোজগারের হাতছানিতে দেশের সহজ সরল মানুষগুলো অবৈধভাবে বিদেশে যেতে উৎসাহিত হচ্ছেন। এ অবস্থার অবসান হতে হবে, অবশ্যই হতে হবে এবং স্বল্প সময়ের ব্যবধানে। আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে এবং অধিক হারে প্রশিক্ষিত জনশক্তি বিদেশে পাঠানোর জন্য মানবসম্পদ সংক্রান্ত ও বিদেশনীতির আধুনিকায়নও কম জরুরি নয়।

পাচারকারীদের প্রলোভনে পড়ে বহ মানুষ এখন সাগরে ভাসছে। তারা আমাদেরই ঘনিষ্ঠজন, এ দেশেরই গণমানুষ। সমষ্টিগতভাবে এর দায় আমরা এড়াতে পারি না। খাবার ও পানির অভাবে যারা ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া উপকূল এবং মধ্যসাগরে মানবেতর জীবন অতিবাহিত করছেন অন্তত মানবিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তাদের অতিদ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে এবং প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে।

শুধু মৌখিক বিবৃতি এবং মোলায়েম আহ্বানেই নয়, জাতিসংঘ যৌক্তিক অবস্থানে থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে যথাযত পদ্ধতিতে সহায়তা করবে, মানুষ এমনটিই আশা করে। মনুষ্যবোধে অগ্রাধিকার পাবে মানুষ, জয়ী হোক মানুষ ও মানবতা।

লেখক : অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।